T3 || শ্যামা আমার || দীপাঞ্জলী সংখ্যায় শর্মিষ্ঠা সেন

অবিনাশের জটিল সমস্যা
অবিনাশের ঘুম নেই। দীর্ঘদিন। এমনিতেই পঞ্চাশের দোরগোড়ায় আসার আগে শরীর জানান দেয় নানাভাবে। কারা যেন বলে, লাইফ স্টার্টস অ্যাট ফরটি। একেবারে বাজে কথা। খোকার হাতের ল্যাবেঞ্চুষ। খেলেই ক্রিমি। নোলা যতই রস ফেলুক এ বয়সে চিনি বাড়ার ভয়ে ভাত মেপে, রুটি গুনে, মিষ্টি মাইনাস করে, চর্বি জমার ভয়ে পশু বিনে কেবল লতা-পাতা, পেঁপে, ঝিঙের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে স্বাস্থ্য উদ্ধারের অপচেষ্টা। এদিকে আবার ডি এ নেই, বাইকে হাওয়া নেই, বউ এর হাসিমুখ নেই, মায়ের শান্তি নেই, মেয়ের পড়াশোনা নেই, জীবনে স্বস্তি থাকলে তবে তো মানুষের ঘুম? বউ এর গর্জনের মাঝে ফাঁক ফোঁকর খুঁজে দু চোখের পাতা এক করতে করতে পি.এম চলে গিয়ে এ.এম হয়ে যায়, কিন্তু আমাদের অবিনাশের বিষয় একেবারেই অন্যরকম, তিনি বেদম ভয়ে ঘুমোতেই পারছেন না!
যদি ভাবেন ভূতের গপ্প ফাঁদছি তা একেবারেই নয়, তবে ‘অদ্ভুত’ বলা যেতে পারে। অবিনাশ গন্ধ পান। তেলের গন্ধ। চুলে দেওয়া বা গায়ে মাখার ফুলেল তেল নয়, কেরোসিন তেলের গন্ধ। ‘ফ্যান্টম স্মেল’ বলা যেতে পারে। আর কেউ যা নাকে থুড়ি নাগালে পায়নি। সাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা। ঐ যাকে বলে টোয়েন্টি ফোর বাই সেভেন। কখনো চুপিসারে নাক কে না জানিয়ে মাথাকে প্রশ্ন করেন, ‘আছে নাকি দ্যাখোতো হে? গন্ধটা?’ ওমনি নাক জানান দেয়, ‘আছে আছে, এই যে, মৃদু ভাবে।’ অবিনাশের মাথার পেছন থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায় গরম হলকা! কান ঝাঁ ঝাঁ করে। নাকের নীচে বিনবিনে ঘাম বেরোয়।
এটা যে আদপে তাঁর সমস্যা সেটা প্রথমে বুঝতে পারেন নি। ভেবেছেন ওধারের বদ প্রতিবেশী স্টোভ জ্বালিয়ে রান্না করে ধোঁয়া পাঠাচ্ছে এধারে। বাড়িতে এর আগে বলেছেন বহুবার। কেউ গা করেনি। বউ এর বারোমাস সর্দি-কাশি, হাঁপের টান। তার গন্ধ পাবার কথাও নয়। মেয়ে শুনেছে। সে বলেছে, ‘কিসের গন্ধ? তোমার সবেতেই গন্ধ। মায়ের জন্য বডি স্প্রে ছেড়েছি, বডি অয়েল ছেড়েছি, ক্রীমটাও ভয়ে ভয়ে মাখি, এখন তুমি যদি ভাবো আমি কেরোসিন শুঁকে নেশা করছি তাহলে টমিকাকাকে খবর দেব, এসে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।’
