‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ৩ ।। খন্ড – ৬)

কফি পাহাড়ের রাজা

তৃতীয় পর্ব:

৬)
ভোররাতে কুকুরের দাক শুনেছিল বিদ্যা ঘুমের ভেতর। বুঝল মুরুগান ফিরেছে। ওকে এখন আর ঘাঁটিয়ে লাভ নেই, ভেবে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল বিদ্যা। অনেক বেলা করে সেদিন ঘুম ভাঙল বিদ্যার। রোদ উঠেছে বাইরে ঝলমলে। ধড়মড় করে উঠে বসল বিদ্যা। মুখচোখ ধুয়ে মুরুগান আর ওর জন্য কফি বানিয়ে মুরুগানের ঘরে গিয়ে দেখল, বিছানায় কেউ নেই। বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখল, সেখানেও কেউ নেই। বাড়ির বাগানে খুঁজল, চাকরবাকরদের জিজ্ঞেস করল, মুরুগানকে কেউ বেরতে দেখেছে কিনা। কেউই কিছু বলতে পারল না। একাই কফি খেয়ে ঘরদোরের কাজ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভাবল মুরুগান হয়ত এখুনি এসে পড়বে। বাগানে যাওয়ার জন্য তৈরি হল। সেখানেও মুরুগানকে দেখতে পেল না। এইবার খুব ভয় পেয়ে গেল বিদ্যা। লোকটা কোথায় গেল? কুগানকে ডেকে পাঠাল। চারিদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেল। নাঃ! কোথাও মুরুগানকে পাওয়া গেল না। একজন গাড়ির ড্রাইভার শুধু বলল, অনেক ভোরে মুরুগানকে একটা গাড়িতে নিজে ড্রাইভ করে যেতে দেখেছে। প্রথমটায় ভেবেছিল সে বুঝি অন্য কেউ। এখন যখন ওঁকে পাওয়া যাচ্ছে না বলছে সবাই, তাই তার টনক নড়েছে। সেই জন্যই এই খবর সে জানিয়ে দিয়ে গেল।
পুরো বাগানে গুঞ্জন শুরু হল মুরুগানকে নিয়ে। কোথায় যেতে পারে মানুষটা? যে কিনা খুব দরকার না হলে বাগান ছেড়ে বেরতেই চায় না। তাও আবার কাউকে কিছু না বলে! নিশ্চই বিদ্যার সঙ্গে ঝগড়া করে কোথাও চলে গেছে! বিদ্যা নিজের ঘর বন্ধ করে বসে আছে। তার চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতাও আর নেই এই মুহূর্তে। কী এমন হল যে মুরুগান তাকেও না বলে চলে গেল! যেতে পারল? এই তাদের এতদিনকার বনিবনা? বোঝাবুঝি? প্রচণ্ড অভিমানে সে পাথর হয়ে বসে রইল। কুগান উদ্দেশ্যহীন ভাবে চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সে বুঝতেই পারছে না এখন তার কী করণীয়।
দিন সাতেক কেটে গেল এইভাবে। বিদ্যা আর কুগান আবার কাজে মন দিয়েছে। এছাড়া আর উপায়ই বা কী? একজন সমর্থ মানুষ সজ্ঞানে যদি কোথাও চলে যায়, তাকে আটকাবে কে? বিদ্যা ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে বাগানে যায় আসে, কাজকর্মে তদারকি করে। হ্যাঁ, খাওয়াদাওয়া, বাড়ির কাজকর্ম, মুরুগানের ঘর সাফাই—এসবও করে। সে কী ভাবছে, বা কতখানি শোকতাপ পেয়েছে তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। এক যন্ত্রের মতো নিজের কাজ সে করে চলেছে নির্ভুল ভাবে আর সঠিক সময়ে। পনেরোদিনের মাথায় একটা রেজিস্ট্রি পোস্ট এলো বিদ্যার নামে। খুলে দেখে, মুরুগান লিখেছে। ‘আমি শহরে আছি। এক কামরার একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি এখানে। আর কিছু কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়েছি। কোথায় আছি বা কী করছি, এগুলো জানানোর জন্য এই চিঠি আমি লিখছি না। আমি তোদের কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে তিরিশ লাখ টাকা নেব। খেপে খেপে। এ পর্যন্ত দশ নিয়েছি। আশা করি এতে তোর বা তোদের আপত্তি নেই। থাকলে জানাস। তোরা ভাল থাকিস নিজেদের মতো করে। এই পর্যন্তই……
