ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব – ৬)

তীর্থ ভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

দশম শতকে মহীপাল পশ্চিমবঙ্গ অধিকার করেন। দন্ডভুক্তিরাজ ধর্মপাল ও অপরমন্দারের অধিপতি রণশূরকে রাজেন্দ্র চোল পরাজিত করার ফলে উত্তররাঢ় অধিকৃত হয়।
বীরভূম জেলার পাইকর গ্রামের অনতি দূরে ননগড় নামে এক বিরাট দীঘি রাজা মহীপালের স্মৃতি ধরে রেখেছে। জনশ্রুতি আছে, নয়পালের সঙ্গে গ্রামটির যোগাযোগ ছিল। একাদশ শতকে মহীপাল এর পুত্র নয়পালের সময়ে কলচুরিরাজ
গাঙ্গেয় দেবের পুত্র কর্ণ উত্তররাঢ় আক্রমণ করেন। বীরভূমের পাইকরে কর্ণের শিলালিপি বর্তমান। বীরভূমের মিত্রপুরে রয়েছে সন্তান-সন্ধির স্মৃতি। মহামন্ডলিক ঈশ্বর ঘোষ ঢেক্করীতে রাজধানী স্থাপন করে একটি স্বাধীন রাজ্য পরিচালনা করেন। বীরভূমের জয়দেব কেন্দুলির কাছে লাউসেনগড় বা গড় জঙ্গল ঢেক্করী নামে পরিচিত।
জৈন আচার্য বংশীয় এবং চন্দ্র বংশীয় ব্রহ্ম ক্ষত্রিয় সেনগণ উত্তর রাঢ়ের সেনভূম পরগনায় দীর্ঘকাল বাস করেছিলেন। এই বংশের উন্নতির পরিচয়বাহী সেনভূমের পাশে সামন্তভূম রয়েছি সামন্ত সেনের নামে।তাঁর পুত্র হেমন্ত সেন রাঢ়দেশে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন।
কৌলিন্য প্রথার সংস্কারের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত , যাগযজ্ঞ শাস্ত্রচর্চা সমাজ সংস্কারে স্মরণীয় কীর্তির অধিকারী বল্লাল সেন ১১৫৮ অব্দে রাজ্যাভরোহণ করেন।তাঁর পরে তাঁর পুত্র
লক্ষণ সেন ১১৭৯ সিংহাসনে আরোহণ করেন।
কৈশোরে তিনি গৌড়েশ্বর কে পরাজিত করেন বলে সেন রাজগণ তাঁর সময়ে গৌড়াধিপতি হন।
লক্ষণ সেনের নামে বীরভূমের বর্তমান রাজনগরের নাম হয় লক্ষণ নগর বা লখনোর।।
গোপভূমি অধিকার করে কেন্দুলি সেনপাহাড়ী গড়ে তাঁর রাজধানী এবং শ্রীক্ষেত্র,কাশী ও প্রয়াগে সমর জয় স্তম্ভ স্থাপন করেন। যুদ্ধবিদ্যা ও ধর্মচর্চায় তাঁর সমান অধিকার ছিল। শেষ বয়সে লক্ষণ সেন বৈষ্ণব ধর্ম অবলম্বন করেন।
সেন যুগের বিষ্ণু মূর্তি রাঢ়ের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে আছে আজও। নবদ্বীপে তিনি বাণপ্রস্থ গ্রহণ করেন। রাজ্যে অভ্যন্তরীণ বিপ্লবের সূচনায় তুরস্ক সেনা কৌশলে গৌড় জয় করে।
বীরভূমের রাজনগর বা নগরে তাঁর শাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
নির্গ্রন্থ নাথ সম্প্রদায় মহাবীরের জন্মের অনেক আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং “জৈন ধর্ম নাথ ধর্মেরই পল্লবিত রূপ”। জৈন সম্প্রদায়ের প্রাচীনতর নাম নির্গ্রন্থ মহাবীরের অভিধা নাম ছিল নিগন্থ-নাথপুত্ত। যে লিচ্ছবি ক্ষত্রিয় কূলে মহাবীরের জন্ম, তার নাম ছিল নাথ বা নাত।
কূর্মগ্রামে হঠযোগী বেসয়নের অবস্থিতি থেকে বোঝা যায়, ২৬০০ বছর আগে এখানে নাথ ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং বীরভূমের নন্দীগ্রামে বোধহয় বিশিষ্ট কেন্দ্র ছিল। এই ধারার বাহক কিরাত বা অবৈদিক আদি আর্যগোষ্ঠী বোধহয় আজীবিক -তান্ত্রিক ধর্মের সাধক ছিলেন। কোপাই নদীর তীরে কাঞ্চীশ্বর শিব,রুরু ভৈরব সমাবৃত কঙ্কালীতলার পীঠস্থান সম্ভবত এদের প্রধান কেন্দ্র ছিল।
