ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || সুব্রত সরকার – ১১

।। জাপানের ডায়েরি ।।
“আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না”…. আকাশজুড়ে ঘন মেঘ। সুমিদা- গাওয়া নদীর জলে বৃষ্টি ঝরে পড়ছে। হোটেলের ঘরের জানলা থেকে জলভরা মেঘ, অনুজ্জ্বল আকাশ ও নদীর বুকে বৃষ্টির রিমিঝিমি দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে ফিরে আসার দিনও আকাশ এমন করে কেঁদেছিল! আমার চল্লিশ দিন আমেরিকা ভ্রমণের শেষ দিন ছিল সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে শার্লট হয়ে নিউইয়র্কে আসা। মেয়েকে ছেড়ে চলে আসছি, মন ভারাক্রান্ত, চল্লিশ দিন একসঙ্গে থাকা ও ভ্রমণের কত সুখস্মৃতি নিয়ে ফেরার দিন আকাশও বড় মনখারাপ করে ছিল! বৃষ্টির কান্না আমাকেও কাঁদিয়েছিল!..
জাপান ভ্রমণে আজ বিজয়া দশমী। “সায়োনারা” বলে চলে যাব জাপান ছেড়ে! মন কেমন করা এক অনুভূতি তো হচ্ছে। তার ওপর আবার ঘুম থেকে উঠেই দেখি আকাশজুড়ে কালো মেঘ ও বৃষ্টি। ভ্রমণ সাঙ্গ করে ফিরে যাওয়ার দিন প্রকৃতিও বড় একাত্ম হয়ে যায় পান্থজনের সঙ্গে। মন খারাপ মন নিয়ে বাইরের আকাশ,বাতাস, বৃষ্টি, নদী, বিমানবন্দর,শহর সব ঝাপসা চোখে দেখছি আর ভাবছি কেমন করে যেন ফুরিয়ে গেল দশটা দিন!.. দশ দিনের কত দেখা, কত জানা, কত চেনা, কত স্মৃতি নিয়ে এবার ফিরে যাওয়ার পালা! ঘরে ফেরারও একটা আনন্দ থাকে!.. কিন্তু কারো কারো জীবনে ঘর মানে তো আর পরিবার নয়!.. একলা থাকার, একলা বাঁচার দিনযাপন!.. তাদের কাছে ভ্রমণটাই চলমান দিনযাপনের আনন্দ!..
” মেঘমল্লারে সারা দিনমান / বাজে ঝরনার গান / মন হারাবার আজি খেলা, পথ ভুলিবার খেলা – মন চায় / মন চায়…” আজ টোকিওর আবহাওয়া পূর্বাভাষ বলেছে সারাদিন এমন ঝরো ঝরো বাদল দিনই থাকবে!..মেঘমল্লারে ঝরনার গান সারা দিনমান শুনতে হবে!..
