মেহেফিল -এ- কিসসা সৈয়দা শর্মিলী জাহান (গদ্য)

রতন

মজিদ মিয়ার ফলের ব্যবসা । তাঁর চার ছেলে দুই মেয়ে । সবার ছোট ছেলেটির নাম রতন । দেখতে নাদুস-নুদুস, খুবই মায়াময় সুন্দর চেহারা । স্বভাবে সহজ সরল । জগতের কোন প্যাঁচই সে বোঝে না । এমন সন্তানই তো কাম্য ; তবু এই ছেলে নিয়ে মজিদ মিয়ার চিন্তার অন্ত নাই । স্থান-কাল-পাত্র ভুলে জটিল পরিস্থিতিতে রতন বেফাঁস কথা বলে ফেলে ; তাই পরিবারের প্রতিটি সদস্য ভয়ে তটস্থ থাকে সহজ, সরল, নিষ্পাপ এই রতনের ভয়ে ।
বড় পরিবার মজিদ মিয়ার । পরিবারের আয়-উন্নতিকল্পে মজিদ মিয়া অন্য ছেলেদেরকে ব্যবসার কাজে লাগাতে পারলেও ; রতনকে নিয়ে মহা সমস্যায় আছেন । ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি কিছু দুই নম্বরী কৌশল অবলম্বণ করেন । অন্য ছেলেদেরকে সেসব শেখাতে পারলেও ; রতনকে শেখানো তো দূরে থাক ব্যবসাসংক্রান্ত কোন আলাপই করেন না রতনের সামনে ।
একদিন ভাবলেন আর না, ব্যবসা শেখাতেই হবে এবার রতনকে ; নতুবা কি করে খাবে জীবনে? ঘুমন্ত রতনের উদ্দেশে হাঁক ছাড়লেন তিনি “ওই রতন ! উঠ, উঠ কইতাছি ! আর কত গুমাবি? গুমাইতে গুমাইতে তো মিডাকদু হইতাছোস দিন দিন !  আইজ চল আমার লগে বাজারে।
ঘুম থেকে উঠে হাতের তালু দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে বলল রতন ” আমি বাজারে গিয়া কিয়ারমু আব্বা?”
আমার সাতে বইয়া বইয়া ফল-মূল বেচনের কায়দা শিকপি।
আব্বা কি দরকার আপনের এত কষ্ট করনের? তারচায়া আপনে এক কাম হরেন ওই যে ওই কার্বুড দিয়া কাঁচা ফলগুলান পাকান না? হেই কার্বুড দিয়া আপনের চুল-দাড়িডি পাকাইয়া সরকার থন বয়স্ক ভাতা নেন !

এমনতর কথার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না মজিদ মিয়া । আক্কেল গুড়ুম হলো তার ! রতন কবে এতো বুঝতে শিখলো? ভাবলেন, এবার তবে ব্যবসার কলাকৌশল বুঝবে তার পুত্রধন । বললেন ” চুপ ! চুপ ! তরে যা কইছি তুই তাই কর। চাইড্যা খায়া নে তড়াতড়ি।”
পেটসেবা সম্পন্ন হলে হেলতে দুলতে বাবার পিছু পিছু বাজারে গেলো রতন । প্রথম দিনের দীক্ষা দিতে নিজে রোদে বসে, ছাতার নীচে আরাম করে বসালো পুত্রকে । একলোক আপেল কিনতে এলেন । মজিদ মিয়া ক্রেতাকে দুই কেজি আপেল দেবার আগে অতি সন্তর্পণে সেখান থেকে দুটি আপেল সরিয়ে রাখলেন । ক্রেতা চলে যাবার সময় রতন ডাক দিলো তাকে ” ও মামা হুনেন ! আপেল দুইডা নিয়া যান, আব্বার হাত থন পইরা গেছিলো নীচে !”
মজিদ মিয়া জটিল পরিস্থিতিতে ক্রেতা সামলাতে অভিনয় রপ্ত করেছেন বহু আগে । আপেল ইচ্ছাকৃত ফেলে দিয়ে ক্রেতাকে ঠকালেও চোখে-মুখে নিষ্পাপ বিস্ময় ফুটাতে পারলেন ভালো । ” আর কইয়েন না বাই, বষ হইতাছে তো বুলবাল অয় খালি। দিশ পাই না এহন হাতে আগের মতো হে হে হে।”
ক্রেতা মুচকি হাসি দিয়ে আপেল নিয়ে প্রস্থান করলেন ।
এরপর একলোক আঙুর কিনতে এলেন । রতনের উপদেশ ” চাচা, এগলা সাতদিন আগের। ওষুদের উপ্রে বাঁইচ্চা রইছে। বাসায় নিয়া তড়াতড়ি খাইলাইবেন !” ক্রেতার মন ছিলো অন্যদিকে, শুনেনি রতনের কথা । মজিদ মিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচলেন কিন্তু কপালে কুঞ্চন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন !
