কর্ণফুলির গল্প বলায় শাহজালাল সরকার

টাকার কলস
আমার নানার বাড়ি মুরাদনগর উপজেলার নেয়ামতকান্দি গ্রামে। ছেলেবেলায় মা প্রায়শই আমাদের গল্প শোনাতেন। গল্পগুলোর প্রায় অর্ধেকই ছিল ‘টাকার কলস’, ‘টাকার সিন্দুক’, ‘টাকার তাগারী’, ‘শিকলের বেড়ী’, আনয়’, ইত্যাদি সম্পর্কিত।
নানার বাড়ির পাশে মাঝারি আকৃতির একটি পুকুর আছে। মায়ের বয়স যখন দশ কি বারো, তখন নাকি নানাদের ঐ পুকুরে রাতের বেলায় প্রায়ই একটি লোহার সিন্দুক ভেসে উঠতো। সিন্দুকটির চার কোণায় চারটি জ্বলন্ত বাতি থাকতো। সিন্দুকটি বুটবুট আওয়াজ করে পানির উপরে পুকুরের চারপাশে ভেসে বেড়াতো। এর ভেতরটা নাকি টাকায় পরিপূর্ণ ছিল। এই টাকা কাগজের টাকা নয়। স্বর্ণের কিংবা রুপার কাঁচা টাকা।
আগের দিনের মানুষ নাকি এসব টাকা সিন্দুকে, তামা-কাঁসার পাত্রে অর্থাৎ, কলসিতে, ঘটিতে, তাগারীতে জমা করে রাখতো। জমা করতে করতে একসময় যখন পাত্রটি টাকায় পরিপূর্ণ হয়ে যেতো, তখন নাকি এদের উপর একপ্রকার জ্বিন ভর করতো। তখন আর সেগুলো ঘরের ভিতর থাকতো না। ঘর থেকে বের হয়ে পুকুরে, ডোবায়, জলাশয়ে চলে যেতো। আর তখন সে অবস্থায় এগুলোকে বলা হতো ‘আনয়’।
এরকমভাবে, টাকা ভর্তি পাত্রগুলো যখন আনয় হয়ে চলে যেতে থাকতো, এরপর থেকে মানুষজন এদের গায়ে শিকল লাগিয়ে ঘরের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখতো যেন, পাত্রগুলো আর চলে না যায়। তারপরেও দেখা যেতো, টাকায় পরিপূর্ণ হয়ে গেলে পাত্রগুলো শিকল টেনে পুরো ঘরসহ কিংবা ঘরের কিছু অংশ নিয়ে ভেংগে-চুরে পুকুরে বা জলাশয়ে চলে যেতো।
এসব টাকার পাত্র প্রায়শই মানুষ পুকুরে, ডোবায় জলাশয়ে বারবার ভেসে বেড়াতে দেখতো। যদি কেউ আনার জন্য অগ্রসর হয়ে ধরতে যেতো, অমনি এরা পানির নিচে ডুব দিয়ে চলে যেতো গভীরে। মানুষ যতই চেষ্টা করেছে এদের ধরার জন্য, কিন্তু কেউ ধরতে বা আনতে পারে নি কোন দিন।
বলছিলাম ঐ সিন্দুকটির কথা। সিন্দুকটির নাকি একটা লম্বা শিকলও ছিল। একাকী কেউ পুকুরে নামলে নাকি লোকটির পায়ে শিকলটি প্যাচ দিয়ে ফেলতো এবং টেনে নিয়ে যেতো পানির তলদেশে। মায়ের মুখে শুনেছি, রেজিয়া নামে দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে নাকি একদিন একাকী পুকুরে গোসল করতে নেমে ডুব দিয়েছিল। অমনি শিকল এসে মেয়েটির পায়ে প্যাচ দিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটি চিৎকার-চেচামেচি শুরু করে দিলে বাড়ির লোকজন এসে তাকে টেনে ধরে উদ্ধার করার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়েছিল। এক পর্যায়ে সে শিকলের টানে ডুবে যাচ্ছিল। এমতাবস্থায়, তাদের বাড়ির এক শক্তিশালী পুরুষ লোক এসে তার চুলের গোছা ধরে সজোরে মারেন এক হেচকা টান। আর এভাবেই তিনি মেয়েটিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন শিকলের কবল থেকে। তার পায়ে নাকি আজও ঐ শিকল পেঁচানো দাগটি রয়ে গেছে।
এরকম আমরাও ছোটোবেলায় দেখেছি, ছেলে মেয়েরা গোসল করতে নামলে পুকুরের গভীরে বা মাঝখানে যেতে চাইতো না ঐ কথিত টাকার কলস বা শিকলের ভয়ে।
