ক্যাফে ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজে সুব্রত সরকার (পর্ব – ৬)

হিমালয়ের নীল স্বর্গ  – দেওরিয়াতাল

নিশীথ রাতের অন্ধকারে রঘুবীর সিং নেগির গাড়ি পাহাড়ী পাকদণ্ডীতে ছুটছে। পথের দু’পাশে ঘন জঙ্গল। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছে  দু’একটা দোকান।  জনপদ। গাড়ি দুরন্ত গতিতেই পাহাড়ের বাঁকগুলোকে পেরিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে। একটু যে ভয় করছে না, তা মোটেই নয়। প্রাণ হাতে করেই যেন এই রাতের পাহাড়ি পথে চোপতা থেকে প্রায় কুড়ি কিমি দূরের সারিগ্রামে চলেছি চার বন্ধু।

কিন্তু এভাবে আমাদের দেওরিয়াতাল যাওয়ার কথা ছিল না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সফরসূচী বদল করতেই হল। নিরুপায় হয়ে রঘুবীর সিংকে দূরভাষে জানালাম, ” ভাইয়া, চোপতা মে কোহি রুম মিলতা নেহি। চারধাম কে লিয়ে জাদা টুরিস্ট আয়া। আপকা সারি মে আজ রুম মিলেগা?”

রঘুবীর সিং ফোনে এই আর্তনাদ শোনামাত্রই অভয় দিয়ে বললেন, “ভাইয়া, ঘাবড়াও মত্। ঘর মিল যায়গা। আপনারা অপেক্ষা করুন। আমি উখিমঠে এসেছি। একটু পরেই যাচ্ছি।”

একেই বলে বোধহয়, পরিত্রাতা!..সে রাতে রঘুবীর সিংকে আমাদের মনে হয়েছিল সাক্ষাৎ দেবদূত! একজন গুড সামারিটান!..

রঘুবীর সিং নেগির বাড়ি সারি গ্রামে। কথা ছিল আমরা তুঙ্গনাথ হয়ে দেওরিয়াতাল যাব।সারি গ্রামে রঘুবীরের সাদামাটা হোম স্টেতে দু’ রাত থেকে দেওরিয়াতাল ঘুরব। কিন্তু চারধামের এমনই মাহাত্ম্য যে চারগুণ পর্যটক চলে এসেছে গাড়োয়াল হিমালয়ে। তাই ছোট্ট একটুকরো জায়গা চোপতায় মানুষে মানুষে কিলবিল করছে। আর সেই সুযোগে ঘর ভাড়াও চারগুণ বাড়িয়ে হাঁকছে ব্যবসায়ীরা। আমাদের তখন পালাতে পারলে বাঁচি অবস্থা। তুঙ্গনাথজীকে দর্শন পরে হবে!..

সত্যিই শেষ পর্যন্ত  চোপতা থেকে পালিয়েই আমরা সারি গ্রামে চলে এলাম। এবং এসে যে কি শান্তি, কি আনন্দ পেলাম, তা ভাবলে আজও আনন্দ হয়।

সারি খুব ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। উখিমঠ থেকে  ১৬ কিমি দূরত্বে প্রায় ২৪৫০ মিটার উচ্চতায় হিমালয়ের কোলে এই সারিগ্রাম। সারির উল্টোদিকের উপত্যকায় মক্কু মঠ। শীতকালে তুঙ্গনাথজীকে এখানে নামিয়ে এনে পুজো করা হয়। সারিতে জন্মাষ্টমীতে একদিনের মেলা হয়।  নবরাত্রি ও নন্দাদেবীর উৎসব ধুমধাম করে পালিত হয়।

সারি থেকে দেওরিয়াতাল ট্রেক করে যেতে সময় লাগে খুব বেশি হলে ঘন্টা দুয়েক। প্রায় তিন কিমি চড়াই উৎরাই পথ । খুব কষ্টকর ট্রেক নয়। বেশ ধীরে সুস্থে গল্প করতে করতে দেওরিয়াতাল পৌঁছে যাওয়া যায়। যাওয়ার এই রাস্তাটুকু চমৎকার। বাঁকে বাঁকে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া অনেক সুন্দর সুন্দর দৃশ্য অপেক্ষা করে থাকে পর্যটকদের জন্য। শুধু একটু দেখার ইচ্ছে ও চোখ থাকতে হবে। তাহলেই ভ্রমণ সার্থক!