শেষ বারের মত লাগেজ দেখে নিয়ে হোটেলের রুম থেকে বেরিয়ে লিফ্টের কাছে এসে দাঁড়ালাম।নিচে নেমে লবিতে চলে যাব। আমাদের গাড়ি ওখানে অপেক্ষা করছে। লিফ্টে দুই বিদেশী পর্যটকের সঙ্গে দেখা হলো। ওরা জার্মানির। যাবে এবার থাইল্যান্ডে। কিন্তু একটু চিন্তিত গতকালের মায়ানমারের ভূমিকম্প নিয়ে। চিন্তা আমাদেরও একটু রয়েছে। ফ্লাইট ছাড়তে দেরী করতে পারে, কিন্তু ক্যানসেল হবে না। শুনলাম ব্যাংকক এয়ারপোর্ট ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
আজ আমাদের একবেলার ভ্রমণে টোকিও শহরটাকে বাসে বসেই দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম এই শহরের বিখ্যাত Shinjuku Gyoen National Garden এর দিকে। শেষ দিনের শেষ বেড়ানো। আজ ২৯ মার্চ। চেরি ব্লসম এর পারফেক্ট টাইম। ফুল ব্লুম হয় এখন। তাই শেষ দিনে এই পার্ক বেড়ানোর মধ্যে দিয়ে শেষ হবে জাপান ভ্রমণ।
“Shinjuku Gyoen was originally one part of Edo residence of the Lord Naito, the vassal of leyasu Tokugawa. In the Meiji era, it became an agricultural experiment station, and then in 1906 it was made into an imperial garden. After the war in 1949, it was opened to the public as a National Garden.” এই কথাগুলো পেলাম পার্কের থেকে পাওয়া রঙিন সুন্দর লিফলেটে।
শিনজুকু গোয়েন গার্ডেনে তিন ধরণের দৃষ্টিনন্দন বাগান আছে। Landscape Garden, Formal Garden and Japanese Traditional Garden. এই জাতীয় উদ্যানে ৯০০ চেরি ফুলের গাছ আছে। এবং ৭০ ধরণের বৈচিত্র্য নিয়ে চেরিফুল গুলো হাসছে।
Seasonal Cherry Blossoms এর সময়গুলো হলো- Mid March, Late March, Early April. এই ৪০/৪৫ দিনের এক রঙিন উৎসবের নাম চেরি ব্লসম। জাপান এই সময় বসন্তের বাহারে ঝলমলে হয়ে ওঠে। সারা পৃথিবীর পর্যটকরা আসেন জাপানে। আমরাও এসেছিলাম এই চেরি ফুলের টানে। গত দশদিন ধরে বহুবার বহু জায়গায় নানা রঙের চেরিফুল দেখেছি। চোখ জুড়িয়েছি। আজ আবার এই শিনজুকু গোয়েন গার্ডেনে এসে বৃষ্টিভেজা চেরিফুলের বাগানে মনের আনন্দে মেতে গেলাম। ভিজে ভিজেই বাগানগুলোতে ঘুরে বেড়ালাম। আজ তো শেষদিন!.. মন খারাপের মধ্যেও মন মাতালের আনন্দ উদযাপন করতে করতে গান বেজে যায় হৃদয়ে..”মন হারাবার আজি বেলা… পথ ভুলিবার খেলা… মন চায়…মন চায়…”
শিনজুকু বাগানে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। আমাদের জাপানি গাইড কাওয়াসাকি টিকিট কেটে সবার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা চেরি ফুলের সাম্রাজ্যে চলে এসেছি এবার। এনজয় করুন চেরি ব্লসম!..”
বাগানে ঢুকেই মনে হয়েছিল সত্যি অভাবনীয় এক সুন্দর উদ্যান। বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই। কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে না। তাই সবাই বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই ঘুরে বেড়ানো শুরু করলাম।
শিনজুকু গোয়েন বাগানে চেরিফুলের প্রস্ফুটিত হওয়ার সময় ও নামগুলো হলো- Takatokohigan, Yoko, Shidare- zakura. এরা মধ্য মার্চে চারপাশ আলো করে ফোটে।
মার্চের শেষে যে চেরিগুলো হেসে ফুটে ওঠে, তারা হলো- Someiyoshino, Ohshima- zakura, Yaebenishidare, Choshu- hizakura.
এবং এপ্রিলের শুরুতেই যাদের দেখা যায়, তারা হলো- Ichiyo, Kanzan, Fugenzo, Fukurokujyu.
শিনজুকু গোয়েন মূলত চেরিফুলের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু সারাবছর তো আর চেরিফুল ফুটে থাকে না। তাই বাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরও সুন্দর সুন্দর সব ফুল। Japanese quince, Yulan, Wild daffodil, Peach ‘Genpei’, Hall Crab apple, Flowering dogwood, Azalea, Dove tree.