নেয়ামতকান্দির পাশেই ছালিয়াকান্দি গ্রাম। ঐ গ্রামের সিকদার বাড়ির পুকুরটিতে নাকি এরকম হাজারও ঘটনা ঘটেছে। পুকুরটিতে নাকি ছিল কলস, সিন্দুক, তাগারী, ঘটি, কাঁসার থালা-বাসন, বাটি, বোল, চামচ ইত্যাদি। কোনো বিয়ে-শাদী কিংবা বড় অনুষ্ঠান হলে, ঐ পুকুরের পাড়ে কাদা মাটি দিয়ে লেপে এর উপর, কতটা বোল, বাটি, বাসন, চামচ, ইত্যাদি লাগবে এর সংখ্যা লিখে দিয়ে আসলে এর পরের দিন নাকি ঐ নির্দিষ্ট পরিমাণ সামগ্রী সেখানে উঠে বসে থাকতো। অনুষ্ঠানের কাজ শেষে দ্রব্যগুলো ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে আবার ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে আসতে হতো। কেউ যদি ভুলক্রমে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে দু’একটা আইটেম রেখে দিতো, তবে তার নাকি বড় ধরণের কোনো একটা ক্ষতি হয়ে যেতো অথবা লোকটি মারা যেতো। সিকদার বাড়ির পুকুরের ঐ সমস্ত ঘটনা আজও ছালিয়াকান্দি গ্রামের বয়স্ক লোকদের মুখে মুখে শোনা যায়।
টাকার কলসের কথা গ্রামের মুরুব্বীদের মুখে আজও আমরা শুনতে পাই। ওনাদেরকে যদি প্রশ্ন করি যে, ঐ সমস্ত টাকার কলসগুলো আজ আর দেখা যাচ্ছে না কেন? ওগুলো কোথায় গেল? এসব প্রশ্নের জবাবে ওনারা বলেন, “আগে মানুষ ছিল সহজ-সরল ও সৎ। সততার কিংবা সত্য যুগে মানুষ ঐগুলো দেখেছে। আনয় হয়ে যাওয়া জিনিসপত্রগুলো মানুষকে দেখা দিয়েছে। এখন মানুষ হয়ে গেছে অসৎ, মিথ্যাবাদী আর কুটিল। তাই ঐগুলো এখন আর মানুষের সামনে দেখা দেয়না।” আমি আসলে তাঁদের ঐ সমস্ত উত্তরে সন্তুষ্ট নই।
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে টাকার কলস, আনয় এসব ঘটনার সত্যতা ও বাস্তবতা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। বৈজ্ঞানিক থিওরির কাছে এগুলো সম্পূর্ণই অবাস্তব ও ভিত্তিহীন। তবে কি মানুষজন শুধু শুধুই মিথ্যে বলেছে? আমার মা’ও কি তাহলে মিথ্যে বলেছেন? এ বিষয়ে মনের মধ্যে কনফিউশানই রয়ে গেলো!
আমার ব্যক্তিগত জীবনে বাস্তবে দু’টো বিষয়ের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। প্রথমত, কাক যদি করুণ কন্ঠে লম্বাকরে ডাক দেয়, তাহলে কারোর মৃত্যুর সংবাদ কিংবা নিজের বা অন্যকারোর দুঃখজনক বা বিপজ্জনক কোন ঘটনা ঘটে যায়। দ্বিতীয়ত, ডান হাতের তালু চুলকালে টাকা আসে। এই দু’টি বিষয় আমার জীবনে শতভাগ সত্য হয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। কিন্তু আমার জীবনের এই সত্য ঘটনাগুলোও বিজ্ঞান এবং লজিকের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণই অবাস্তব, ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। উল্লিখিত আমার দু’টো ঘটনা যদি বিজ্ঞানমনস্ক কোনো লোকের কাছে বলি, হয়তো ওনারা আমাকে বলবেন, “কাকের ডাকের সাথে মৃত্যু সংবাদের সম্পর্ক কী? কিংবা, ডান হাতের তালু চুলকানোর সাথে টাকার সম্পর্ক কী? ” কিন্তু আমিসহ এরকম অগণিত মানুষ এগুলোর সত্যতা ও বাস্তবতা খুঁজে পেয়েছে শতভাগ! তবে কি আমরা বলতে পারিনা, বিজ্ঞান এখনও অনেক ক্ষেত্রেই সফল হতে পারে নি!
আমরা অনেকেই কুসংস্কার কুসংস্কার বলে বহু কিছুই উড়িয়ে দেই। বাস্তব কথা হলো, সব কুসংস্কারই কুসংস্কার নয়। কিছু কুসংস্কার সত্যও হয়। কাকের করুন স্বরে ডাক কিংবা ডান হাতের তালু চুলকানোর কথিত ফলাফল যদি সঠিক হয়, তাহলে টাকার কলস, আনয়, শিকল সম্পর্কিত ঘটনাগুলো কেন সত্য হবে না, এই প্রশ্নের জবাব কে দেবেন?