ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজ আমেরিকার ডায়েরি || সুব্রত সরকার – ৭

আমেরিকার ডায়েরি – ৭
।। ১৫ অগাস্ট, বৃহস্পতিবার। বিদায় বস্টন।।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল, আজ ১৫ অগাস্ট! আমাদের স্বাধীনতা দিবস। জয় হিন্দ! বন্দেমাতরম! দেশ থেকে বহুদূরের এক মহাদেশে রয়েছি। ৭৭ তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সব অনুষ্ঠান থেকে অনেকদূরে আমি। দেশে এখন ১৫ অগাস্টের বিকেল। আমেরিকার সাথে আমাদের কমবেশি সাড়ে ন’ ঘন্টা সময়ের হেরফের হয়। আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস জুলাই ৪। সেদিন এদেশেও উদযাপন করে ওদের- Independence Day।
মোবাইল খুলে দেখলাম সবুজ পাঠের শিশুদের স্বাধীনতা দিবস পালনের সুন্দর সুন্দর ছবিগুলো এসে গেছে। আজ সকালে আমাদের দুটো স্কুলেই দিদিদিমণিরা কি সুন্দর করে পালন করেছে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান এবং সেই সব ছবি আমাকে পাঠিয়েও দিয়েছে। এ আমার বড় আনন্দ। পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন “অন্যভুবন- সবুজ পাঠ”আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। আমাদের দিদিমণিরা বড় আন্তরিক ভাবে আমার সাথে এই যোগাযোগ রেখে চলে।তাই ওদের ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
গত কয়েকদিন ধরে আমেরিকার নানাপ্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছি। নতুন নতুন কত কি দেখা হলো। সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতা হলো অনেক। এই বিশ্বভ্রমণের আনন্দের মধ্যেও বিষাদের গুড়ো এসে ছড়িয়ে পড়েছে বারংবার যখনই কলকাতার সাম্প্রতিক খবরগুলো শুনতে পেয়েছি। এতদূরে আছি যে প্রতিমুহূর্তের সব খবর জানতে পারছি না। তবু আর জি কর কান্ডের যতটুকু জেনেছি, খুব বেদনাদায়ক সে সব খবর। মন খারাপ হয়ে গেছে। সোহম ডুলুং আমি তিনজনেই কষ্ট পেয়েছি। নাগরিক সমাজের এই আন্দোলনের সাথে একাত্মবোধ করেছি। সবার মত আমরাও চাই, এর ন্যায় বিচার। দোষীর দৃষ্টান্তমূলক চরম শাস্তি।
এই জঘন্য অপরাধ পৃথিবীর প্রাচীনতম অপরাধ। অথচ আজও ঘটে চলেছে! আমরা পারলাম না, এই সব কামুক লোলুপ হত্যাকারীদের অপরাধ থেকে দূরে সরিয়ে আনতে। জানি না আরও কতটা পথ আমাদের হাঁটতে হবে এই শুভচেতনার পথে অপরাধপ্রবণ কামুক খুনীদের ফিরিয়ে আনতে! তাই আজও যেন জীবনানন্দের কবিতা আমাদের উচ্চারিত করে যেতে হচ্ছে, “সুচেতনা, এপথেই আলো জ্বেলে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে, সে অনেক শতাব্দীর, মনীষীর কাজ!…”
।। বল্টিমোর এর পথে….।।
আজও আমাদের এক লংজার্নি। বস্টন থেকে বল্টিমোর প্রায় আট ন’ঘন্টার সড়ক সফর। তাই একটু তাড়াতাড়ি যাত্রা শুরু করব। হোটেলের কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিলাম। বুফে ব্রেকফাস্ট। দুধ, কর্ণফ্লেক্স, পাউরুটি, বাটার, ওমলেট, তিন চার রকমের টাটকা ফল, কেক, চকলেট, ফ্রুটজুস, চা, কফি। যে যার পছন্দমত খেয়ে নাও। ডাইনিং হলে সুন্দর করে সব সাজানো। আমাদের মত অনেক পর্যটকবন্ধুরাও তাঁদের পরিবার সহ চলে এসেছেন। বেশ একটা কমিউনিটি ফিলিং হচ্ছিল এই ব্রেকফাস্ট করতে এসে।
