বর্ষায় প্রেম সংখ্যার গল্পে সঞ্জীব সেন

বারিষনামা

গল্পের শুরুতে কথাগুলো বলে নিলে গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সুবিধা হয় । এই গল্পটা সেইসময়ের যখন ফেমিনিজিমের রেনেসাঁ হয়নি । তাই বলে কী মেয়েরা প্রেম করত না! আসল কথাটা সে সময়ে প্রেমগুলো ছিল রাবীন্দ্রিক । কাব্যের মত। আর শেষপর্যায়ে একটা হাইফেন থাকত। অসম্পূণ্য । এই গল্পটাও সেইরকম।
বাসস্টপে বাসটা দাঁড়াতে অমিতের চোখ পরল বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের দিকে । তার শেষের কবিতার লাইন টা মনে পরে গেল ‘ ‘এস্ট্রোনট ভুল বলেছিল চাঁদ ভুল করে এসে পরেছিল পৃথিবীর কক্ষপথে’ । অমিত ভাবল শেষের কবিতা লেখার সময় বরীঠাকুর লাবণ্যর কি রূপ কল্পনা করেছিল তা কেউ জানিনা তবে তার মনে হয় ঠিক এইরকমই দেখতে ছিল লাবণ্য কে । বাস চলতে শুরু করল অমিত ভাবতে লাগল তার দিদি যে মেয়েটার সাথে বিয়ে দেবে ঠিক করেছে সে বিদেশিনী । খোদ বিলাতি । দিদি কি বোঝাল আর মা ও রাজি হয়ে গেল !নামও দিয়ে দিল অপরাজিতা। তবে ক্যামেলিয়া দেখতে খরাপ না তার উপরে বাঙালীয়ানা রপ্ত করে নিয়েছে । তবে এখনও শাড়ি পরাটা আয়ত্ত করতে পারি নি । ওর বাবা বাঙালী মা বিলাতী। নিজের দেশ ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে শান্তিনিকেতনে এসে উঠেছে। বিশ্বভারতীতে ভর্তী হয়েছে । সে ক্যেমেলিয়ার ছবি দেখেছে, দেখে মনে হয়েছে এই মেয়ের সাথে বাবুঘাটে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করা যায় তাই বলে বিয়ে! বাস যেখানে এসে থামল সেখান থেকে সামান্য হাঁটাপথ । পাহাড়ের বৃষ্টি সে আগে কোনদিন উপলব্ধি করেনি । ভালই লাগছে তার । অমিতের মাথায় বাসস্টপে মেয়েটির ছবি গেঁথে গেছে । অমিত যার বাড়ি যাবে সে কর্নেল । আসাম রাইফেলসে ছিল । এখন রিটেয়ার । বাবার সম্পর্কের তুতোভাই হয় । কর্নেল বাড়ি বললে সবাই দেখিয়ে দেয় । সেইভাবেই কর্নেল বাড়ি পৌছে গেল । বাংলোপ্যাটানের দোতলা বাড়ি। সামনে দু দিকে বাগান ।বেগেনভেলিয়া উঠে গেছে দোতলা দিয়ে ছাঁদে উঠে গেছে । অমিত কনিংবেল টিপলে দোতলা থেকে মসৃণ নারীকন্ঠ ভেসে এল । অমিত সেদিকে তাকাল । দেখতে পেল ব্যাগনভেলিয়ার আড়ালে মুখটি । অমিত দেখতে পেল সেই মেয়েটিকে যাকে সে কিছুক্ষণ আগে বাসস্টপে দেখেছিল । ওর একটু বিস্ময় হয় । আবার তাকায় । ততক্ষণে মেয়েটি হয়ত নিচে নেমে এসেছে । দরজা খুলতে ওর চোখ পরল সেদিকে মনে মনে ভাবল এ মুখ শেষের কবিতার লাবণ্যরই! সাদা চুড়িদার নীল ওড়না । ভিজে চুল । মেয়েটি রিনিঝিনি কন্ঠে বলে ওঠে ‘আসুন। পাহাড়ের বৃষ্টি এইরকমই ! বৃষ্টি শুরু হলে থামতেই চায় না ‘। অমিত ভাবল সত্যিই, এখানে