অবিনাশ বাড়িতে আর কথা বাড়ান নি। মামাতো ভাই টমি ওরফে তমোনাশের কথা ভেবেছেন, সে ডাক্তার, এখনো পড়া শেষ হয়নি যদিও, তবু সিনিয়রদের গুনে গুনে দশ না হোক সাত গোল দেবেই, তাকে বলবো বলবো করেও খুলে বলা হয়নি, হিন্টস দিয়ে চেপে গেছেন, ভুলক্রমে মায়ের কানে পৌঁছে গেলে ‘কি, কেন, কবে, কোথায়, কখন’এর অন্তহীন চক্রব্যূহতে ফেঁসে যাবেন। অগত্যা পাড়ার নাক, কান, গলার ডাক্তার দেখাবেন ভাবলেন।
দেখালেন।
এখানে মনমতো সমাধান পাওয়া গেল না। ভেবেছিলেন ডাক্তার বাবু ভয়াবহ কিছু বলবেন, বদলে মাছি তাড়াবার মতো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন ‘করোনা এফেক্ট।’ অবিনাশ ভাবলেন করোনা চলে গেছে সেই কবে, এতদিন পরে হঠাৎ করে কেরোসিনের গন্ধ কেন? গন্ধের ঝাঁঝে রীতিমত চোখ জ্বালা করে, জল আসে। রাত তিনটেয় ঘুম ভাঙলে গন্ধ, ভোর পাঁচটায় জল বিয়োগ করতে গেলে গন্ধ! তার সাথে মাথা ধরা। যেন নেকড়ের থাবা মাথায়। ওলাফ্যাকটরি নাকি ওলফ্যাকটরি কিসব নার্ভ আছে, তাতে কোথাও টিউমার হয়ে বসে আছে নাকি তাই বা কে জানে! বাড়িতে টিউমার জটিল হয়ে পরপারে গেছেন বড় পিসি আর বাবা। কাকা সময় থাকতে কাটিয়েছে।
এত কথা অবশ্য ডাক্তারকে বলা যায়নি। তিনি চল্লিশ সেকেন্ড নাকি এক মিনিটের মধ্যে নাম ধাম বয়স এবং ওষুধ লিখে দিলেন। ন্যাজ়াল স্প্রে এবং নার্ভের ওষুধ।
অবিনাশ কাষ্ঠহাসির সাথে পাঁচশো টাকা দর্শনী দিয়ে বেরিয়ে এসে ঠিক করলেন ঐ নার্ভের ওষুধ মোটেও খাবেন না। মেয়ের টিউশন থাকে সাড়ে নটা দশটা পর্যন্ত, ওষুধ খেলে বাড়ি এসে খাওয়া দাওয়া সেরেই ঘুমিয়ে পড়তে হবে! তাহলে যে খানকতক গ্রুপের অ্যাডমিন হয়ে আছেন সেসব অনাথ হয়ে যাবে। গ্রুপ মেনটেন করা একটা আর্ট। খুঁজে খুঁজে একদম আনকোরা সুপ্রভাত আর শুভরাত্রি সবাই দিতে পারে নাকি? তারপর ঐ ‘ছড়াকার’ গ্রুপে ছন্দ মিলিয়ে কথোপকথন? ‘উই আর ফ্যামিলি’ , ‘স্কুল বাডিজ়’, গ্যাংস অফ মুকুন্দপুর’, ‘ওনলি মেন’ এ অবিনাশ না থাকলে অন্ধকার। নার্ভের ওষুধ খেয়ে ঝিমোলে চলবে না। দুমাস পরে বরং এম আর আই করিয়ে নেবেন।
এদিকে মাসখানেক স্প্রে নিয়ে খুব একটা লাভ কিছু হয়না। বরং মাথা ধরা বেড়ে যায়।
বউ এখন লক্ষ্য করে। বলে, ‘মাথা ধরেছে তো বাইরে থেকে হেঁটে এসো, কোষ্ঠবদ্ধ রুগীর মতো মুখ করে থেকোনা!’ কখনো বলে, ‘নাক আছে তাই গন্ধ পাচ্ছ, আমাকে দ্যাখো চব্বিশ ঘণ্টা নাক বন্ধ, পাঁঠার ঝোলের গন্ধটাও ঠিক মতো পেলাম না! এ আবার কি বেঁচে থাকা!’