শিনজুকু উদ্যানের প্রধান তিন ধরনের বাগান ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেন, ফর্মাল গার্ডেন ও জাপানিজ ট্র্যাডিশনাল গার্ডেন ঘুরে বেড়িয়ে দেখার আনন্দ অপরিসীম। আমাদের জাপান ভ্রমণের শেষ দিনের এই বেড়ানো সকলেই খুব উপভোগ করেছি। এছাড়াও এখানে আছে মিউজিয়াম, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফেটেরিয়া ও অনেক ছোট ছোট জলাশয়। বাগান বেড়ানো শেষ হতেই কাওয়াসাকি সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে বললেন, ” তোমরা খুশি তো জাপানকে দেখে, বেড়িয়ে?”
আমরা সবাই একসুরে বললাম,” ইয়েস। আমরা খুব খুশি হয়েছি। জাপান সুন্দর। ”
কাওয়াসাকি তৃপ্ত হলেন। হাসিমুখে বললেন, “আরিগাতো গোজাইমাস । অনেক ধন্যবাদ।”
এবার গাড়ি ছাড়ল। বাগান বেড়ানো শেষ করে এগিয়ে চললাম টোকিওর নারিতা এয়ারপোর্টের দিকে। শহর থেকে এয়ারপোর্ট অনেকটা দূরে। শহরের চারপাশটাকে আরও একটু বেশি দেখার সুযোগ পেলাম।
ফেরার এই পথটুকুতে কাওয়াসাকির সঙ্গে আমাদের অনেক কথার আদান-প্রদান হলো। কাওয়াসাকি একজন সুশিক্ষিত সুভদ্র গাইড। নানান বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও পড়াশোনা রয়েছে। তাই তাঁর সঙ্গে হরেক বিষয় নিয়ে কথা বলা, গল্প করা যায় অনায়াসে । আমাদের মধ্যেও অনেকে অনেক কথা বললেন। মত বিনিময় ও স্মৃতিচারণ হলো একটু। ভ্রমণ সাঙ্গ করে ফেরার দিনটা মন প্রাণ যেমন ক্লান্ত থাকে, একটু বিষন্নও থাকে, তেমন আবার দেশে ফেরা, বাড়ি ফেরারও একটা ছটফটানি থাকে। এই সব নিয়ে কেমন একটা যেন হয়ে যায় হৃদয় – এ এক অন্য অনুভূতি! অনন্য অনুভব!..
এয়ারপোর্টের কাছাকাছি চলে এসেছি। মন বড় নিঝুম হয়ে গেল। এবার তো সত্যিই গুডবাই জাপান!.. বৃষ্টির কোনও ক্লান্তি নেই। ঝরে যাচ্ছে ঝরো ঝরো! বাস থেকে নেমে সবাই লাগেজ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তার মধ্যেই একবার কাওয়াসাকিকে আলিঙ্গন করে বললাম, “অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আরিতাতো গোজাইমাস। কখনো সুযোগ হলে আসবেন আমার দেশে। আমার শহরে দ্য সিটি অফ্ ক্যালকাটা।”
কাওয়াসাকি মৃদু হেসে নম্র উচ্চারণে বললেন, “ইয়েস। সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই যাব। সাবধানে যাবেন। সায়োনারা।”
“সায়োনারা।” আমিও তাঁকে বিদায় জানালাম।
Travel Live এর গাইড অশোকদা পাশেই ছিলেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, “খুব ভালো বেড়ানো হলো। ধন্যবাদ Travel Live কেও।”
পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর সুখী এক দেশ জাপান। সেই দেশ ভ্রমণ সাঙ্গ করে ফিরে এসেছি এয়ারপোর্টে। এবার একটু অপেক্ষা। উড়ে যাওয়ার উড়ানে চাপলেই ভ্রমণ শেষ। তাই মন গুণ গুণ করে ওঠে, ” এবার বিদায়বেলার সুর ধরো ধরো ও চাঁপা, ও করবী/… যাবার পথে আকাশতলে মেঘ রাঙা হল চোখের জলে…”
।। সমাপ্ত।।