জল দাঁড়ায় না । কলকাতা হলে এতক্ষণে বাসট্রাম বন্ধ হয়ে যেত। সে গেট পেরিয়ে আসে মেয়েটি বলল ছাতাটা কোনাটায় রেখে দিন । অমিত ভাবল মেয়েটিকে কি বলে সম্বোধন করবে, তুমি ! প্রথম সাক্ষাতে কোন অচেনা মেয়েকে কী তুমি বলা যায়! না আপনি বলবে! অমিত কিছুই সম্বোধন না করে বলল কর্নেল কাকা নেই । মেয়েটি বলল ‘এখনই চলে আসবে আপনি বসুন ‘ এই দুটো কথা হয়েছে । বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি কর্নেল কাকা আসার । তারমধ্যে অমিতের ভিতর খেলে গেছে শেষের কবিতায় পড়া শিলঙ। অমিত আর লাবণ্যর প্রেম । অঝর বৃষ্টির ভিতর দুজনের ছাতা নিয়ে হেঁটে যাওয়া । সে প্রেম ছিল রাবীন্দ্রিক। কাব্যের মত । কর্নেল কাকা এসেই ওকে ইয়ং বয় বলে ডাকল । কর্নেল কাকার শরীর এখনও ফিট আর ওর বাবা সমবয়সী হলেও এরকম ফিট নয়! অমিত প্রথমেই বলে দিল আমি কিন্তু পুরো বর্ষাটা পাহাড়ে কাটাবো । খুব কাছ থেকে পাহাড়কে দেব । উদ্ধত রোডোড্রেনডন! কর্নেল হাসল বলল শিলং এসেই কী শেষের কবিতা মনে পরে গেল ! অমিত একটু আধতু লেখালেখি করে কর্নেল কাকা জানে না। মজা করেই কথাটা বলল তুমিও কবি নাকি! অমিতের ভিতর এক অন্যমনস্কতা । তখনও বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে । পাহাড়ের বৃষ্টি এর আগে দেখেনি মানে এভাবে উপলব্ধি করেনি । এর মধ্যে মেয়েটি যখন চা দিয়ে গেছে তখন সে অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়েছিল । অমিত ভাবল মেয়েটির সঙ্গে কর্নেল কাকার কিসের সম্পর্ক! কর্নেল কাকা বিয়ে করেনি । এইবয়সে এসে করবেও না । অনেককিছুই মাথায় আসছিল। তখনই কর্নেল কাকা মেয়েটিকে মুনসুন বলে ডাকল বলল আমিত কে ওর ঘরটা দেখিয়ে দাও । লাগেজ নিয়ে যেতে যেতে অমিত বলল তোমার নাম মুনসুন । সে এই প্রথম মেয়েটিকে তুমি বলে সম্বোধন করল । মেয়েটি বলল’ নাম মৌসুমী ,,আঙ্কেল আমায় মুনসুন বলে ডাকে ‘। আর কোন কথা হল না । সে যে ঘরে থাকবে সেই ঘরটা দেখাতে গিয়ে দরজা খুলতেই একরাশ অচেনা ফুলের গন্ধ ভেসে এল। সে দেখতে পেল টেবিলে ফুলদানিতে সাজানো কিছু অপরিচিত ফুল । মৌসমী বলল ‘এগুলো পাহাড়ী ফুল । পাহাড়ে এলে পাহাড়কে পুরোপরি জানতে হয়! তাছাড়া পরিচিত ফুল দিয়ে সবাই সাজায়! আমি অন্যরকম ট্রাই করলাম ‘। অমিত দেখল খুব যত্ন করে সাজিয়েছে ফুলদানি-টা আর গন্ধটাও বেশ অন্যরকম । বৃষ্টি থামলেও মেঘলা করে আছে। পাহাড়ে বর্ষায় তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর শুয়ে পরলেও ঘুম আসছিল না । নতুন জায়গায় ঘুম আসতে চায় না । একটা সময় সে খুমিয়েও পরল । রাতে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল ও আর মৌসমী ডুয়েট শেষের কবিতার কবিতাটা পাঠ করছে ।
