T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় পাভেল ঘোষ

টেলিপ্যাথি

 

ছুটি বলে ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরী হয়ে গেলো। নাক মুখ কুঁচকে এক চোখে তাকিয়ে দেখি আটটা দশ। বয়স যত বাড়ছে, কুঁড়ে হচ্ছি তত। বুঝতে পারছি বেশ।
গিন্নি অনেক আগেই কোটা শেষ করার মত মশারি তুলে বিছানাটা পরিপাটি করে গুছিয়ে দিয়ে গেছে। একটা পরিষ্কার ঘরে ঝাঁট দেওয়া আবর্জনার মত বিছানায় পড়ে আছি। একটা বড় হাই তুলে উঠলাম বিছানা থেকে। সারাটা দিন কোনো কাজ নেই। করবোই বা কি..?
হঠাৎ বাসিমুখে একটা আইডিয়া মাথায় এল বিদ্যুতের ঝিলিকের মত। দুপুরের দমকা হাওয়ার মতো এক চিলতে হাসিও খেলে গেলো মুখে।
ব্রাশ করে চা ,টিফিন খেয়ে আমার প্রাচীন আলমারিটার সামনে বসলাম। চাকরি পেয়েই কিনেছিলাম ছোট্ট আলমারিটা। একযুগ আগে..! গুহা শব্দটার মধ্যে একটা পুরাতনী ভাব আছে বলে আলমারিটার নাম সাধ করেই রেখেছিলাম গুহা।
কলেজ জীবনের দামাল কিছু বন্ধুর সাথে আমার ব্রণমুখের ছবির অ্যালবাম, পুরোনো ডায়রিতে যৌবনের শুরুতে উগড়ে ওঠা বমির মত কিছু প্রেমের কবিতা,পুরোনো বন্ধুদের ঠিকানা এবং এস. টি. ডি.নম্বর সহ কিছু ফোন নম্বর পুরোনো নথির মত সাজিয়ে রেখেছিলাম ওই আলমারিতে।
আলমারি খুলে জীর্ণ সুতোয় বাঁধা একটা ফাইলের মধ্য থেকে হলুদ হয়ে যাওয়া ছোট্ট নোট বুকটা বের করলাম সযত্নে। জীর্ণ , রুগ্ন, বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া পাতাগুলোয় অক্ষররা যেন জীবাশ্মের মত কলেজ জীবনের সাক্ষ্য বহন করছে। এই নোটবুকটা কলেজ জীবনের শেষ দিনের পড়ন্ত বিকেলের প্রতিচ্ছবি।
মনে পড়ে গেল, আমরা সবাই সেদিন আড্ডা মেরে ছিলাম গুরুদার ক্যান্টিনে। চলে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে চোখের জলকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রত্যেককে এগিয়ে দিয়েছিলাম সদ্য কেনা অ্যাড্রেস বুকটা। প্রত্যেকে পকেট থেকে পেন বের করে লিখে দিয়েছিল নিজের বাসভূমির ঠিকানা। তারপর কেটে গেছে বহু বছর। হয়তোবা বন্ধুরা এই পৃথিবীতেই নিয়েছে অন্য কোনোখানে ঠাঁই। সেটা জানার আর অবকাশ হয়ে ওঠেনি। আবেগকে ওইখানেই ফেলে রেখে যে যার ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে নিজের মত করে।
চোখটা আটকে গেল নোট বইটার তিন নম্বর পাতায়। বিক্রম বোস। বাড়ি কলকাতার রামগড়। চোখ বুজে কিছুক্ষন ভাবতেই মনে পড়ে গেলো মুখটা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ছোট ছোট জ্যাকি চ্যানের মত চোখ। চুলটা মেলে দেওয়া কাপড়ের মত কপালে নেমে আসলেই বাম হাত দিয়ে সরিয়ে দিত বারবার। একটা জামা দিন তিনেকের আগে খুলতো না। আমরা বিষয়টা তুলতেই বলতো, “ইয়ে বিক্রমকা আপনা স্টাইল হ্যায়..! মত টোকো ইয়ার..!” অস্পষ্ট আলোর মত লেখার নীচে লাল কালিতে ফোন নম্বরটা যত্ন করে লেখা। 033-2536659। মাথাটা চুলকে নিলাম কয়েকবার। কি করছে বিক্রম, কে জানে..?
