ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে সমীরণ সরকার (পর্ব – ৬৫)

সুমনা ও জাদু পালক 

রাজা রুদ্র মহিপাল বললেন, বেশ, আমি এগিয়ে যাচ্ছি ওই মহাবটবৃক্ষের কাছে, রাজকুমারী রত্নমালা ও চন্দ্রকান্তা, তোমরা আমার পিছনে এসো।
চন্দ্রকান্তা ও সুমনা বললো, যথা আজ্ঞা মহারাজ।
রুদ্র মহিপাল তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে, হাত জোড় করে অদৃশ্য কন্ঠের উদ্দেশ্যে বললেন, হে মহাজ্ঞানী অদৃশ্য কন্ঠ, রাজা রুদ্রমহিপাল আপনাকে তার প্রাসাদে যাওয়ার জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
অদৃশ্য কন্ঠ বললো, হে রাজন, আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
তবে আপনি আমন্ত্রণ না জানালেও আমাকে রাজকুমারী রত্নমালার সঙ্গে প্রাসাদের অভ্যন্তরে যেতেই হতো। এখন চলুন, মহা বটবৃক্ষের দেহের অভ্যন্তরে লুকনো পথ দিয়ে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার উদ্যোগ নেওয়া যাক।
রাজা রুদ্র মহিপাল প্রস্থানোদ্যত হতেই অদৃশ্য কন্ঠ বললো, হে রাজন, আপনি আপনার বংশের রক্ষা কর্ত্রী মঙ্গলময়ী তুলসীপত্রকে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন। তাঁকে এখানে এই বাগানে অবহেলায় ফেলে রেখে যাবেন না।”
—হে অদৃশ্য কন্ঠ, আমাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই।আমি ভেবেছিলাম যে, যাওয়ার আগে ওই পবিত্র তুলসীপত্রকে কোন একটা বিশেষ স্থানে সযত্নে লুকিয়ে রেখে যাব।ফিরে এসে রাজবাড়ির মন্দিরে প্রভু নারায়ণের মূর্তি যেখানে ছিল,সেই বেদী পরিষ্কার করে তার উপরে স্থাপন করব ওই তুলসীপত্র। ছেলেবেলায় একদিন অজ্ঞানতবশত যে পবিত্র তুলসীপত্র ওই বেদী থেকে আমি সরিয়েছিলাম, আজ নিজের হাতে ওই বেদী পরিষ্কার করে তুলসীপত্র ওখানে স্থাপন করব।
—— হে রাজন, আপনার ভাবনা যথাযথ। তবুও আমি অনুরোধ করব, ওই তুলসীপত্রকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। হয়তো ওই তুলসীপত্র কোন চমৎকার দেখাবে।
—— বেশ ,তাই হবে হে মহাজ্ঞানী অদৃশ্য কন্ঠ।
রাজা রুদ্র মহিপাল এ কথা বলে, হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে, ওই পবিত্র তুলসী পত্রটিকে প্রথমে আপনার শিরে ধারণ করার পরে, অতি যত্নে ডান হাতে দিয়ে আগলে বুকে ঠেকিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন।
রাজকুমারী চন্দ্রকান্তা ও সুমনা তাকে অনুসরণ করতে লাগলো।
রাজা রুদ্র মহিপাল বাগানের ঈশান কোণ বরাবর হাঁটতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ চলার পরে রাজা যখনই বাগানের সীমা অতিক্রম করে, বাগানের ঈশান কোণে এক বিশাল জলাশয়ের সামনে উপস্থিত হলেন, অকস্মাৎ পুকুরের জলে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি হল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজার হাতে ধরা সেই তুলসীপত্র থেকে উজ্জ্বল আলো বেরোতে শুরু করল। থরথর করে কাঁপতে শুরু করল ওই তুলসী পত্র। রাজা প্রচণ্ড ভীত হয়ে প্রায় চিৎকার করে বললেন, হে মহা জ্ঞানী অদৃশ্য কন্ঠ, আপনি তো সবই লক্ষ্য করছেন ,এখন আপনি বলুন কি আমার কর্তব্য। আমি বুঝতে পারছি না, কেন আলোড়ন হচ্ছে জলাশয়ের জলে আর কেনই বা তুলসীপত্র এরকম বিচিত্র আচরণ করছেন।
অদৃশ্য কন্ঠ বললেন, আমি বলেছিলাম না রাজন, ওই তুলসীপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার ভাগ্য বদনের সূচনা হয়েছে।
—— আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন , আমি বুঝতে পারছি না হে অদৃশ্য কণ্ঠ‌।
অদৃশ্য কন্ঠ বললো, আপনি এখন যে স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে বসে ওই তুলসীপত্রটিকে ঘাসের উপর স্থাপন করুন।
তারপর ওই স্থানে জলাশয়ের ধার থেকে ভেজা মাটি সংগ্রহ করুন। তারপর সেই ভেজা মাটির সাহায্যে তৈরি করুন একটি ছোট্ট শিবলিঙ্গ।
বিস্মিত রুদ্রমহিপাল বললেন, আমি শিবলিঙ্গ তৈরি করব! কিন্তু—
—– অযথা সময় নষ্ট করবেন না হে রাজন। ওই দেখুন, জলাশয়ের জল প্রচন্ড জোরে আলোড়িত হচ্ছে। আপনি দয়া করে আমার নির্দেশ পালন করুন। এতে আপনার উপকার হবে।
—-বেশ,তাই হোক। একদিন আমার ছেলের কল্যাণ কামনায় যে শিব মন্দির আমি প্রতিষ্ঠা করতে না পেরে সন্তানকে খুইয়েছি, আজ সেই ভুলের সংশোধন করব।
কথা শেষ করে রাজা রুদ্রমহিপাল তুলসী পত্রটিকে ভূমিতে ঘাসের উপর স্থাপন করলেন।
তারপর জলাশয়ের ধার থেকে ভিজে মাটি সংগ্রহ করে ,তার সাহায্যে একটি ছোট্ট শিবলিঙ্গ তৈরি করলেন‌। আর কি আশ্চর্য! প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের জলের আলোড়ন হঠাৎ থেমে গেল। পুকুরের মাঝখানে ধীরে ধীরে ভেসে উঠলো প্রস্তর নির্মিত এক অপূর্ব বিষ্ণু মূর্তি।
রাজা বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন, এ কি অদ্ভুত কান্ড! এ যে দেখি জলে ভাসে শিলা।
ভাসমান ওই বিষ্ণু মূর্তি থেকে উজ্জ্বল আলো ঠিকরে বেরোতে শুরু করল। উজ্জ্বল আলো বের হতে শুরু করলো, রাজা রুদ্রমহিপালের তৈরি শিবলিঙ্গ থেকেও। সবাই সবিস্ময়ে লক্ষ্য করল যে, মূর্তিটি ভাসতে ভাসতে পাড়ের দিকে এগিয়েত আসছে।
অল্প সময় পরে মূর্তিটি ভাসতে ভাসতে শিবলিঙ্গের কাছাকাছি এসে আস্তে আস্তে সোজা হয়ে প্রায় দাঁড়িয়ে গেল। অপূর্ব সুন্দর সেই বিষ্ণু মূর্তি থেকে চোখ ফেরানো যায় না। বিস্মিত রাজা, সুমনা ও চন্দ্রকান্তার চোখের সামনে ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। ওরা দেখল, এক বিশাল আকৃতিরজজজ কূর্ম পিঠে করে বয়ে নিয়ে আসছে ওই শিলা নির্মিত বিষ্ণু মূর্তি। কূর্মটি ধীরে ধীরে শিবলিঙ্গের পাশে এসে সেখানে আপনার পিঠ থেকে বিষ্ণু মূর্তিটিকে সযত্নে নামিয়ে দিল। আর তারপরেই ঘটলো এক অস্বাভাবিক ঘটনা। তুলসীপত্রটি দু ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি তুলসীপত্রে পরিণত হলো। একটি তুলসীপত্র মনে হলো যেন উড়তে উড়তে গিয়ে বিষ্ণু মূর্তির পদতলে স্থাপিত হল,অপর তুলসীপত্রটি স্থাপিত হল শিবলিঙ্গের মাথায়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অতি উজ্জ্বল আলোতে আলোকিত হয়ে উঠলো চতুর্দিক। এত উজ্জ্বল সেই আলো যে, তাকিয়ে থাকা যায় না। রাজা রুদ্র মহিপাল ,সুমনা ও চন্দ্রকান্তা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
হঠাৎ শঙ্খধ্বনি ও ঘন্টাধ্বনি ভেসে আসতে শুরু করল।
একটু সময় পরে শঙ্খ ধ্বনি ও ঘন্টাধ্বনি থেমে গেল। একে একে রাজা সুমনা ও চন্দ্রকান্তা চোখ খুলল। ওরা দেখল, তীব্র আলোকরশ্মি এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ওরা অবাক হয়ে আরও দেখল যে, মৃত্তিকা নির্মিত সেই ছোট্ট শিবলিঙ্গ এক বিশাল প্রস্তর নির্মিত মঙ্গলময় হাস্যোজ্জ্বল শিবমূর্তিতে পরিণত হয়ে গেছে । শ্বেতবর্ণ শিবমূর্তির অর্ধাংশ এবং কৃষ্ণ বর্ণ বিষ্ণুমূর্তির অর্ধাংশ জুড়ে এক অপূর্ব সুন্দর মূর্তি তৈরি হয়েছে। এত সুন্দর সেই মূর্তি যে চোখ ফেরানো যায় না।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।