“ডানা= মেলে= দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্কচিৎ= কিরণে দীপ্ত”
ভোর হয়ে গেছে । খাটে রোড এসে পরেছে । সে ভাবল এ স্বপ্নের অর্থ কী! সে ভাবল ভোরের স্বপ্ন কী সত্যি হয় !খাট থেকে নেমে ফ্রেস হল । মৌসমী ব্রেকফাস্ট রেডি করে ফেলেছে । সে দেখল মৌসমী আজ নীল রঙের চুড়িদার পড়েছে । সব যেন মিলটারি আদবকায়দা । কর্নেল কাকা পেপার পড়ছে । প্রয়োজনের বেশী কেউ কথা বলে না । কর্নেল কাকা বলল ‘অমিত, ঘুম হল ! নাও এবার খেয়ে নাও । ‘ আকাশটা পরিস্কার । কালকের বৃষ্টির কোন ছাপ নেই । অমিত ভাবল সকালের আকাশ দেখে বিকেলের ধারণা করা যায় না । একটু পরেই হয়ত মেঘ করে আসবে । সে ঠিক করেছিল আকাশ ভাল থাকলে বেরবে । পাহাড়ে এসে ঘরবন্দী হয়ে থাকাটা বেমানান !অমিত ভাবল সে তো কিছুই চেনে না মৌসুমী যদি যেত , অমিত ভাবল একবার বলে দেখবে! অমিত ভাবল কিভাবে বলবে সে কথা । তখন মৌসমীই বলল এখানে অনেক কিছু দেখার আছে । রবী ঠাকুরের বাড়ি আছে । এই সুযোগে অমিত বলল শেষের কবিতায় যে জায়গাটায় মোটর কারের ধাক্কা লেগেছিল সে জায়গাটা চেন! মৌসমী শেষের কবিতার কবিতার লাইনটা শোনাল
“ পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলান
পরানে ছড়ায় আবীর গুলান
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য:”
অমিত পরের টুকু জুড়ে দিল
হঠাৎ= আলোর ঝলকানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত”
ওদের ডুয়েট ভার্সন ঘরের চারিদিকে বাচতে লাগল । অমিত তাকাল মৌসুমীর দিকে দেখল মৌসুমী হাসছে আর দেখল সামনের পাটিতে একটা দাঁত গজ। গালে ছোট দিঘীর মত টোল । গায় গোলাপ জলের সুগন্ধ। মৌসুমী বলল’ আপনি কী কবিতা লেখেন!’ উৎসজলের যে উজ্জ্বলতা থাকে ঠিক সেরকমই ওর কণ্ঠস্বর । অমিত বলল ‘ওই একটু আধ-তু । যখন লিখি নিবারণ চকোত্তী ভর করে ‘! দুজনাই হেসে ওঠে। সেই সুযোগে অমিত বলল ‘বিকেলে সামনের রাস্তাটায় যাব যাবে আমার সাথে । আকাশ যদি ঠিক থাকে তবেই ।’ মৌসুমী কিছুই বলল না । নীরব থাকল ।
এইখানে একটু পিছনে ফিরতে চাই। পেছনের টুকু জানা থাকলে গল্পটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সুবিধা হয়।
অমিত লেখালেখি করে । কিছু পত্রিকার লেখা কবিতা গল্প বেরয়। অমিতের একটা ইচ্ছা আছে, শেষের কবিতায় বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক করেনি। শেষপর্যায়ে অমিত আর লাবণ্যর মাঝে হাইফেনটা মেনে নেওয়া যায় না । অমিত লিখবে বারিষনামা। সে লিখবে শেষের কবিতা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে ।বিকেল হতেই অমিত মৌসুমী ঘুরতে বেরল । সঙ্গে ছাতা নিল ।মৌসুমী তখন নিরব ছিল।