কত শত শত সোনালী মুহূর্তরা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় আমাদের। পুরনো স্মৃতি হলো হলুদাভ আলোয় ঘেরা ঝিমঝিমে সন্ধ্যার মত । এক হারিয়ে যাওয়া রূপকথার জগৎ। আসতেই ইচ্ছে করে না। হুঁশ এলো গিন্নির কথায়।
“শূন্যের জায়গায় নয় দিয়ে ফোন করে দেখো, বন্ধুকে পেলেও পেতে পারো..”
ওর আইডিয়াটা মনে ধরলো না। অ্যান্টেনা থেকে স্মার্ট টিভি পেরিয়ে প্রযুক্তির অনেকটাই শিখরে পৌঁছেছি আজ। কত পরিবর্তন..! আর সেখানে সংখ্যার পরিবর্তন হবে না…? কি যে বলে আমার অর্ধাঙ্গিনী..! ওর কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বললাম, “তোমার মাথায় উদ্ভট যত চিন্তা..!
“আরে বাবা..! করেই দেখো না..! হতেও তো পারে।”
একটু জোরের সঙ্গে গিন্নি বলতেই থতমত খেলাম একটু। আমাদের মত পতিদেবরা তো এমনই হয়।
প্রথমে মৃদু প্রতিবাদ, তারপর নুনের কাছে জোঁকের মত আত্মসমর্পণ।
আমতা আমতা করে বললাম, “দেখছি..! ঠিকই বলেছো। ফোনটা আনোতো..”
ও ফোনটা আনতেই মিষ্টি সুরে বললাম, “তুমি ডায়াল করো, আমি নম্বরগুলো বলে যাচ্ছি।”
ও স্ক্রিনে নয় টিপতেই দিয়ে আমি বামহাতি বিক্রমের সযত্নে লেখা নম্বরগুলো বলতে লাগলাম, “তিন.. তিন..”
ওইপ্রান্তে হ্যালো বলতেই গিন্নি আমার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো, “হ্যালো বলছে…, নাও ধরো!”
আমি ফোনটা হাতে নিয়েই আবেগে একটু তারস্বরে বলে উঠলাম, “হ্যালো..! বিক্রম..?”
“ইয়েস, বিক্রম বোস স্পিকিং…”
“ব্যাটা…! পেয়েছি..!”
“কি সব বলছেন..? কে আপনি..?”
“শালা, তোর যম। বাঁদর..! কেমন আছিস..?”
“নামটা বলুন…! সেই থেকে যম, বাঁদর এসব বলে যাচ্ছেন।” অপর প্রান্ত থেকে বিক্রমের বিরক্তিভরা কণ্ঠ কানে পৌঁছতেই পাশে বসা গিন্নি একটা জোর ঠ্যালা দিলো আমায়।
“আরে…নিজের নামটা তো বলো…!” গিন্নির ধ্যাতানিতে কাজ হলো। আসলে আবেগের বশে নামটাই বলা হয় নি। ঠিক তো..! এজন্যই প্রত্যেকের বিয়ে করা উচিৎ। আমাদের মত বাঁকা মানুষদের সোজা করতে গিন্নিকুলদের জুড়ি নেই। ধাতস্থ হলাম একটু। বললাম,
“ওরে, আমি অনিরুদ্ধ। অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য। চিনতে পারছিস..! আশুতোষ কলেজ। নাইন্টি থ্রি পাস আউট।”
“বোকা…*, হারামজাদা.! খচ্চর….! কোথায় ছিলি এতক্ষণ..?” বিক্রমের চাঁচাছোলা ভাষায় গাল শুনে আশ্বস্ত হলাম ও আমায় চিনেছে।
শুরু হলো কথা বলা, শুরু হলো আবার পথ চলা। একে অপরের ত্রিশ বছরের সুখ দুঃখের ঝরা সময়ের আখ্যান শেষ করতে সময় লাগলো বেশ কিছুক্ষন। এত সময় ধরে কথা বলেছি কারোর সঙ্গে, মনে পড়ে না আমার। যখন ফোনটা রাখলাম,ঘড়িতে তখন বেলা একটা দশ। বড্ড বেলা হয়ে গেছে। ফোনটা কান থেকে সদ্য সরিয়েছি,গিন্নির টিপ্পনী কানে এলো, “একদিনেই সব ভুলে গেলে, আর দুচারদিন গেলে তো আমাকেই ভুলে যাবে।”
“তোমাকে ভুলি কি করে.! কানেকশনটা তো তুমিই করে দিলে..। তাই না..?” দুবেলা খাওয়া, বিছানা করা একদম টাইম টু টাইম পাই, তাই তেল প্রতিদিন দিতে হয় এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে। বউ একটু খুশিই হলো। ওর মুখ দেখে বুঝে নিতে অসুবিধা হলো না আমার।
“ছাড়ো..। বন্ধুর খবর কিছু পেলে..?”