একলোক এসে ৫ কেজি নাশপতি দিতে বললেন। রতনের বিস্ময়  ” ৫ কেজি নিবেন চাচা !  সবই কি আফনার বাসার জন্য? একদিনে খাইয়া ফুরাইতে পারবেন তো ? নষ্ট অইব তো ! আফনে এক কাম করেন আব্বার কাছে যাদুর ওষুদ আছে ! হেইডা নিয়া পানির লগে মিশায়া… ” আর বলতে পারলো না রতন।
ক্রেতা রক্তচক্ষু নিয়ে মজিদ মিয়ার দিকে তাকাতেই; উপায়ান্তর না দেখে মজিদ মিয়া সর্বশক্তি দিয়ে কাশতে শুরু করলেন । কাশতে কাশতে পিঠ ধনুকের মতো বাঁকা করে বসে পড়লেন । এবার হাঁপানি রোগীর মতো টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগলেন । বিচলিত ক্রেতা ফল না কিনে চলে গেলেন ।  ক্রেতা যাবার পর মজিদ মিয়ার হুশিয়ারী রতনকে ” আর কুনু কাস্টমারের লগে কথা কবি তো মাতা ফাডাইলামু তর !”
প্রথম দিনের দীক্ষা এভাবেই শেষ হলো ; আর কোন ভজকট হলো না । শুরু হলো ২য় দিন ।
পেয়ারা কিনতে এক ক্রেতার আগমন। ” কি হে ! পেয়ারা কেমন টাটকা তো?”
সাথে সাথে রতনের চটপট উত্তর ” জি, দেহেন না কি সুন্দর সবুজ ! উপ্রে আল্লাহ নীচে আব্বার যাদু ! নিয়া যান খুব ভালা পেয়ারা ! এইবার ভালা কতা কইছি না আব্বা?” ক্রেতা পিতা-পুত্রের মুখপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পেয়ারা না কিনে চলে গেলেন ।
আরেক ক্রেতা এলেন ” ডাব কেমন? পানি মিষ্টি হবে তো?” মজিদ মিয়া অন্য ক্রেতার সাথে কথা বলছিলেন । রতনই চটপট উত্তর দিলো ” জি খুব মিষ্টি অইব, নিয়া যান । আব্বা নিজ হাতে ইনজেকশন দিছে ! আমি স্বাক্ষী আছি! “… ক্রেতা অগ্নিদৃষ্টিতে মজিদ মিয়াকে ছাই করে অন্য দোকানে গেলো!
বহু চেষ্টা করেও মজিদ মিয়া রতনকে শেখাতে পারলেন না তার ব্যবসার গোপন কৌশল । এভাবেই পন্ড হলো রতনকে ঘিরে মজিদ মিয়ার উদ্দেশ্য । এরপর যা ঘটলো তা আরো ভয়ানক ।
প্রতিবেশী আসলাম মিয়ার কাছ থেকে ব্যবসার জন্য কখনোসখনো টাকা ধার নেন মজিদ মিয়া । আসলাম মিয়ার আছে আলুর দোষ । তার শিশুপুত্রের সাথে রতনের বয়সের ব্যবধান থাকলেও, দুজনের ভাব বেশ ; তাই রতনের যাতায়াত আছে ও বাসায়। একদিন আসলাম মিয়ার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে ছেলের মা-বাবা । রতন তখন উপস্থিত ছিলো সেখানে । আসলাম মিয়ার বউ খুঁজছিলো স্বামীকে।
” কুনু দরকারের সুমে হেয় থাহে না বাসায়। মাইয়ার বিয়ার সম্মন্দ আইছে হুদাল নাই হের।”
” চাচী, আমি জানি চাচায় কই। ঐ সুহেলী খালার বাসায় আছে। আওনের সময় দেকচিলাম খালার খাটে হুইয়া রইছে।” সরল মনে বললো রতন কিন্তু ঘরের লোকজন কান খাড়া করে ফেলল সাথে সাথে।
রাগে অন্ধ হয়ে জবাব দিল আসলাম মিয়ার স্ত্রী ” চুপ কর বদমাইশ পুলা ! মলির বাপের লাহান ভালা মানুষ সারা বস্তিত নাই । বাইর অ আমার গর থন। আর কুনদিন যদি আইচোস জিবলা টান দিয়া ছিঁড়ালামু ।”