নীরবের ভিতর হ্যাঁ থাকে। পথ চলতে চলতেও কথা হচ্ছিল না । শুরু করার বিষয় থাকলে কথাগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় । অমিত বলল “শেষের কবিতায় আমার একটা অভিযোগ আছে । রবীঠাকুরের সঙ্গে দেখা হলে অভিযোগ করব । একদিকে শোভনলাল আর লাবণ্য আর একদিকে অমিত আর কেতকী কে দেখিয়ে ঠিক করেনি । আমি বলব গল্পটায় অমিতের প্রতি একটু করুণা করা উচিৎ ছিল ।যদি কোনদিন দেখা হয় আমি বলব সেকথা । “ মৌসুমী হেসে বলল” রবীঠাকুর মর্তে নেমে আসবে কথার উত্তর দিতে । মৌসুমী বলল আবার দেবদাস পড়লেও মনে হবে শরৎবাবু ঠিক করেনি ।” কথা শেষ হওয়ার আগেই বৃষ্টি এসে গেল । অগত্যা ফিরে আসতে হল । তারপর টানা দশদিন বৃষ্টি । এবারের বৃষ্টি দশ বছরের রেকর্ডকে ছাপিয়ে যাবে সে এতটা আসা করেনি । যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। হড়কা বাণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা । সবাই ঘরবন্দী । পাহাড়ে এসে অমিতের বিপরীত অভিজ্ঞতা হল ।
আজ অমিতের পাহাড়ে আসার একমাস পূর্ণ হল । এখন পরিবেশ পরিস্থিতী স্বাভাবিক । এরমধ্যে রবী ঠাকুরের বাড়ি দেখে এসেছে । সেদিন কর্নেল কাকাও ওদের সঙ্গে ছিল ।
পরের দিন অমিতের বাড়ি থেকে ফোন এল । ফোনটা ধরল মৌসুমী । ও প্রান্ত থেকে যে বলল তার নাম শতাব্দী অমিতের দিদি । মৌসমীর পরিচয় জানতে চাওয়ায় মৌসুমী ভাবছিল তার আগেই বলল কাজের লোক ! বুঝেছি । মৌসুমী কিছু বলতে পারল না । অমিত কে চাইল । তারপর বলল আগে কর্নেল কাকা কে দাও । কর্নেল কাকা কে বলল অমিত এখান থেকে রাগ করে চলে গেছে সেকথা কি বলেছে ! ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে ক্যামেলিয়ার সাথে । অমিত ফোনটা ধরে বলল তুই! কেন ফোন করেছিস !শোনা যাচ্ছে ও প্রান্ত থেকে ক্যাম্যেলিয়া বলছে” অমিট তুমি আমার জন্য ওইখানে বসে আছো “। শতাব্দী ফোন ধরল অমিতকে বলল মেয়েটি কে! অমিত এখনও জানে না মৌসুমীর সম্পর্কে । অমিত বলল কর্নেল কাকার কাছে থাকে । শতাব্দী বলল এই জন্য ওখানে পরে আছিস । অমিতের কাছে কথাটা খুব অশ্লীল শোনাল । শতাব্দী বলল কাল আমরা যাচ্ছি । ক্যামেলিয়াও যাচ্ছে । লাগেজ তৈরী করে রাখিস, পারলে কালকেই ফিরব । ফোনটা কেটে দেয় । অমিত দেখে মৌসুমী চুপ করে আছে । ও কে যে কাজের মেয়ে বলেছে সে কথাটা মৌসুমী বলেনি । শুধু বলেছে ‘ দিদিকে খুব ভয় পান, তাই না! তারপর বলছে চলুন আপনার ল্যাগেজটা গুছিয়ে দিই। “ল্যাগাজ গোছাতে গোছাতে বলছিল “রবীঠাকুরের সাথে যদি দেখা হয় তবে অভিযোগটা মনে করে করবেন কিন্তু!” অমিত মনে মনে ভাবল ঘরা আর দীঘি কখনই এক হয় না । ভালবাসা আর ঘর করা কখনই এক নয় ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।