সকালের এই ব্রেকফাস্ট একটু বেশিই করে নিলাম। Lunch করতে দেরী হলেও অসুবিধা হবে না। তাই পেট ভরে ব্রেকফাস্ট করলাম। এই অতি ব্রেকফাস্ট এর একটা সুন্দর নাম হলো – BRUNCH।
হোটেল LA QUINTA থেকে বেরিয়ে পড়লাম সাড়ে ন’টায়। বস্টন শহর দিয়ে এগিয়ে চললাম। শেষবারের মত দেখে নিচ্ছি শহরটাকে। একটু মন কেমন করছিল শহরটাকে গুডবাই করে চলে যেতে। দুটো রাত এই শহরে কাটালাম, কত সুন্দর স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। এই দু’দিনেই কেমন একাত্মবোধ হয়ে গিয়েছে। বড় ভালো লেগেছে বস্টনকে।
বস্টন শহর ছেড়ে বেরিয়ে একটু একটু করে কানেটিকাট, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, নেওয়ার্ক ওয়াশিংটন ব্রিজ, ডেলাওয়্যার পেরিয়ে এগিয়ে চললাম। ডেলাওয়্যার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন এর জন্মস্থান। বাইডেন পড়াশোনা করেছেন সিরাকিউজ ইউনিভার্সিটিতে। আজ হাইওয়েতে প্রচুর গাড়ি। ফলে কোথাও কোথাও জ্যামে আটকে পড়তে হয়েছে।
হাইওয়ের কথা ও বর্ণনা আগের লেখাগুলোয় রয়েছে। আমেরিকান হাইওয়ে সত্যিই সুন্দর। এবং তার দু’পাশের দৃশ্য, নিসর্গ এবং জনপদ একটু একইরকম মনে হলেও, দেখতে দেখতে যেতে খারাপ লাগে না। তাই অনায়াসে ছ, সাত, আটঘন্টা জার্নিগুলো করা যায়।
হাইওয়েতে ওদের ট্রাকগুলো দেখে বেশ ভালো লাগে। মাল পরিবহনের জন্য এই ট্রাকগুলো দুর্দান্ত। দেখতেও ভীষণ স্মার্ট। আর একটা গাড়ি দেখেছি হাইওয়েতে খুব চলে, ক্যারাভ্যান এর মত। ওরা বলে RV (Recreational Vehicle), আমেরিকানরা পরিবার সহ লাগেজ নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খুব মুভ করে। তাই এই বিশেষ ধরনের গাড়ি বারবার চোখে পড়েছে।
আজ প্রায় ন’ ঘন্টার এই লম্বা সফর শেষ করে আমরা বল্টিমোর এসে যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে সাতটা বেজে গেছে। অচেনা শহরে হোটেল খুঁজে পেতে একটু দেরী হলো। এই শহরটা কেমন যেন নিঝুম, নির্জন লাগল। রাতের রাস্তাঘাটও আলো আঁধারিতে ভরা। তবে কোথাও কোথাও দলবেঁধে লোকজন গল্প করছে। দেখলাম তারা সব কালো আমেরিকান।
বল্টিমোরে আমরা তিনরাত্রি থাকব। হোটেল বুক করাই ছিল। শুধু খুঁজে পেতে একটু সময় লাগল। বল্টিমোর ডাউনটাউনের পাশেই বেশ শান্ত সুন্দর এক পাড়া Park Avenue তে আমাদের হোটেল। নাম- BREXTON। এই হোটেল একটি ঐতিহ্যশালী গ্রুপের হোটেল। তাই তার দেওয়ালে দেখলাম খোদাই করা রয়েছে- Historic Hotels of America। এই পাড়ায় কালো আমেরিকান মানুষজনদের বসবাস বেশি। সমস্ত বাড়ি ঘর ইটের পরে ইট দিয়ে সাজানো। খুব সুন্দর স্থাপত্য। রাস্তাঘাট চওড়া ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।
হোটেলের ম্যানেজার একজন কালো আমেরিকান যুবক। খুব হাসিখুশি। আমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছি। এবং শহর কলকাতা শুনে বলল, “ও! মাদার টেরেসা!..”