“আর বোলো না, ও তো আমার শহরেই থাকে। বছর দুয়েক বদলি হয়ে এসেছে। আগে মেদনিপুরে ছিল। রাজ্য সরকারের বড় অফিসার, জানো..? আমার মত ছাপোষা মাষ্টার নয়..!”
“অমন বোলো না। তুমিই বা কম কিসে? ফিবছর কত ছেলে মানুষ হয় তোমার কাছে..! বললে হবে?”
গিন্নির এই গুনটাকে আমি এপ্রিশিয়েট না করে পারি না। ও বোঝে,পারস্পরিক তৈল মর্দন এই সম্পর্কের ভিত্তি। একুশ বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক কি আর এমনি টিকে আছে..?
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
“ঠিকই বলেছো। মানুষ হয়…, তবে মান- হুঁশ ছাড়া।”
****

পরের দিন সকাল…
“লাল নটে শাক, মুগ ডাল,ঝিরি ঝিরি আলু ভাজা, শুক্ত,পাবদা মাছের ঝাল, পাঁঠার মাংস আর শেষ পাতে চাটনি।”
বাজার থেকে ফিরে গিন্নিকে পদগুলো বলতেই ও তো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। গরম তেলে যেন ফোড়ন দিলাম আমি।
“আজ তুমি রান্না করবে, আর আমি তোমায় যোগান দেবো..”
গলায় যেন সর্ষে বাটার ঝাঁঝ। বাপরে..!
কোন কালে সেই ছাত্রাবস্থায় মেসে রান্না করেছি চাপে পড়ে। তারপর তো রান্নাঘরে ঢুকিই না আমি , পাছে আবার খুন্তি নাড়তে হয়..! বিক্রমের জন্য আবার আমাকে…!
আমার কাচুমাচু মুখ দেখে মনে হয়,গিন্নির একটু মায়ার উদ্রেক হলো।
“মুখটা এমন ব্যাজার করে আছো কেন..? ও মোলো যা..! ছাড়ো, তোমায় কিছু করতে হবে না। শুধু সামনের সপ্তাহে দিন তিনেকের জন্য বাপের বাড়ি যাবো। তখন না হয়…”
গিন্নির কথা শুনে ভাবলাম, এইসময় তো শিবের মত কাছা খুলে বর দিই। তারপর না হয় ম্যানেজ করা যাবে।
“আলবাত যাবে..। কেন যাবে না..? সত্যিই তো,কতদিন যাওনি।”
আমি বত্রিশ পাটি বের করে বললাম। ভুল বললাম। ম্যানেজ করলাম।

কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সাড়ে বারোটায় বিক্রম এলো। তবে একাই।
“কী রে..! বউ কোথায়..?”
আমি জিজ্ঞাসা করতেই ও একরাশ বিরক্তি মুখে নিয়ে বললো,”সংসার করছিস, আর বউ নামক প্রাণীদের কথা জানিস না। ওদের শালা কখন মুড অন হয়, আর কখন মুড অফ হয় একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন..! সকালেও বললো, যাবো। তারপর হঠাৎ আসার আগে…”
হঠাৎ কথা বলতে বলতে মাঝখানে থেমে জিভ বার করলো বিক্রম।
বুঝলাম, পিছনে গিন্নিকে ও দেখতে পেয়েছে।
“শিবের আর কালী হতে হবে না। আসুন। আপনারা বউদের বদনাম না করে সকালে ব্রাশ করেন না..! সামনে বলার তো মুরোদ নেই..।”
“কান মূলছি। সাক্ষাতে বলবেন না যেন।”
আমার অফিসার বন্ধূর অসহায় আত্মসমর্পণ দেখে আশ্বস্ত হলাম, ওর থেকে আমি কিঞ্চিৎ ভালো আছি..!