ডঃ অমলেন্দু মিত্র মহাশয়ের ‘রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্ম ঠাকুর গ্রন্থে’ বীরভূমের ধর্ম পূজার পরিচয় রয়েছে। দ্রাবিড়গণ ছিলেন লিঙ্গ মূর্তি শিবের পূজক। খ্রিস্ট জন্মের বহু আগে থেকেই রাঢ় দেশে জৈনভূমি ছিল, তার অনেক প্রমাণ ছড়িয়ে আছে বীরভূমে মাটিতে। বীরভূমের বারা ও প্রান্তিক গ্রামগুলিতে সম্ভবত কিরাত বাণ রাজাদের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং অষ্টম শতকে তা প্রবল হয়।
সেন যুগে ধর্ম সংস্কৃতির মোড় ফেরে এবং পঞ্চোপাসক জয়দেবের আবির্ভাব ঘটে। চৈতন্যদেবের পূর্বেই বহিরঙ্গীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের আবির্ভাব এবং শাক্তপীঠ ও উপ পীঠের মতোই ৬১ টি বৈষ্ণব শ্রীপাটের প্রতিষ্ঠা হয়।আইরিয়ানার আদি আর্যগোষ্ঠীর শক্তিশালী সমন্বয়ের ফলে নিষাদদের ধর্ম-থান, দ্রাবিড়দের শিব আরাধনার স্থান, কিরাতদের শক্তিপূজার কেন্দ্র, বিপ্লবের আখড়া গুলি কালক্রমে বৃষ বাহন শিব এবং সিংহ বাহিনী দুর্গা স্থানে সর্বজনীন রূপে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে।
কিরাত ধর্মের উৎকর্ষ আর্য সমাজে প্রচারিত হলে তারা দেবীর প্রতিষ্ঠা হয় তারাপুরে।
ফুল্লরা অট্টহাস এর শাঁমাপীঠে নিষাদ সংস্কৃতির
এবং শৈব সুরথের শিব প্রতিষ্ঠা ও ভগবতী কে লক্ষ বলি প্রদানের কাহিনীতে আছে দ্রাবিড় কিরাত সংস্কৃতি সমন্বয়ের ইঙ্গিত।কিরাত মল্লদের গ্রাম বীরভূমের মল্লারপুরে মল্লেশ্বর শিব সিদ্ধনাথের শিবপাহাড়ী পরিমণ্ডলে “শিবালিক পাহাড়ে” প্রাগৈতিহাসিক যুগের পরিচয় আত্মগোপন করে আছে।
আদিতে সারা বীরভূম জুড়ে অস্ট্রিক জনগণের বসবাস ছিল। তারপর সেনভূমে দ্রাবিড় গন এসে পান্ড্র ভূমিতে বসবাস করতে শুরু করেন।
অন্তত এক হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এদেশে কিরাত জনগণের আবির্ভাব হয়।তাঁরা উত্তর বীরভূম জুড়ে বাস করতেন।
পরে এখানে প্রাগার্য ও আর্য বৈদিক ব্রাহ্মণগণের আগমন ঘটে পর্বে পর্বে। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই আর্যগণ বিভিন্ন ধারায় এখানে আসতে শুরু করেন। মহাভারতের কাহিনী বিভিন্ন স্থানে রামসিতার উপস্থিতি আর্য সভ্যতার বিস্তার ও আর্যীকরণের ইঙ্গিত দেয়।
অতি প্রাচীনকালে গৌড় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে বীরভূমের সীমা নির্দিষ্ট ছিল না। সমগ্র বীরভূমি অধিকৃত স্থানে কোন কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে সামন্ত রাজগন নিয়মিত করদানে শাসন অধিকার লাভ করতেন।
‌গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সমস্ত রাজাগণ স্বাধীনভাবে রাজত্ব করলেও গৌড়েশ্বর কে রাজ চক্রবর্তী রূপে স্বীকার করতেন এবং প্রয়োজনে রাজ্য বিস্তারের কাজে গৌড়েশ্বর কে সাহায্য করতেন।
বীরভূমের বিভিন্ন স্থানে মন্দির স্থাপনে এই সমস্ত সামন্ত রাজাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।