হোটেলটা খুব বড় নয়। চারতলা। কিন্তু খুব ডেকোরেটিভ। আমাদের একটা ফোর বেডেড রুম দেওয়া হল তিনতলায়। সুন্দর রুম। এখানেও চব্বিশ ঘন্টা চা কফি ফ্রি। এবং কমপ্লিমেন্টারিটি ব্রেকফাস্ট। রুম রেন্ট পড়ল তিনদিনের জন্য ৪৭৬ ডলার। ভারতীয় টাকায় ৩৯,৫০০/ টাকা!..
ক্লান্ত শরীর। এবার একটু বিশ্রাম চাই। গরম কফি খেতে খেতে আগামীকালের বেড়ানোর পরিকল্পনা করে নিলাম। বল্টিমোর থেকে আমরা দু’জায়গায় ওয়ান ডে ট্রিপ করব। একদিন ওয়াশিংটন ডিসি। অন্যদিন ওশান সিটি (মেরিল্যান্ড) ।
আবহাওয়া ফোরকাস্টিং দেখে নিয়ে ঠিক হল আমরা আগামীকাল ওয়াশিংটন ডিসি যাব। আমেরিকার রাজধানী শহর। কত বড় বড় সব জিনিস আছে দেখার। এতদিন বইতে পড়েছি, লোকমুখে শুনেছি সে সবের নাম। আগামীকাল নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হবে।
কাল সারাদিন ওয়াশিংটন ডিসি দেখে ফিরে আসব বল্টিমোরের এই হোটেলেই। পরেরদিন যাব Ocean City।
ডিনারের অর্ডার সোহম দিয়ে দিল অনলাইনে। আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আমি আমার পাড়া প্রতিবেশী এক দাদা, হরিসাধন ব্যানার্জীর সাথে একটু কথা বলে নিলাম হোয়াটসঅ্যাপ কলে। দাদা এখন ওয়াশিংটন ডিসিতে মেয়ের কাছে আছেন। পুজোর আগে বাড়ি ফিরবেন। দাদার কাছ থেকে কিছু টিপস্ নিয়ে নিলাম ওয়াশিংটন ডিসির।
ডিনারে এলো মেডিটেরিয়ান ফুড- GYRO। প্রায় প্রতিদিনই এই সব ফাস্ট ফুডগুলো খেতে খেতে সত্যিই মনে হচ্ছিল, আবার কবে একটু ডাল ভাত আলুপোস্ত খেতে পারব কে জানে!…
খাওয়া শেষ করে আর রাত করলাম না। চোখের পাতায় ঘুম এসে অপেক্ষা করছে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম নরম বিছানায়। মনের জলতরঙ্গে তখন হেমন্তের গান, “দিনের শেষে, ঘুমের দেশে, ঘোমটা-পরা ওই ছায়া, ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ…”
।। ১৬ অগাস্ট। ওয়ান ডে ওয়াশিংটন ডিসি।।
ওয়াশিংটন ডিসি আমেরিকার রাজধানী শহর। স্বভাবতই তার একটা গাম্ভীর্য, গৌরব ও জৌলুষ থাকবে। আমরা ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম উবের বুক করে। আজ ওয়াশিংটন ডিসি সারাদিন ঘুরে দেখব বলে নিজেদের গাড়ি আনি নি। কারণ গাড়ি পার্কিংয়ের ঝামেলা অনেক। তাই উবের করে আসা যাওয়া করব ঠিক করে চলে এসেছি।