ডাইনিং টেবিলে মধ্যাহ্নভোজে গল্প শুরু হলো।
পাবদা মাছের মাথাটা বিক্রম মুখে ঢুকিয়েছে ,ঠিক সেই মুহুর্তে আমার সাবালক হওয়া পুত্র বাড়ি ঢুকলো।
বিক্রয় খেতে খেতে ভ্রু নাচিয়ে বললো, “পুত্র মনে হচ্ছে,..! বাবা..! কি লম্বা আর হ্যান্ডসাম হয়েছে রে।”
আমি ফিসফিস করে বললাম, “শালা, হতচ্ছাড়া, হাড়মাস জ্বালিয়ে খেলো মাইরি। ছেলের বাপ হওয়ার যে কি জ্বালা, তুইতো জানিস না। তুইতো মেয়ের আদরের বাপি। তুই কি বুঝবি ভাই..?”
আমি হতাশা চেপে রাখতে না পেরে উগড়ে দিলাম দুঃখ। বমির মত। একটু হালকা হলাম।
“অমন করে বলিস না..! সমস্যাটা কী..?”
“সমস্যা একটাই..! পড়াশোনা করে না। দিন রাত মুঠোফোন হাতে নিয়ে পড়ে আছে। বললেই বলে,চিন্তা কোরো না, আমি এনাফ পড়ছি..।”
“হ্যাঁ রে অনি, তোর ছেলে প্রেমে পড়ে নি তো..? না, মানে.., অন্যভাবে নিস না। বয়সটাতো খারাপ। তাই বলছিলাম আর কি..!”
সে আর কি করে জানবো বল..!
“তা অবশ্য ঠিক..!” বিজ্ঞের মত বললো বিক্রম। কলেজ জীবনে দেখেছি, সবসময় ও মেয়েদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতো। মলয় ওকে ঠাট্টা করে তাই বলতো, “কলির কেষ্ট..”!’
দেখে হিংসাও হতো খুব। ফেকলুর মত দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আমাদের কিছু করার থাকতো না।।
“আর একটু ভাত দিই আপনাকে..”
গিন্নির কথায় থালায় ফিরলাম।
“আমাকে বলছো..?”
“কোথায় থাকো তুমি..? আমি তোমাকে আপনি বলবো..?”
বুঝলাম,ছেলের চিন্তায় সব গুলিয়ে গেছে।
বিক্রম আমার দিকে তাকিয়ে সেটা বুঝেই বললো,
“ছেলে তোর কী নিয়ে পড়ছে এখন অনি..?”
“ফিজিক্সে অনার্স,সেকেন্ড ইয়ার।”
“বাঃ..! ভালো তো রে..!
“ধুর.! ওর কী সম্ভাবনা ছিল জানিস.?”
“তুই যাই বল, দেখবি ও ভবিষ্যতে একটা ভালো জায়গায় যাবে।”
“দেখা যাক ভাই…! ”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেই গিন্নি একগাল হেসে বললো, “মানুষটা কতদিন পর এসেছে,ছেলেকে ছেড়ে নিজেদের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে গল্প করবে কোথায় তা নয়..”
“একদম ঠিক বলেছেন..!” বিক্রম চাটনির আমের পিসটা মুখে তুলে বললো।
“আপনার ছেলে মেয়ে ক’টি..?”
“আমার একটিই সন্তান। রুচিস্মিতা। ভূগোলে অনার্স করছে উইমেন্স কলেজে। ফার্স্ট ইয়ার।”
বেশ গর্বের সাথেই গিন্নির প্রশ্নের উত্তরে বললো বিক্রম।
“মেয়ে বলে বেঁচে গেছিস ভাই। আমার মত টেনশনতো খেতে হয় না..”