ধমকে দমলো তো না-ই বরং রতনের গলা আরো চড়া হলো ” মিছা কই নাই তো চাচী। সুহেলী খালার লগে চাচার অনেক খাতির । পেরায়ই দেহি হেরা হুইয়া হুইয়া গপসপ করে ।”
আসলাম মিয়ার স্ত্রী যতোই ধমক মারে রতনের গলা ততোই চড়তে থাকে । সুহেলীতে থেমে রইলো না ; আসলাম মিয়ার আরো পেয়ারের মানুষের নাম বলতে লাগলো রতন । রতনের বোঝার ক্ষমতা নেই কি বলছে সে কিংবা এসব কথার জন্য কি হতে পারে ; সে যা দেখেছে তা-ই বলছে । ছি!  ছি! করতে করতে আসলাম মিয়ার ঘর থেকে বের হয়ে গেলো কনে দেখার দল।
আসলাম মিয়ার স্ত্রী আতিপাতি করে খুঁজতে লাগলো কিছু । একটা ভাঙা শলার ঝাড়ু পেয়ে নেড়েচেড়ে দেখে ফেলে দিল, মনোবাসনা পূরণে তা যথেষ্ট মনে হলো না তার কাছে । খাটের নীচ থেকে বের করলো একটি পুরোনো কোদাল । উঁহু , রতনকে নয় আসলাম মিয়াকে বধ করার উদ্দেশে সুহেলীর ঘর অভিমুখে ছুটলো সে ।
এ ঘটনার রেশ ধরে ঘোলা জলে হাবুডুবু খেলো বস্তির বহু পরিবার । মজিদ মিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হলো সবচেয়ে বেশি । আসলাম মিয়া কৌশলে তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে দ্বিগুণ ঋণের টাকা দাবী করে বসলো মজিদ মিয়ার কাছে ; অনাদায়ে বস্তিছাড়া করার হুমকি দিলো ।
অনেক চিন্তা-ভাবনা করে মজিদ মিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলেকে ডাক্তার দেখাবেন । তিনি ধরেই নিলেন ছেলের মাথায় সমস্যা ; নতুবা এতো বেয়াক্কেলে কথা কিভাবে বলে সে? আলাপ করে এলাকার মানুষের কাছে জানতে পারলো ডাক্তার আব্দুল গনির কথা । পাড়া-প্রতিবেশি সবাই যায় তার কাছে । রতনকে নিয়ে আব্দুল গনির কাছে গেলো মজিদ মিয়া ।
আব্দুল গনি সব শুনে ঔষধ লিখে দিলো । ঔষধ বলতে দিলো ঘুমের ঔষধ। ধুরন্দর চালাক সে । ভুয়া ডাক্তারী সার্টিফিকেট নিয়ে মূর্খ বস্তিবাসীর চিকিৎসা করে ভালোই টাকা কামায় সে । বাড়ী ফিরে মজিদ মিয়া একদম নিয়ম মতো ঔষধ খাওয়ালেন রতনকে ; কিন্তু দুদিন পরই আবার গেলেন আবদুল গনির কাছে । গনি ডাক্তারের উচ্ছ্বসিত মন্তব্য ” কি মজিদ মিয়া ছেলের আবোল-তাবোল কথা বন্ধ হইছে না?”
জি, ডাক্তার সাব খুব উপকার হইছে। কতা একদম বন্দ অইছে ; কিন্তু সমেস্যা অন্যখানে দেখা দিছে। হে খালি সারাদিন গুমায় । গুমের গোরে উইট্যা  ঝিমাইতে ঝিমাইতে হাতের কাছে যা পায় তা-ই খায় ! কি কমু শরমের কতা…গতকাল হে খাওনের লাইগা জন্মবিরতি বড়ি হাতে লইছিলো ডাক্তার সাব! ভাইগ্যডা বালা আমি দেকচিলাম নয়তো খায়ালাইতো ।
হ বুচ্ছি! কিন্তু তাঁর কথা বন্ধ রাখতে এরচেয়ে উত্তম চিকিৎসা আর নাই! এইডাই শেষ চিকিৎসা।
অতঃপর মজিদ মিয়া সব চিকিৎসা বাদ দিলেন।  গালে হাত দিয়ে কেবলই ভাবেন ‘ কি বুল সিদ্দান্তই না আছিলো ! দুলাল, টিয়া, লালু ,মনা , টিটুরে নিয়াই থাকতাম, কিল্লাই রতন আনলাম?’

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।