বল্টিমোর থেকে কমবেশি দেড়ঘন্টা ড্রাইভ লাগল ওয়াশিংটন ডিসিতে পৌঁছাতে। শহরের রাস্তা ঘাট দেখতে দেখতে এলাম। খুব সুন্দর লাগছিল শহরটাকে। আজ বেশ ঝলমলে রোদ্দুর বাইরে।
এই রাজধানী শহরে দেখার মত বহু জিনিস আছে। মিউজিয়াম আছে অনেকগুলো। সুন্দর সুন্দর পার্ক আছে। আমেরিকার বিখ্যাত ব্যাক্তিদের নামে উৎসর্গ করা স্মৃতিসৌধ আছে। নদী আছে। চিড়িয়াখানা আছে। আর্ট গ্যালারি আছে। কিন্তু এত সব তো আর একদিনে দেখে নেওয়া সম্ভব নয়। এলাম দেখলাম চললাম- এভাবে তো আর ভ্রমণ হয় না!..ভালো করে দেখার জন্য সময় দিতে হবে, অর্থ ব্যয় করতে হবে, শারীরিক পরিশ্রম করে দেখতে হবে- তবেই না হবে সার্থক ভ্রমণ।
আমরা তাই বাছাই করা ভ্রমণের শরণাপন্ন হলাম। যেগুলো একদিনের ভ্রমণে ভালো করে দেখে নেওয়া সম্ভব। এই ভ্রমণ সার্কিটের নাম হলো- CAPITOL EXPRESS TOUR। এটি খুব জনপ্রিয় একটা ভ্রমণ সূচী।
এই সূচিতে রয়েছে – US CAPITOL, WASHINGTON MONUMENT, THE WHITE HOUSE, SUPREME COURT, JEFFERSON MEMORIAL, MARTIN LUTHER KING JUNIOR MEMORIAL, LINCOLN MEMORIAL, VIETNAM MEMORIAL, WORLD WAR 2 MEMORIAL, KOREAN WAR MEMORIAL।
এই টুরটা আমেরিকান টুরিজম এর গাড়িতে করেও করা যায়। কিন্তু আমরা পায়ে পায়ে শহরটা দেখব, ঘুরব ভেবে নিজেরাই শুরু করলাম একটা একটা করে জিনিস দেখা। ডুলুং সোহম সঙ্গে থাকায় খুব সুবিধা হয়েছে। ওরা সব সময় মোবাইলে জিপিএস দেখে নিচ্ছে, আর পৌঁছেও যাচ্ছি সুন্দর সে সব জায়গায়।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর মূর্তি ও সৌধ দেখে শুরু করলাম ওয়াশিংটন ডিসি র ওয়ানডে টুর। এই স্মৃতিসৌধ চমৎকার এক জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে। সামনে বিস্তৃত জলরাশি। নির্জন পরিচ্ছন্ন জায়গা। এক সুবিশাল পাথরের ভাঁজে মার্টিন লুথার জুনিয়র কিং এর প্রাণবন্ত পাথুরে মূর্তি। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র একজন আফ্রিকান- আমেরিকান মানবাধিকার কর্মী ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৫ জানুয়ারি, ১৯২৯ সালে। আমেরিকায় নাগরিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান। ইতিহাসের এই হল নির্মম বিচার!..
