• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে সমীরণ সরকার (পর্ব – ৮)

সুমনা ও জাদু পালক

রান্নায় মন দেন বাদল ঠাকুর।
সুমনা বলে, দাদু, আমি ঠাকুর দালানে যাব ?
—– মন্দিরের দরজা তো বন্ধ এখন।
—- জানি ।
—– তাহলে?
——– তুমি তো এখানে ঠাকুরের ভোগ রান্না করছো, তাই ভাবলাম, এখানে না খেয়ে নাটমন্দিরের সামনের চাতালে বসে প্রসাদ টা খাই।
— ও, আচ্ছা। ঠিক আছে, যা। চলে যাস না যেন, ভোগের প্রসাদ নিয়ে যাবি।
—– আচ্ছা।
বাদল ঠাকুর খুব খুশি হন। সত্যি বিবেচনাবোধ আছে মেয়েটার। এখানে ভোগ রান্নার ঘরে বসে প্রসাদ খাবে না বলে বাইরে চলে গেল।
সরকার বাড়ির এই রাধামাধব মন্দিরটা খুব পুরনো। 300 বছরের বেশি। বাবার মুখে শুনেছে সুমনা। আগে রোজ সন্ধ্যাবেলায় গল্প শোনার জন্য বাবার কাছে আবদার করতো সুমনা। বাবা খুব ভালো রূপকথার গল্প বলতে পারত। বেঙ্গমা বেঙ্গমির গল্প, বুড়ি রাক্ষসীর গল্প, পক্ষীরাজ ঘোড়ার গল্প, রাজপুত্র , মন্ত্রীপুত্র ও রাজকন্যার গল্প ।,আরও কত গল্প বলতো বাবা। মাঝে মাঝে বাবা অন্যরকম গল্প বলতো। রামায়ণের গল্প, মহাভারতের গল্প ,রাজ রাজড়ার গল্প, ইতিহাসের গল্প -এমনি কত রকমের গল্প।
মা রাতের রান্না করতো রান্নাঘরে। ফুটন্ত ভাতের গন্ধ ভেসে আসত বাতাসে। শুকনো লঙ্কা আর রাঁধনি ফোড়নের গন্ধ ও নাকে ঢুকতো সুমনার। রাঁধনি ফোড়ন দিয়ে খুব সুন্দর ডাল রান্না করতো মা তখন। ভাতের গন্ধ আর ফোড়নের গন্ধ মিলে খিদে চাগাড় দিত সুমনার। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত সে। বাবা গল্প বলেই চলত। মা রান্না বান্না সেরে হাত ধুয়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে সুমনার পাশে এসে বসত। অমনি দু’ হাতে মাকে জড়িয়ে ধরতো সুমনা। মার শাড়িতে লেগে থাকা মা মা গন্ধটা বুক ভরে নিত ও।
মা বলতো, “আমার সোনাটার ঘুম পেয়ে গেলো নাকি?”
সুমনা মায়ের গায়ে মুখ ঘষতে ঘষতে বলত, “নাতো।”
—- তাইলে বোধহয় খিদে পেয়েছে সোনাটার।
সুমনা চুপ করে থাকত। মা তখন বাবাকে বলতো,” কিগো তোমার গল্প শেষ হতে আর কত দেরী?”
—– ছেড়ে দিলেই শেষ হয়ে যাবে।
—– মানে?
—— রূপকথার গল্পের শুরু আছে আমার হাতে, শেষটা তো নেই গো!
—–মানে?
—- পক্ষীরাজ ঘোড়া যেদিকে নিয়ে যাবে , সেদিকেই যেতে হবে ।
—— কি যে বলো তুমি ,কিছুই বুঝিনা।
হা হা করে হেসে উঠতো বাবা।
বাবার মুখে একদিন এই সরকার বাড়িতে রাধামাধব মন্দির তৈরীর গল্পটা শুনেছে সুমনা।
সে নাকি অনেককাল আগেকার কথা। সরকার বাড়ির অবস্থা তখন আজকের মত ছিল না। এই পরিবারের কোন এক পূর্বপুরুষ, নাম , চন্দ্র মোহন সরকার নাকি মাটি দিয়ে পুতুল তৈরি করতেন খুব সুন্দর।ঝুড়িতে নিয়ে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেই পুতুল বিক্রি করে সংসার চালাতেন। মজার ব্যাপার হলো, তিনি শুধু রাধাকৃষ্ণের পুতুল বানাতেন। অন্য কোন পুতুল নয় । আর সেই পুতুল নাকি এত সুন্দর হতো যে, বিক্রি হয়ে যেত খুব সহজেই।
সংসারে অভাব থাকলেও চন্দ্রমোহন এবং তার স্ত্রী দুজনেই ছিলেন খুব সৎ , অতিথি পরায়ন এবং ধর্মভীরু প্রকৃতির মানুষ।
একদিন চন্দ্রমোহন গ্রামে গ্রামে পুতুল বিক্রি করে, বাড়িতে ফিরে স্নান ,পুজো ইত্যাদি সেরে সবে খেতে বসার উদ্যোগ করছেন,এমন সময় হঠাৎ তাঁর বাড়ির সদর দরজায় কড়া নড়ে উঠলো। তাঁর স্ত্রী সদর দরজা খুলে দিতেই প্রবেশ করলেন জটাজুটধারী এক সাধু। সাধুর হাতে একটা বেশ শক্ত পোক্ত বেতের লাঠি আর কাঁধে মস্ত বড় এক ঝোলা। সাধু ঘরে ঢুকেই জানালেন যে, তিনি বহুদূর থেকে আসছেন । তিনি খুব পরিশ্রান্ত এবং ক্ষুধার্ত। একটু বিশ্রাম নিতে চান তিনি‌।
তাড়াতাড়ি একটা বড় পিতলের ঘটিতে করে একঘটি জল আর একটা গামছা এনে সাধুর হাতে দিলেন চন্দ্রমোহনের স্ত্রী। সাধুর হাত-পা ধোয়া হলে তাঁকে আসন পেতে বসতে দিলেন ।কিন্তু সাধুকে কি খেতে দেবেন ভাবছিলেন তিনি। কারণ, স্বামীকে থালাতে ভাত সাজিয়ে দেবার পর তার নিজের জন্য খুব সামান্য পরিমাণ খাবার অবশিষ্ট ছিল সেদিন। চন্দ্রমোহন স্ত্রীর ইতস্তত ভাব দেখে সবটাই বুঝতে পারলেন। তিনি খাবার সাজান নিজের থালাটি সযত্নে নামিয়ে দিলেন সাধুর সামনে । সাধু পরিতৃপ্তি সহকারে আহার করলেন।
চন্দ্রমোহনের বাড়িতে দিন দুয়েক আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন সাধু। উনি এসেছিলেন সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে। যাচ্ছিলেন শ্রীধাম পুরুষোত্তম তীর্থ দর্শনে। চন্দ্রমোহন ও তাঁর স্ত্রীর ব্যবহারে খুব সন্তুষ্ট হন সেই সাধু ।যাবার সময় উনি তার ঝোলা থেকে একটি অপূর্ব কষ্টি পাথরে তৈরি রাধামাধব বিগ্রহ দিয়ে যান চন্দ্রমোহন এর হাতে।
সাধু চন্দ্রমোহনকে নির্দেশ দেন, বিগ্রহ কে গৃহে প্রতিষ্ঠা করে ভক্তি সহকারে পুজো করার।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।