সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (একপঞ্চাশৎ পর্ব)

–” এই রাত্তিরে একা একা কোতায় চইললে ঠাকুর! ”
কৃষ্ণভামার গানটা শোনার পর থেকে এক গভীর চিন্তা আমাকে ছেয়ে ফেললো। সত্যিই তো! কে আমরা? আমরা যে সেই বিরাট শিশু, যিনি আপনমনে আত্মভোলা হয়ে এই বিরাটকার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ে নিত্য খেলা খেলছেন আপন হাতের তালুতে নিয়ে, বাউলনির গানে সেই শিশুকে প্রত্যক্ষ করলাম। এর আগে কতবারই তো শুনেছি এই গানটা, কিন্তু গানটা এমনভাবে কখনও ধরা দেয় নি আমার মননে।
বাইরের আকাশে আজ তারার মেলা বসেছে। অষ্টমীর চাঁদ সেই হাটে এসে হারিয়ে গেছে। চাঁদ আর তারাদের আড্ডায় আজ যেন আমার আমন্ত্রণ। হাল্কা দুধ আলোয় এক অদ্ভুত সুন্দর মায়ালোক যেন নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে। দূরের খড়ে ছাওয়া বাড়িগুলোর জানালা থেকে চুরি করে বেরিয়ে আসা আলোরা এসে সেই ঐকতানের মজলিসে গুটিগুটি পায়ে বসেছে শ্রোতার আসনে।
রাতের পথে যে গাছেদের ছায়ারাও এসে চুপিসারে দাঁড়ায়, সেই উপলব্ধি আমার এতোদিন ছিলো না। আজ দেখলাম সেই অপূর্ব দৃশ্য। দুধের সরের মতো ভেসে থাকা আলোয় পথের দু’ধারের গাছেদের তলায় এক মোহিনী ছায়া লুকোচুরি খেলছে।
কানাইদার বাড়ি থেকে কখন যে আনমনে এসে পথে পা বাড়িয়েছি, খেয়াল করিনি।
–” সারাদিন একবারের তরেও কি এই পোড়ারমুকীরে মনে পড়েনি? ”
এখন, এইমুহূর্তে আমার উর্ধ্বমুখী মন ভেসে চলেছে পৃথিবী ছাড়িয়ে অজানিতের পথে, ছায়াপথের কক্ষে। বাউলনির কথাগুলো আমি শুনলাম বটে, কিন্তু অবধান করতে পারলাম না। দুটো পা এগিয়ে চললো। এই মুহূর্তে চলার মালিক যে আমি নই, সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম।
এই ক্ষ্যাপাদের রাজত্বে এসে মন বুঝি প্রকৃতই বাউল হয়ে যায়।
–” তারায় তারায় উড়ে বেড়ায়
মাটিতে সে নামে না
মন বলে আমি
মনের খবর জানি না..”
এই না হলে ভাবের জগৎ! দূরের জানালার আলোর সাথে জড়াজড়ি করে সুর ভেসে আসছে।
–” কী গো! এতো কী অপরাদ করেচি আমি? একটা কতাও কি আমার সাতে কইতে নেই? ”
ডান হাতের বাহুতে একটা মেয়েলি স্পর্শ আমাকে ত্বরিতে মাটিতে নামিয়ে আনলো। আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁর দু’চোখের কোণে টলমল করছে অশ্রুবিন্দু। আলুলায়িত চুল এসে ছড়িয়ে পড়েছে সারাটা পিঠ জুড়ে। সেই শরীরের ছায়া এসে স্পর্শ করেছে আমার শরীরের ছায়াকে। আমি আলতো করে আমার হাত থেকে সেই মায়ামানবীর হাতকে মুক্ত করলাম।
ঝরঝর করে নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে লতিয়ে পড়লো বাউলনির শরীর। সমস্ত চরাচর স্তব্ধ হয়ে গেলো। নিস্তব্ধ আকাশে ভেসে থাকা নক্ষত্রমন্ডলী, তার নীচে বিশালাকার বৃক্ষ আদি, এতক্ষন যে পরস্পরের সাথে আলাপচারিতায় মগ্ন ছিলো তাদের মর্মরধ্বনিতে, সে ধ্বনি মুহূর্তমধ্যে বাক্যহারা হলো। নিশাচর পাখি আদি যাদের প্রেমকূজনে মগ্ন ছিলো রাতের পৃথিবী, এমনকি তাদের ডানা সঞ্চালনের আওয়াজও পলকে হারিয়ে গেলো নিঃশব্দতায়।
আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম। এতোটা নিষ্ঠুরভাবে তার হাত ছাড়িয়ে না নেওয়াই যে উচিত ছিলো, এই নৈঃশব্দ্য যেন তারই প্রতিবাদ। আমি নীচু হয়ে তার দু’কাঁধ স্পর্শ করলাম। ধরে তুললাম কান্নাভারে লুটিয়ে পড়া মালতিলতা।
দু’জন দু’জনার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলাম। তার দু’চোখের তারায় প্রতিফলিত হচ্ছে রাতের আকাশ।
হঠাৎ যেন মাথার ওপরের গাছের ডাল থেকে কোনো এক পুরুষকন্ঠ ভেসে এলো, সে অন্য কোনও একজনকে জিজ্ঞাসা করছে —
কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং ভবতীতি?
উত্তরে এক নারীকন্ঠে উত্তর এলো —
দ্বে বিদ্যে বেদিতব্য ইতি হস্ম যদব্রহ্মোবিদো বদন্তি পরা চৈবাপরা চ।
চকিতে ওপরের দিকে চাইলাম। কোনোকিছুই দৃষ্টিগোচর হলো না। শুধু স্তব্ধ হয়ে থাকা বৃক্ষশাখায় দোল লাগলো। মলয়ানিল বইতে শুরু করলো, মর্মরধ্বনিতে বৃক্ষ আদি ফের বাক্যালাপ শুরু করলেন, খেচর আদির পক্ষ সঞ্চালনের শব্দ গোচরীভূত হলো।
বুঝলাম পুরুষশক্তির এমন কোনো ক্ষমতা নেই যে একা একাই অপরাশক্তির অধ্যয়নকাল শেষ করে পরাশক্তির উৎস সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। বিদ্যা ও অবিদ্যা, দু’য়েরই আধার নারী। আর তারই প্রতিফলন ঘটতে দেখলাম এই মোহিনী নারীর দু’চোখে।
বুঝলাম জাগতিক সমস্ত কর্মের শেষে মহাজাগতিক কর্মসাধন করার যাত্রাপথে পাড়ি জমানোর জন্য যে প্রধান অবলম্বন, সে অবলম্বন হলো এই নারীশক্তি। মুন্ডক উপনিষদের এই স্লোকদুটো জানতাম, কিন্তু এই মুহূর্তে এই তারাভরা খোলা আকাশের নীচে দাঁড়ানো রমণী মূর্তির দু’চোখে আমি যে এতো সহজে অবলীলায় শ্লোক দুটোকে প্রত্যক্ষ করলাম, সেও বুঝি তারাপীঠের এই রক্তমাংসে জারিত মহাকোটি সাধনস্থলের মাটির মাহাত্ম্য।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।