“তা যা বলেছিস। তোর ছেলের কথা শুনে আমার তো এখন তাই মনে হচ্ছে অনিরুদ্ধ। ”
দইয়ের শেষ অংশটুকু পেটে চালান করে বললো বিক্রম।
****

মাস খানেকের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে লতার মত জাপটে ধরলাম আমি। প্রায় প্রতি রবিবার আমাদের আড্ডা বসতে থাকলো। কখনো বিক্রমের বাড়িতে, আবার কখনো আমার বাড়িতে। দেশ ও দশের আলোচনার সাথে অবশ্যম্ভাবীভাবেই সেইসব আড্ডায় এসে যেত আমাদের ছেলে বা মেয়েদের ভবিষ্যত প্রসঙ্গ।
এমনই এক রবিবারে বিক্রমের বাড়িতে এক নির্ভেজাল আড্ডায় আমিই তুললাম প্রসঙ্গটা।
“বুঝলি বিক্রম, ছেলে আমার নির্ঘাত কোথাও প্রেম করছে..!”
“কি করে বুঝলি..? নিজের কলেজবেলার সঙ্গে মেলাচ্ছিলিস মনে হচ্ছে।”
“না রে ভাই,পঁচিশ বছর ধরে মাস্টারি করছি। ছেলে মেয়েদের মতি গতি হাতের তালুর মত মুখস্থ হয়ে গেছে।”
আমার কথা শেষ হতেই ঘরে ঢুকলো বিক্রমের মেয়ে। বিক্রম আলাপ করাতেই প্রনাম করে মুখ নীচু করে সামনে বসে পড়তেই জিজ্ঞাসা করলাম , “তোমার নাম কী..?”
“রুচিস্মতা। কাকু, তুমি আমাকে তুই বললেই ভালো লাগবে…”
আহা..! দেখেই আমার মন জুড়িয়ে গেল। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, আমার যদি এমন একটা মেয়ে থাকতো..! খুব শান্ত,লাজুক প্রকৃতির মেয়ে বিক্রমের। বেশ, একটা লক্ষীশ্রী ভাব আছে চেহারার মধ্যে। আর আমার ছেলেকে দেখো.! দিন রাত মুঠোফোনে..! কী যে রাজকার্য করে, কে জানে..। রক্তচাপ আমার ওর চিন্তাতেই রকেটের মত মহাশূন্যে ছুটছে,নামার কোনো লক্ষণ নেই।

হঠাৎ মুঠোফোনে চোখ রেখে চীৎকার করে বলে উঠলো বিক্রম, “ইউরেকা..”
চমকে উঠলাম আমি।
ওর কাঁধে হাত রেখে সুমিষ্ট কণ্ঠেই জিজ্ঞাসা করলাম, কি হলো বিক্রম..? এই বয়সে কাকে খুঁজে পেলি?
কিন্তু উত্তরে বিক্রম যা বললো, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
“একান্ত ব্যক্তিগত রে..”
বুঝলাম, বন্ধুদেরও একটা কোথাও থমকে দাড়ানোর সীমা আছে।
কিছুদিনের মধ্যেই একটা খারাপ খবরে মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো । বিক্রম হঠাৎ ট্রান্সফার নিয়ে জলপাইগুড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। খবরটা পেয়েই ফোন করলাম ওকে।
“বিক্রম, শুনলাম জলপাইগুড়ি চলে যাচ্ছিস। যাওয়ার আগে একবার বাড়ি আসবি না..?”
“না রে…। সময় পাবো না..”
হঠাৎ পাল্টে যাওয়া কণ্ঠের পূর্বাভাস অনুভব করেও নির্লজ্জের মতোই বললাম,”তাহলে আমি যাবো তোর সঙ্গে দেখা করতে…?”
