ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || সুব্রত সরকার – ৭

।। জাপানের ডায়েরি ।।

পর্যটন সংস্থার গ্রুপ ট্যুরগুলোয় একটা ছুটে বেড়ানোর তাড়া থেকেই যায়। কম সময়ে কত বেশি স্পট ভিজিট করানো যায়, সেভাবেই সাজানো হয় আইটিনারি। জাপানের মত একটা দেশকে হাতে গোনা দশদিনে দেখা মানে মন খুঁত খু্ঁত থেকে যায়। দেখেও সেভাবে সবটা দেখা হয় না!.. তার ওপর ট্যুর ম্যানেজারদের তাড়া!..চলুন!..চলুন…!..

আজ আমাদের বেড়ানোর চতুর্থ দিন। গত তিনদিনে ছুটতে ছুটতে দেখা হয়েছে কিওটো, নারা, হিরোশিমা, মিয়াজিমা, ওসাকা, উমেদা স্কাই বিল্ডিং ,ওসাকা ক্যাসল ও ডোটনবরি নদী !..সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছোটা শুরু হয়, ফিরে আসি হোটেলে যেন রাতের ঘুমটুকুর জন্যই!..

আজও ঘুম থেকে উঠে তাড়া লেগে গেল, চটজলদি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। আজ আমরা যাব অনেকটা দূরে। ওসাকা থেকে প্রায় তিনঘণ্টার বাস জার্নি করে মিকিমোতো আইল্যান্ডে।
মিকিমোতো জাপানের এক বিখ্যাত মুক্তোর ব্র্যান্ড। বিশ্বজোড়া খ্যাতি তার। ১৯০৩ সালে কোকিকি মিকিমোতো এর প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁকে বলা হয় “মুক্তোর রাজা”।

 

প্যাসিফিক সমুদ্রের কোলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই “Mikimoto Pearl Island” টুরিস্ট আকর্ষণের একটা জনপ্রিয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আমরা আজ একটু সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে সেই আইল্যান্ডের পথে এগিয়ে চললাম।

ওসাকা শহর ছেড়ে বাস যত এগিয়ে চলেছে প্রকৃতির সান্নিধ্যে স্নিগ্ধ হয়ে উঠছি। বড় অপূর্ব ছিল এই বাস জার্নিটা। সত্যিকারের নেচার ও সুন্দর সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ দেখতে পেয়েছি এই পথ ধরে যেতে যেতে। পাহাড়ে ঘেরা রাস্তার দু’ধারে ধূ ধূ মাঠ, শস্যখেত, নদী, জঙ্গল আর সুন্দর নীল আকাশ দেখে চোখ ও মন জুড়িয়েছে।

এপথে মাঝে মাঝেই পাহাড় কেটে টানেল করা আছে। সেই টানেলের মধ্যে দিয়ে গেছি অনেকবার। কিছু কিছু জনপদের নাম মনে পড়ছে- টাকি টানেল, টোবা, টামাকি জিঙ্গু, ফুটামি। প্রায় আড়াইঘন্টার এই সড়কপথের সফরটা ভালো লেগেছিল।
মিকিমোতো পার্ল আইল্যান্ডে পৌঁছে ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ সত্যিই হয়েছিল!.. কি অপূর্ব নীল সমুদ্র আর নীল আকাশের রৌদ্রছায়ায় মিকিমোতো পার্ল আইল্যান্ড। আমরা ট্যুরিস্ট বাস থেকে নেমে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম আইল্যান্ডের কাছে। এই আইল্যান্ডে অনেককিছু রয়েছে উপভোগ করার। পার্লকে কেন্দ্র করে সত্যিকারের একটা মুক্তোর উদ্যান ও বাজার গড়ে তোলা হয়েছে।
পার্ল আইল্যান্ডে মিকিমোতোর একটা বড় মূর্তি রয়েছে। তাঁকে তো জাপানে “মুক্তোর রাজা” বলা হয়। তাই বেশ রাজকীয় ঢঙে মূর্তিটা গড়া হয়েছে। এছাড়া রয়েছে – Kokichi Mikimoto Memorial Hall, Pearl Museum, Pearl Plaza, Pearl aquarium, Japanese Garden, Restaurant। আমরা প্রথমে একটা সুন্দর লাইভ প্রোগ্রাম দেখলাম। এটা হচ্ছে- ‘Traditional Ama Divers perform pearl diving.’ দুজন মহিলা ডুবুরি নীলজল সমুদ্রে নৌকো থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জলের অতল থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে এনে মুক্তোর দানা সংগ্রহ করছেন- সঙ্গে ধারাভাষ্য রয়েছে। এই জীবন্ত প্রোগ্রামটা সমুদ্রের পাড়ে বসে দেখে বেশ আনন্দ পেয়েছি। দুই ডুবুরির বারবার ডুব দিয়ে জলের অতলে অদৃশ্য হওয়াটা দেখা মজারও বটে। এই মিনিট কুড়ির লাইভ ডাইভিং শো সবাই খুব উপভোগ করেছি।