এরপর ভিয়েতনাম মেমোরিয়াল, কোরিয়ান ওয়ার মেমোরিয়াল দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম ওয়াশিংটন মনুমেন্ট এর দিকে। সবুজ গালিচার মত ঘাসজমির ওপর দিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে পৌঁছে গেলাম ওয়াশিংটন মনুমেন্ট এর কাছে। এই মনুমেন্ট বহুদূর থেকে দেখা যায়।
আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটনের নামে এই স্মৃতিসৌধ। এর উচ্চতা ৫৫৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। স্মৃতিস্তম্ভটি মিশরীয় ওবেলিস্কের মত দেখতে। প্রায় ১০৬ একর সবুজ ঘাসজমি নিয়ে ছড়ানো এই সুন্দর স্মৃতি উদ্যান। এর চারপাশ আমেরিকার ৫০ টি রাজ্যের প্রতিনিধিত্বকারী পতাকা দিয়ে সাজানো। ১৮৮৫ সালে এই মনুমেন্ট সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। দেশ বিদেশের বহু পর্যটক এখানে আসেন প্রতিবছর। এই মনুমেন্টের ভেতরে লিফ্টে করে একদম ওপরে গিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির চারপাশকে পাখির চোখে নাকি অপূর্ব দেখা যায়। এই টিকিটের খুব ডিমান্ড। আমরা পৌঁছে টিকিট পাই নি। তাই এই মনুমেন্টের উচ্চতায় উঠে দেখা হয় নি ওয়াশিংটন ডিসির চারপাশের সৌন্দর্য।
World War -2 Memorial ওয়াশিংটন মনুমেন্ট থেকে পায়ে হেঁটে সামান্য পথ। সবুজ ঘাস জমিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম আমরা তিনজন। রোদ ঝলমল দিন। কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছিল না।
এই ওয়ার মেমোরিয়াল ২ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার সৈন্য ও যে সকল সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন, সেই সব শহীদদের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গীত। ২০০৪ সালের ২৯ এপ্রিল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এই ওয়ার মেমোরিয়াল। এখানে প্রবেশ পথের দু’ধারে দুই বিশাল গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। একটি হল আটলান্টিক, অপরটি প্যাসিফিক। আর সাথে যুক্ত হয়েছে পর পর ৫৬ টি গ্রানাইট পিলার। এই পিলারগুলোতে আমেরিকার ৫০ টি রাজ্য ও ৬ টি অঙ্গরাজ্যের নাম খোদাই করা আছে। সাধারণ মানুষের জন্য এটি জলের ফোয়ারা ও ফুলের বাগান দিয়ে সাজিয়ে রাখা রয়েছে। আমেরিকানদের কাছে এটি একটি পবিত্র স্থল। বহু পর্যটক এসেছেন।
আমরাও ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ভালো লাগল এই ওয়ার মেমোরিয়াল দর্শন করে।
ওয়ার মেমোরিয়াল ২ দর্শন করে একটু এগিয়ে গিয়েই পেলাম লিঙ্কন মেমোরিয়াল। ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, ওয়ার মেমোরিয়াল ২ এবং লিঙ্কন মেমোরিয়াল – এই তিন স্থাপত্য একদম এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। বহদূর থেকেও সুন্দর লাগে দেখতে। লিঙ্কন মেমোরিয়ালে কিছু সংস্কারের কাজ চলছে। তাই জায়গাটা একটু অগোছালো হয়ে রয়েছে। এখানে লিঙ্কনের শ্বেত পাথরের মূর্তিটা অসাধারণ।