উত্তর পেলাম অত্যন্ত সংযত ও শীতল কণ্ঠে।
“নারে.. তোর আর আসার প্রয়োজন নেই। আমিই তোকে ফোন করে ডেকে নেবো।”

+++++++++++++

কিন্তু প্রায় বছর চারেক পেরিয়ে গেলো। বিক্রমের ফোন কিন্তু এলো না। মাঝে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। পুত্র রাতুল গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে একটা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরী নিয়েছে।
এত বছর শিক্ষকতা করছি, কত ছাত্রকে ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক,অধ্যাপক হতে দেখেছি…! মেধা আর অধ্যবসায়কে কাজে লাগিয়ে কিভাবে শীর্ষে পৌঁছতে হয়; তার শত সহস্র উদাহরণ চোখের সামনে উজ্জ্বল হতে দেখেছি..! অথচ রাতুলের যে কী হলো..! ওর মেধা ছিল, কিন্তু কাজে লাগালো কই..? ভাবলেই শিশিরবিন্দুর মত জলকণা চোখের কোনে চলে আসে আমার।
রক্তচাপ বেশ কিছুদিন ধরেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না। তাই বেশ কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়েছি বিশ্রাম নেবো বলে।
ছুটির মাঝে এমনই এক বিষণ্ণ দুপুর ছিল সেদিন। সকালে উঠেই রাতুল বেরিয়ে পড়েছে কাজে। ঘড়ির বড় কাঁটাটা সদ্য বারো ঘর অতিক্রম করেছে। গিন্নী মঞ্জরীর কঠোর আদেশে ডাইনিং টেবিলে এক বাটি সবজি আর মাছের ঝোল নিয়ে ভাত খেতে বসেছি।
এক দলা মুখে নিয়ে আমিই তুললাম কথাটা।
“বিক্রম হঠাৎ যে এমন পাল্টে যাবে, ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি আমি। কিন্তু কলেজ জীবনে ও এমন ছিল না। প্রত্যেকের বিপদে সবার আগে ও ঝাঁপিয়ে পড়তো। বিশ্বাস করো…”
“তোমার বন্ধুর তখন বিক্রম ছিল না…!
এখন বিক্রমদার পরাক্রম এসেছে, আর তার হাত ধরে এসেছে অহংকার। কী…? ঠিক বলছি..?”
মঞ্জরীর কথাটা ফেলতে পারলাম না আমি। হঠাৎ করেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই পাল্টে গেলো ছেলেটা। কারণটা কী..? রহস্যটা এই চার বছরেও পরিষ্কার হলো না আমার কাছে।
হঠাৎ বাইকের চেনা শব্দে সম্বিৎ ফিরলো আমার। রাতুলের এনফিল্ডের আওয়াজটা কানে সয়ে গেছে। কিন্তু এত সাত তাড়াতাড়ি ওর তো আসার কথা নয়..?
ঘরে ঢুকতেই জিজ্ঞাসা করলাম রাতুলকে, “কী ব্যাপার..? আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলি..?”
“সবুর করো বাবা..! সব জানতে পারবে…!”
ছেলে মুচকি হেসে উত্তর দিলো। সকল দুঃখ, অভিমান ভুলে যাই পুত্রের এমন হাসি হাসি আনন্দ মুখ দেখলে। মনের সব আবর্জনা যেন বিলীন হয়ে যায় আনন্দ মোহনায়।
“আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে…” রিংটোনটা বাজতেই নিজের জগতে ফিরে এলাম।
“মাঝে মাঝে এমন ক্যাবলা হয়ে যাও না তুমি। নাও ধরো ফোনটা। তোমার প্রাণের বন্ধুর তোমাকে মনে পড়েছে,..!”
গিন্নী যেন তেলে ফোড়ন দিল। বাপরে ঝাঁঝ..!
স্ক্রিনে চোখ যেতেই দেখি, “বিক্রম কলিং..”
শালা..! গান্ডু..! এতদিনে মনে পড়লো। একটা অব্যক্ত আনন্দও অনুভব করলাম। শেষ মুহুর্তে
মান অভিমান ভুলে ধরলাম ফোনটা।
“হ্যালো.. বিক্রম বোস বলছি।”
“ওরে শালা…! চার বছর পর ফোন করলি। তাও আবার ঘ্যাম নিচ্ছিস..!”
“অনিরুদ্ধ, আমায় বাঁচা ভাই…”
“আমি তোকে বাঁচাবো..! কিন্তু কি করে..?
“কাল সন্ধ্যা থেকে রুচি মিসিং…! আর মাত্র সাতদিন পর ওর বিয়ে।”
“তাই নাকি..? কিন্তু কোথায় গেল তোর মেয়ে..?”
“সেটা তো তুই ভালো বলতে পারবি।”
“আমি..? কি যাতা বলছিস..?”
“তোর ছেলে তোদের মদতে আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে..”
“রাতুল ..! কিডন্যাপ..!”