চিঠি হাতে বিদ্যা কতক্ষণ যে বসেছিল সে নিজেও জানে না। অফিস বন্ধের সময়ে রাও এসে ওকে এভাবে বসে থাকতে দেখে কুগানকে খবর দেয়। কুগান চিঠির স্ট্যাম্প দেখে এটুকু উদ্ধার করতে পারে যে, চিঠিটা কুন্নুর জেলার কোথাও থেকে এসেছে। কিন্তু জায়গার নাম বোঝা যাচ্ছে না স্পষ্টভাবে। বিদ্যার হয়ে অফিসের কেউ একজন চিঠি নিয়েছিল যখন, প্রেরকের নাম, ঠিকানা স্বাভাবিক ভাবেই সে দেখেনি। এছাড়া খামে অন্য একজনের নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর লেখা আছে প্রেরক হিসেবে। সেই নম্বরে ফোন করলে একজন একটি ক্যুরিয়ার সার্ভিসের নম্বর এটা জানিয়েছে। অনেক চেষ্টা চালিয়েও কুগান বা রাও মুরুগানের হদিস পায়নি তাই। বিদ্যাও কখনও কাউকে মুরুগানের খোঁজ করতে বলেনি।
মাসখানেক কেটে যাওয়ার পর, মুরুগানকে সবাই প্রায় ভুলেই গেল যেন। একটা আস্ত, জলজ্যান্ত মানুষের অস্তিত্ব হারিয়ে গেল। কুগানও আর কাকার নাম উচ্চারণ করে না। আর বিদ্যা তো কিছুই বলে না কোনদিনই। তার মনে কী আছে, সেইই জানে একমাত্র। এইরকম সময়ে আবার সেই মাড়োয়ারি কোম্পানির লোক এসে বিদ্যার কাছে সেই অফার প্রসঙ্গে কথা বলতে এলো। বিদ্যা আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে রাজি হয়ে গেল। তারও কিছু প্রমাণ করার আছে। মুরুগানের সব যুক্তি যে ঠিক নয়, তারও নিজস্ব সঠিক বিবেচনা বোধ আছে, এ তাকে হাতেকলমে দেখিয়ে দিতে হবে। জেদ, রাগ আর অভিমানে তার ঘাড় শক্ত হয়ে রয়েছে এখন। চোখের দৃষ্টি দূরে ছড়িয়ে দিয়ে সে চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নেমেছে মুরুগানের বাগান। হ্যাঁ, এই কফিবাগান আজও মুরুগানের। লিখিত মালিকানা পেলেই যে সত্যিকারের মালিক হওয়া যায় না, এ বিদ্যা ভালই বোঝে। এমনকি ওই কফিগাছগুলো, খেতের জমি, মাটি, সবাই মুরুগানকে চেনে। সবাই মিস্‌ করছে তাদের মুরুগানকে। আর তার এলাচপ্রিয়া যেন এই একমাসের প্রেমহীনতায় শীর্ণ হয়ে গেছে। দূর থেকে গাছটাকে দেখে বিদ্যা মাঝেমাঝে। কাছে যায় না। গাছটাকে দেখলে মনে হয় যেন গুমরে গুমরে কাঁদছে। যেন ও কতদিন স্নান করেনি, খায়নি, ঘুমোয়নি…বিরহে পাগলপারা অবস্থা তার। আজ কেন জানি, ওই গাছটাকে খুব হিংসে হল বিদ্যার। এই তো তাদের মধ্যে যেন পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কতকাল ধরে। হয়ত এসবই বিদ্যার কল্পনা। কাজ আর নিয়ননিষ্ঠা, সুশৃঙ্খল অবস্থায় থাকা বিদ্যারও যে এক কল্পনার জগত আছে ও ছিল, এ মুরুগান ছাড়া আর কেই বা জানে। কে জেনেছে আর তার এতটা? মুরুগান, মুরুগান…ফিরে এসো একবার। একবার ফিরে এসো…চোখের জলে কখন যে জানলার কাচ দিয়ে বাইরের পাহাড়ের ঢাল অস্বচ্ছ দেখাচ্ছে, বিদ্যা টের পায়নি। খেয়াল হলে চোখ মুছে নিল চট করে। যেন নিজের কাছে ধরা পড়ে গেছে, এমন হাবভাব। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে বিদ্যা শক্ত মুখে ওই কনট্র্যাক্ট পেপার নিয়ে বসল। পাতার পর পাতা উল্টে গেল একে একে। যদিও এসব আইনের কচকচি ও তত বোঝে না। রাও এসব দেখে। যেটুকু অংশ এই চুক্তির প্রধান, সেটুকু দাগিয়ে দিয়েছে রাও। ফলে বুঝতে সুবিধে হয়েছে বিদ্যার। এই অফার সে ছাড়বে না। ওকে প্রমাণ করে দিতে হবে। নইলে যে সে নিজের কাছেই হেরে যাবে। তাছাড়া মুরুগানকে ফিরিয়ে আনার এই একমাত্র পথ! ও জানে, মুরুগানও জানে, ওদের সম্পর্কটা অলিখিত তো বটেই। অন্যের কাছে অকল্পনীয় এই সম্পর্কের চলাচল। তাদের নিজেদের কাছেও ততটা স্পষ্ট নয় বোধহয় যে, কোন বাঁধনে তারা বাঁধা পড়েছে। সহমত, বিরুদ্ধ মত, সময়ে সময়ে আবার অন্ধ সমর্থক এবং একে অপরের কঠোর সমালোচক, তা সত্ত্বেও একটা অস্বচ্ছ নাইলনের সুতোর কড়া পাক তাদের বেঁধে রেখেছে। মুরুগানকে তাই ফিরতেই হবে একদিন। নইলে যে বিদ্যা হেরে যাবে!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।