সারিগ্রাম থেকে দেওরিয়াতালে ট্রেক শুরু করার মুখেই পরে একটা তোরণ। স্বাগত দেওরিয়াতাল। এই তোরণের পাশেই কয়েকটা ঘোড়া নিয়ে ছোট্ট এক আস্তাবল। চাইলে ঘোড়ার পিঠে সওয়ারী হয়েও পৌঁছে যাওয়া যায় সেই নীল স্বর্গের প্রাঙ্গনে- যেখানে রয়েছে অপরুপ এক হ্রদ। যার শ্যাওলা সবুজ জলে চৌখাম্বার ছায়া আল্পনা এঁকে দেয় ঝকঝকে আকাশ থাকলে।

আমরা হাঁটা শুরু করে সামান্য পথ ভেঙে ওপরে উঠে এসেই পেয়ে গেলাম এক মন্দির- ওঁঙ্কার রত্নেশ্বর মহাদেবের মন্দির। স্লেট পাথরে বাঁধানো এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসতে কোনও অসুবিধাই হয় না। পথের দুধারে অনেক গাছ। দেওদার, ওক, রডোড্রেনডন, ফার, ম্যাপল ও কমলালেবুর গাছও আছে।  এই সব গাছেদের  ছায়ায় ঢাকা পথে হাঁটতে বেশ লাগে। অবিরত পাখিদের গানও শোনা যায়। শিস দিয়ে দিয়ে লুকিয়ে পড়া পাখিরা আছে অনেক এই পাহাড়ে-জঙ্গলে।

প্রায় ২৪৩৮ মিটার, ৭৯৯৯ ফুট উচ্চতায় পৌঁছে দেওরিয়াতালের কাছে এসে হারিয়ে গেলাম আনন্দে। কি অপূর্ব, কি অসাধারণ এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে এই শ্যাওলা সবুজ শান্ত হ্রদ। আজ উজ্জ্বল ঝলমলে সকাল। চৌখাম্বায় রোদ ঠিকরে পড়ে হ্রদের জলে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করেছে। যা দেখে শুধু মুগ্ধ হতে হয়। নির্বাক আনন্দে নীরব হয়ে যেতে হয়।

সূর্যোদয় দেখার সুযোগ হয় নি। কিন্তু সূর্যের ঝকঝকে আলোয়  দেওরিয়াতালের চারপাশকে দেখে বিমোহিত হয়ে গেলাম সকলে।  বিখ্যাত বিখ্যাত শৃঙ্গগুলো চৌখাম্বা, মন্দানি, সুমেরু, কেদারনাথ চোখের সামনে ঝলমল করে যেন হাসছে, আমাদের ভ্রমণ পিয়াসী মন মুগ্ধ নয়নে শুধুই চেয়ে চেয়ে দেখেছি। এমন অপরুপ নীল স্বর্গে এসে পৌঁছানোর সৌভাগ্য আমাদের সারাজীবনের অম্লান স্মৃতি।

জনশ্রুতি মহাভারতের যুধিষ্ঠির ও বকরুপী ধর্মরাজের মধ্যে যে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলেছিল, তা নাকি এই হ্রদের ধারে বসেই হয়েছিল। দেবতাদের এই স্থান নির্বাচনগুলো খুবই বিস্ময়ের! হোক না হোক, ভাবতেই ভালো লাগে এই সব সত্য- মিথ্যাের জনশ্রুতিগুলো।

দেওরিয়াতালের ওপর থেকে দূরের চন্দ্রশীলাকে পাখির চোখে দেখা যায়। বাইনোকুলার দিয়ে দেখলে তুঙ্গনাথের মন্দিরও দেখা যায়। দেওরিয়াতাল থেকে জঙ্গলের পথে ১৪ কিমি ট্রেক করে চোপতা যাওয়ার একটা সুন্দর রাস্তা রয়েছে। এই অভিযানে অভিযাত্রীরা সামিল হতেই পারেন।

নীল স্বর্গের নির্জনতায় অনেকটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসার সময় মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। হিমালয়ের এই সব সুন্দর সুন্দর জায়গায় আসার আনন্দ-স্মৃতি বড় মূল্যবান। জীবন বহমান। পথচলা চলতেই থাকে। পিয়াসী মন পান্থজনের মতই পথে চলার আনন্দে বিভোর থাকে। তাই ভাঁড়ারে জমা পড়ে বহুস্মৃতি। কিন্তু সব স্মৃতি সুন্দর হয় না!.. অক্ষয় হয় যে স্মৃতিগুলো, সেগুলো প্রকৃতই সুন্দর! দেওয়রিয়াতালের এই সুন্দর স্মৃতি নিয়ে এবার আমরা চলে যাব তুঙ্গনাথজীর দর্শনে!..

কিভাবে যাবেন :- হরিদ্বার বা হৃষিকেশ থেকে উখিমঠ, কুন্ড হয়ে সারিগ্রামে চলে আসা যায়।

আবার যোশিমঠ, চামোলী হয়েও আসা যায় সারিগ্রামে।

সারি থেকে তিন কিমি পায়ে হাঁটা সুন্দর পথে দেওরিয়াতাল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

1 Response

  1. Ramesh Chandra Das says:

    লেখা ছবি অনবদ্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।