“শোন অনিরুদ্ধ, আমার কত বড় হাত তুই জানিস না…”
এবার বিক্রমের ভিতরের পশুটা জাগছে বুঝতে পারলাম। উচ্চ রক্তচাপের পেশেন্ট আমি। মাথা গরমে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। তাই শত মাথা গরম করা পরিস্থিতিতেও নিজেকে ধোনির মত হিমশীতল রাখি।
“তোর হাত লম্বা আমি জানি।সে ঠিক আছে। কিন্তু রাতুল আর রুচিস্মিতার মধ্যে যে সম্পর্ক আছে, এই ব্যাপারে তুই নিশ্চিত হচ্ছিস কি করে..?”
“আরে, এটা আমি চার বছর আগেই জানি। তাই তো জরুরী ট্রান্সফার নিয়ে চলে এসেছিলাম এখানে। তুই আর তোর বউ তখন
না জানার ভান করে থাকতিস। কি…..? ঠিক বলছি..?”
ছেলের পড়াশোনা না হওয়ার পিছনে কারনটা এতদিনে বুঝলাম। রুচিস্মিতার উপর মনে মনে রাগও হলো। এতদিনের অব্যক্ত যন্ত্রণার কারন ওই মেয়েটা…!
“কি রে..? শুনতে পাচ্ছিস..?”
হুঁশ ফিরল বিক্রমের কণ্ঠে।
“বল..!”
“ভালো চাস তো মেয়ে তোদের ওখানে গেলে পাঠিয়ে দিস। ওর বিয়ের কার্ড পর্যন্ত ছাপা হয়ে গেছে…”
রীতিমত হুমকি দিয়ে লাইনটা কেটে দিল বিক্রম।
কানটা ভো ভো করছে। বাপরে..! বন্ধু তো নয় যেন বন্দুক।
পাশে বসে নির্বিকার চিত্তে এতক্ষন শুনছিল গিন্নী। তারপর এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে আমায় বললো, “কি বললো তোমার বন্ধু ? ”
আমি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবিস্তারে বলে শেষে যোগ করলাম, “বিক্রমের মেয়ের জন্যই রাতুলের পড়াশোনার বারোটা বেজেছে। খুব রাগ ধরছে মেয়েটার উপর.…..”
“আর তোমার ছেলে বুঝি ধোয়া তুলসী পাতা..?”
“তা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছো..। ওসব ছাড়ো..। মেয়েটা গেল কোথায়, সেটাই তো চিন্তা হচ্ছে।”
“তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করো। ওই বলতে পারবে…”
মঞ্জরী হাসিমুখে বলল আমাকে।
হঠাৎ একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন আসতেই রাতুল বললো, “বাবা ফোনটা ধরো..”
রিসিভ করতেই একটা সুমিষ্ট কণ্ঠ কানে এলো।
“কাকু, আমি রুচিস্মিতা। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। রাতুলকে ফোন করেছিলাম । ও বলল, আমি বাড়ি নেই। তুমি বাবাকে ফোন করো…”
“রাতুল বাড়িতেই আছে। ও তোমায় মিথ্যে বলেছে.. ”
ফোনটা রাখতেই দেখি, আমার সামনে পুত্র কান ধরে দাঁড়িয়ে । এই দৃশ্য দেখে আনন্দে চোখে জল এলো আমার । কোনরকমে সামলে একগাল হেসে বললাম , “যা হতচ্ছাড়া…! নিয়ে আয় ওকে। সারারাত বেচারি জার্নি করে এসেছে…”
রাতুল যেতেই আবার ফোনটা বেজে উঠলো।দেখি, বিক্রম ফোন করেছে আবার।
আমি হ্যালো বলতেই বিক্রম বলে উঠলো,
“কি রে গান্ডু…! আমাকে নিতে আসবি না..? আমিও যে গেটের বাইরে। ”
“ফাজলামো মারিস না..! ভুলভাল না বকে ফোনটা রাখ।”
“খুব রেগে গেছিস, বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করবো বল..? মেয়ের জিদের কাছে হার মানলাম…..!”
“মাঝে তাহলে নাটক করলি যে বড়..!”
“আজ তারিখটা ভুলে গেলি…! পয়লা এপ্রিল। তোকে ফুল বানানোর আদর্শ দিন…”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।