অবিনাশ গভীর ভাবে ভাবেন। আগডুম বাগডুম ভাবনা। ভাবেন সারাজীবন নেশা ভাঙ করলেন না, তাঁর কিনা এমন বিদঘুটে রোগ! রোগ বলা যাবে কি না আদৌ সেটাও বলা যাচ্ছে না। চাকরি পাওয়ার পর বিড়ি সিগারেট টেনেছিলেন বটে, তবে সেটা নেশা নয়, ইচ্ছে। ছোটবেলায় মা স্টোভ নেভালে একটা নীলচে ধোঁয়া হতো, সেই গন্ধটা বেশ ভালো ছিল, খুব শুঁকতেন, মা বললেও রান্না ঘর থেকে নড়তেন না, তাহলে কি সেই ‘সিন’এ আজ কেরোসিন? কে জানে! ভাবেন স্কুল বাডিজ় এর মিথিলেশকে ফোন করবেন। মিথিলেশের আজকাল বেশ নাম ডাক হয়েছে। শহরের বাইরে থেকে রুগী আসে দেখাতে। অ্যালোপ্যাথি বন্ধ রেখে একটু হোমিওর সিমপ্যাথি নেবেন ঠিক করেন।
মিথিলেশকে ওর চেম্বারে বেশ ডাক্তার ডাক্তার মনে হয়। অন্যসময় যাকে হাফ পেন্টুল পরা সহপাঠী ছাড়া কিছু ভাবেন না। তার কাছে সমস্যা খুলে অবিনাশ বলেন, ‘ভাই, মনে আছে, আমাদের কুয়োয় বালতি পড়ে গেলে তোদের বাড়ি থেকে কাঁটা নিয়ে আসতাম? সেই কাঁটা এখন আমার মাথায় বসে থাকে। কিছু একটা উপায় কর! এই গন্ধ আর মাথা ধরা আর সহ্য হয় না!’
মিথিলেশ মনোযোগ দিয়ে সব শোনে। প্রশ্ন করে টুকটাক। খাবারের পছন্দ বদলেছে কি না, টক ঝাল মিষ্টি নোনতার কোনোটা আগের চেয়ে ভালো লাগছে কি না, স্ক্রিন টাইম, ঘুম কেমন, দুঃশ্চিন্তা হয় কি না, দাম্পত্যের রসায়ন ইত্যাদি। এখানেও দুমাসের ওষুধ। দু রকমের। আপাতনিরীহ সাদা গুঁড়োর পুরিয়া। স্প্রের বদলে শোঁকার জন্য জলবৎ তরলং ঝাঁঝালো দ্রবণ। সেও বলে করোনা পরবর্তী নানান উপসর্গের কথা। এবং আশ্বাস দেয়।
হপ্তা তিনেক হলো ওষুধ শুঁকছেন অবিনাশ। মাথা ব্যথা বন্ধ না হওয়ায় মাথার ছবি করা হয়েছে। আশার কথা এখানে নিরেট মাথার ছবিই এসেছে, গোবরটুকুও নেই। তবে একটু ভুল হয়েছে। দুমাস ধরে যে পুরিয়া খাবার কথা সেগুলো পরপর এবেলা ওবেলা খেয়ে ফেলেছেন। মিথিলেশকে ভয়ের চোটে কিছু জানানো হয়নি। কেরোসিনের গন্ধ বন্ধ হয়ে অবিনাশ এখন মাঝে মাঝে বাসন্তী পোলাও আর বিরিয়ানীর গন্ধ পাচ্ছেন। সাধারণ ডাল ভাতের জীবনে এইই বা মন্দ কি!
অবিনাশ বাবুকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। গন্ধনাশ হলো কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে পাঠক যোগাযোগ করতেই পারেন।