এরপর আমরা গেলাম Pearl Museum দেখতে। আমার ভ্রামণিক জীবনে অনেক রকম মিউজিয়াম দেখেছি। মিউজিয়াম দেখাটা সব সময়ই বেশ বিস্ময় ও মুগ্ধতার হয়। মুক্তোর মিউজিয়াম কোনওদিন দেখব ভাবি নি! এই মিউজিয়াম নিখুঁত পরিকল্পনা দিয়ে সাজানো- ‘Showcasing the journey from oyster to Gem!..’ মুক্তোর সত্যিকারের একটা ইতিহাস জানা হয়ে যায় মিউজিয়ামটা ঘুরে দেখলে। আর দেখতেও ভালো লাগে। হরেকরকম মুক্তো দিয়ে সাজানো কত কিছু। মহামূল্যবান এবং মহার্ঘ্য সেই সব আসল মুক্তোর গহনা, অলঙ্কার ও গৃহসজ্জার সামগ্রীগুলো দেখতে ভালোই লাগে।এই পার্ল মিউজিয়ামের ভেতরে একটি বুক শপ আছে। ‘How pearls are born-‘ জানতে চাইলে বইগুলো সাহায্য করবে।
মিউজিয়াম এর পাশেই রয়েছে ঝকঝকে পার্ল প্লাজা। মনের মত মুক্তোর জিনিস কিনতে চাইলে কেনা যায়। আমাদের অনেককেই দেখলাম পার্ল প্লাজায় শপিং করতে চলে গেলেন। এবং মূল্যবান মুক্তোর জিনিস কিছু কিনলেন। আমি এক পলকে একটু দেখে বেরিয়ে এসে মনে মনে নির্মলা মিশ্রর ভুলতে না পারা গানটা গাইতে গাইতে সমুদ্রের পাড়ে সুন্দর হেঁটে বেড়ালাম- “এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না যাতে মুক্তো আছে!..”
মিকিমোতো আইল্যান্ডের জাপানী বাগানটাও অপূর্ব। ঝাউগাছগুলোকে সুন্দর কেয়ারি করে সাজিয়ে রেখেছে। জাপানের সর্বত্র গাছেদের নানান নকশা করে সাজিয়ে রাখতে দেখেছি। জাপানীরা বাগান বিলাসী এই সুখ্যাতি রয়েছে। কিন্তু নিজের চোখে বারবার তা দেখতে পেয়ে খুব ভালো লেগেছে।
মিকিমোতো আইল্যান্ড ভ্রমণ এক কথায় বলতে হলে এরকম – ‘This island a unique blend of natural beauty, history and culture, perfect for anyone enchanted by pearls and their captivating story.’

একবেলার মিকিমোতো আইল্যান্ড ভ্রমণ খুব স্মরণীয় হয়ে রয়ে গেল স্মৃতিতে। এবার মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি।
আজ আমাদের জাপানি লাঞ্চ। দুই গাইডের তত্বাবধানে একটা দারুণ সুন্দর ভাসমান রেস্তোরাঁয় গিয়ে নীলজল সমুদ্রের দিকে মুখ করে খেতে বসলাম। জাপানি লাঞ্চে আজ টুনা মাছের একটা পদ ছিল। ভালোই খেলাম এই লোকাল ডিশ উইথ সী ফিস।

আজ সেকেন্ড হাফ শুরু হলো জলযাত্রার রোমাঞ্চ নিয়ে। প্রশান্ত মহাসাগরের নীল স্বচ্ছ জলের অতলে, ছলাৎ ছল ঢেউয়ের অন্দরে ডলফিন দেখার জন্য ভেসে বেড়াতে বেড়াতে হোনশু আইল্যান্ডের Mie তে যাব ও আসব। এই ট্যুরটাকে বলা হয়, ‘ Dolphin Bay a perfect blend of adventure and relaxation for nature lovers and thrill- seekers alike.”