আব্রাহাম লিংকন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ তম রাষ্ট্রপ্রতি। ১৮৬১- ১৮৬৫ ছিল তাঁর চার বছরের উজ্জ্বল রাজত্বকাল। ১৮৬৩ সালে লিংকন দাস প্রথার বিলোপ করেন। লিংকন এর বহূ ভাষণ ও তাঁর উজ্জ্বল উক্তিগুলো আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ” গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার”- Democracy for the People, by the people, of the People। এবং তাঁর লেখা সেই বিখ্যাত চিঠি, তিনি তাঁর পুত্রের শিক্ষককে পাঠিয়েছিলেন। সে চিঠির সার কথাগুলো আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
এই তিন বিখ্যাত জিনিস দেখে এবার আমরা চললাম US CAPITOL ও WHITE HOUSE দেখতে। পথ বেশি নয়। আমরা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই এই পথটুকুর জন্য উবের নিয়ে চলে গেলাম।
প্রথমেই পেলাম হোয়াইট হাউস। যা দেখার জন্য সত্যি মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা ছিল। হোয়াইট হাউসের সামনের রাস্তায় আমেরিকান সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে। একদম কুচকুচে কালো পোশাক পড়া আমেরিকান পুলিশদের দেখতে বেশ স্মার্ট লাগে। কিন্তু আশ্চর্য ওরা কেউই তেমন কঠোর- কঠিন নয়। বেশ খোলামেলা জায়গাটা। আমি তো ভেবেছিলাম, হোয়াইট হাউস মানেই বাড়াবাড়ি রকমের সিকিউরিটি চেক হবে। দেখলাম প্রায় জিরো সিকিউরিটি চেক। দিব্যি ঘুরে বেড়ানো যায়। ছবি তোলা যায়। তবে একদম ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য বিশেষ অনুমতি প্রয়োজন। আমরা দূর থেকেই দেখলাম। ছবি তুললাম। হোয়াইট হাউসের তো একটা সৌন্দর্য থাকবেই। কিন্তু সেটা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মত নয়। বিশাল বিরাটও নয় হোয়াইট হাউস। আর সবচেয়ে যেটা দেখে অবাক হলাম, হোয়াইট হাউসের সামনে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ – আন্দোলন করা যায়। তেমন অনেক প্রতিবাদের পোস্টার নিয়ে বসে রয়েছেন বহু প্রতিবাদী। এমন অনেক পোস্টার দেখলাম- Welcome to Free Speech Zone, STOP The Genocide- FREE PALESTINE, STOP CHINA’S UYGHUR GENOCIDE, Recognize EAST TURKISTAN, CHINA GET OUT OF EAST TURKISTAN, I Was born free And Equal And All Humans Should Treater the same way… প্রতিবাদীরা বসে আছেন এমন সব পোস্টার নিয়ে, চোখে মুখে তাঁদের প্রত্যয় ও চাঁপা ক্রোধ।
হোয়াইট হাউসের ফুটপাতে স্ট্রিট সিঙ্গার মাইক্রোফোন বাজিয়ে গান গেয়ে ডলার উপার্জন করছেন এবং এও দেখলাম, হোয়াইট হাউসের রেলিং ধরে ভিক্ষা চাইছে অনেক দুঃস্থ গরীব আমেরিকান! তারা সত্যিই ভিখিরি। পুলিশ কয়েকহাত দূরেই রয়েছে। কিন্তু তাঁরা খুব উদার। হাসি ঠাট্টা করে নিজেদের নিয়ে সময় কাটাচ্ছে। এটা আমেরিকা বলেই সম্ভব, উদার গণতন্ত্রের দেশ বলে শুনেছি, আজ প্রত্যক্ষ করলাম। আমাদের দেশ হলে পার্লামেন্টের সামনে বা রাষ্ট্রপ্রতির বাড়ির সামনে এমন পোস্টার ধরা প্রতিবাদীদের বসে থাকা বা গরীব ভিখিরিদের ভিক্ষা করার অনুমতি নিশ্চয়ই দেওয়া হতো না!..
আমেরিকান ক্যাপিটল ও সুপ্রিম কোর্ট পাশাপাশি দুই বিশাল সুন্দর স্থাপত্য দেখলাম। ছবি তুললাম। দেশ বিদেশের বহু পর্যটক এসেছে। দুটো জায়গাতেই সুন্দর ফুলের বাগান রয়েছে।
মোটামুটি ওয়াশিংটন ডিসির এই সব দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেল। শরীর এবার একটু বিশ্রাম চাইছে। হেভি লাঞ্চ কিছু হয় নি। কিছু খাওয়া দরকার। আমরা ঠিক করলাম আর শহরে থাকব না, শহর থেকে একটু দূরে চলে গিয়ে নদী বন্দরের কাছে বসে খাওয়াদাওয়া করব। রেস্ট নেব।
তাই চলে এলাম উবের নিয়ে বল্টিমোর ইনার হারবারে। বড় সুন্দর এই ইনার হারবার। বল্টিমোর শহরটাকেও দেখা হলো। রেস্টুরেন্ট Chick-Fil-A বসে খেলাম চিকেন বার্গার। তারপর বাইরে এসে DUNKIN DONUTS থেকে কোল্ড কফি হাতে নিয়ে ইনার হারবারের সুন্দর জলরাশির কাছে এসে বসলাম। একটা সন্ধে অপূর্ব কাটালাম এখানে। বন্দরে কত জাহাজ ভিড় করে আছে। ক্রুজ করানোর লাক্সারি লঞ্চগুলো দাঁড়িয়ে আছে। সিগাল পাখির মত পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। এই বন্দরে এসে হঠাৎ করে আলাপ হয়ে গেল এক বাঙালি পরিবারের সাথে। বেহালা-শকুন্তলা পার্কে বাড়ি। মা- মেয়ে -বাবা তিনজন হাঁটছিল বন্দরের পথে। ওদের মেয়ে মেরিল্যান্ড মেডিকেল কলেজে রিসার্চ করছে। এদেশে রয়েছে পাঁচ বছর হয়ে গেল। ওর বিষয় জানলাম- করোনা ভাইরাস। মেয়েটি খুব হাসি-খুশি। মা -বাবা ওর কাছে রয়েছে চার মাস ধরে। আমি মাত্র ৪২ দিন থাকব শুনে বলল, “আঙ্কেল টিকিট রিসিডিউল করে নাও। আরও কয়েক মাস থাকো এদেশে।…” এরপরও কিছু কথা গল্প হলো আমাদের। প্রবাসে নিজের শহরের নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার মত মানুষ পেয়ে গিয়ে হঠাৎ দু’পক্ষই বেশ প্রাণ খুলে গল্প করে নিলাম।
বিকেল ঝলমল করছে। সন্ধ্যা এখানে নামে বড় মন্থর গতিতে। ঘড়িতে বাজে সাতটা। আকাশের সূর্যকে দেখে মনে হয় না ক্লান্ত। আমরা ক্লান্ত। অনেকক্ষণ জলের ধারে বসে তিনজনে গল্প করলাম। একসময় বললাম, “তোরা গল্প কর। আমি একটু হেঁটে আসি।” বন্দরের পথে হাঁটতে হাঁটতে একা হয়ে গেলাম।
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…” নিছকই মনে এল জীবনানন্দ। এই জীবনটাকে নিয়ে আনন্দ করে, ভালো করে বাঁচার জন্য একটা জন্ম যেন বড় কম! মানুষের আয়ু আর কত!..তাই এই বিপুলা পৃথিবীর কত কিছু রয়ে যাবে অদেখা। এই ধরিত্রীর কত কিছু রয়ে যাবে অচেনা!.. সত্যি পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে, হে মহাজীবন, তুমি আমাকে এমনই একটা মুসাফির মন ও জীবন দিও। বাকি থেকে যাওয়া এই ধরণীর ধন সম্পদগুলো দু’চোখ ভরে দেখব। শুধু দেখে যাওয়ার মত একটু বাড়তি সময় দিও! কিছুটা তখন আবার দেখব!..
সূর্য ডুবে গেল বল্টিমোরের আকাশে! আটলান্টিকের জলে তার ছায়া পড়ে এল। কিন্তু ঝুপ করে আঁধার হল না শহর। ঘড়িতে দেখলাম ৮.১০।
এবার ফিরে যাওয়ার পালা হোটেলের পথে।
আগামীকাল নতুন পথে, নতুন ভ্রমণে যাব।..
সেও এক অপরূপ সুন্দর শহর মেরিল্যান্ডের Ocean City!..
আজ হয়তো ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখব, ডাকছে আটলান্টিকের জল!.. আয় আয়…!..
শুভ সন্ধ্যা। বল্টিমোর।
Valoi