সমুদ্রের জেটিতে এসে আমাদের অত বড় ট্যুরিস্ট বাসটা একদম জাহাজের পেটের মধ্যে ঢুকে গেল। আমরা বাস থেকে নেমে জাহাজের ডেকে, কেউ বা কাঁচে ঘেরা রুমে, কেউ রেস্টুরেন্টে গিয়ে খুব রিল্যাক্স মুডে প্যাসিফিক ওশানের রূপ দেখতে দেখতে চললাম। সামুদ্রিক বাতাস ও অপরাহ্নের মায়াবী রোদ এসে শরীর- মনে দারুণ একটা আমেজ এনে দিল। এই জলযাত্রাটা অসম্ভব সুন্দর। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে ডলফিন দেখা যায়। ডলফিন ডান্স দেখার মজাই অন্যরকম। কিন্তু সে দেখার রোমাঞ্চ ও আনন্দ আমাদের অধরা থেকে গেছে। ডলফিন দেখা হয় নি। তবু এই নীল জল সমুদ্রের বুকে প্রায় সোয়া একঘন্টা ভেসে বেড়ানোর আনন্দ কম নয়। সব ভ্রমণেই এমন কিছু না দেখতে পাওয়ার আক্ষেপ থেকে যায়। তখন মন খারাপ হলেও, কষ্ট না পাওয়ার চেষ্টা করে যেতে হয়।

বিকেলের শেষ ভ্রমণে সাগর সৈকতে পৌঁছে প্রশান্ত মহাসাগরের জলে পা ভিজিয়ে ভীষণ ভালো লাগল। জল ছুঁয়ে আনন্দ করলাম। ঢেউয়ের নাচন দেখলাম। এই সৈকতের একপাশে পাহাড় ও জঙ্গল। সৈকতের বালুচরে হলুদ রেপসিড ফুলের একটা সুন্দর বাগান দেখে মুগ্ধ হলাম।
আজ আমরা আইচির সৈকতে থাকব। সন্ধ্যা হয়ে এল। সৈকতে সানসেট দেখলাম। তারপর অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম হোটেল-Irago Resort and Convention Hotel এ।
এখানে এসে সবাই খুব খুশি। অসাধারণই বলব রিসর্টটাকে। সবাই পছন্দ মত ঘর পেলাম। সমুদ্রমুখী ঘরগুলো এত সুন্দর যে ঘরে ঢুকেই সব ক্লান্তি ঝরে গেল। জানলার পর্দা দিলাম সরিয়ে। আধো অন্ধকারের প্যাসিফিক ওশানকে দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে গেলাম। ছোট্ট ঝুল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সমুদ্র এখন শান্ত। ঢেউ নেই। ভাঁটার সময়। বাতাস বইছে হু হু করে। কেমন পাগল হাওয়ার মত বাতাস। এমন সন্ধ্যার নির্জনতায় মন হারিয়ে যায়, হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দার জলে, গুনগুন করে ওঠে অন্তর, “পাগল হাওয়া কি আমারও মতন তুমিও হারিয়ে গেলে!../ ফুলেরও বনে হাজারও রঙের মেলায়/ সুরভি লুটের খেলায় / তারে নাহি পেলে.. / পাগল হাওয়া..”ভ্রমণে এভাবেই ফিরে ফিরে আসে আমার প্রিয় গানগুলো।
আজ সন্ধ্যা-রাতে আইচিতে এসেছি। সারাদিন ছুটে বেড়িয়েছি। এবার একটু বিশ্রাম। আগামীকাল আবিষ্কার করব আইচিকে। আইচির সাইট সিয়িং করব। আইচির কান্ট্রি সাইড শুনেছি অপূর্ব! ওদের সদর- মফস্বল সব ঘুরে ঘুরে দেখব। “পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে, পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া..”

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *