সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ৩০)

দেবমাল্য
— ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন।
দেবমাল্যর দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসারটি বললেন, আপনি ডাকেননি?
— কেন ডাকব না? ডেকেছিলাম। একবার দু’বার নয়, বেশ অনেক বার। আমার মনে হয় ও শুনতে পায়নি।
— একটা ফোন করতে পারতেন তো। সঙ্গে মোবাইল ছিল না?
— ছিল তো… ওটাই খুঁজতে গিয়ে দেখি, নেই।
— ছিল। নেই। মানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
— আমার মনে হয়, সকালে যখন ট্রেনের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, তখন বোধহয় মোবাইলটা পড়ে গেছে বা কেউ তুলে নিয়েছে। অথবা… বুক পকেটে ছিল তো… বলেই, রণোর দিকে তাকাল ও। তোমাদের বিছানাতেও পড়ে থাকতে পারে… ওখানে শুয়ে ছিলাম তো!
রণো বলল, আপনাকে ট্রেন থেকে নামানোর পর আমি কিন্তু আপনার কাছে কোনও মোবাইল দেখেনি।
পুলিশ অফিসারটি বললেন, সে ঠিক আছে, মোবাইল হারাতেই পারে। কিন্তু আপনাদের সঙ্গে তো গাড়ি ছিল। একটা সাইকেল রিকশাকে ধরতে পারলেন না?
রণো বলল, ধরেছিলাম তো… ওনাকে জিজ্ঞেস করুন।
দেবমাল্য বলল, হ্যাঁ। ওই সাইকেল রিকশাটা খুঁজতে খুঁজতে আমরা এগোছিলাম তো, হঠাৎ লুকিং গ্লাসে দেখি, আমাদের গাড়ির পেছনে ও।
— সাইকেল রিকশায়?
— হ্যাঁ।
— তার পর?
— রণোকে বলতেই সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটাকে সাইড করে ও দাঁড় করিয়ে দিল। নেমে পেছন ফিরে দেখি, সব ভোঁ ভাঁ। ও তো নেই-ই। একটাও সাইকেল রিকশা নেই।
— ওর গাড়ি দাঁড় করানো আর আপনার নামা— এই সময়ের মধ্যে ওই সাইকেল রিকশাটা আপনাদের গাড়ির অন্য পাশ দিয়ে চলে যাইনি তো?
— না।
— এটা কী করে বলছেন?
— কারণ, ওই সাইকেল রিকশাটাকে পেছনে দেখতে না পেয়ে আমি শুধু সামনে নয়, আশপাশে, এদিকে ওদিকে, সব দিকেই খুব ভাল করে দেখেছিলাম। কিন্তু দেখতে পাইনি।
— তা হলে কি ডানা মেলে উড়ে গেল?
রণো বলল, আমি তো সেটাই বলছি। তাও, একজন হলে না হয় মনকে বুঝ দেওয়া যেত, কিন্তু একসঙ্গে দু’-দুটো মানুষ…
— দুটো মানুষ মানে? সঙ্গে আর কেউ ছিল নাকি?
একটু ইতস্তত করে দেবমাল্য বলল, হ্যাঁ।
— কে?
— সামশের।
— সেটা আবার কে?
— আমার কারখানারই একটা ছেলে।
— বয়স কী রকম?
দেবমাল্য বলল, আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট হবে।
— স্বভাব-চরিত্র কেমন?
— খুব ভাল।
— বিশ্বস্ত?
— ভীষণ।
পুলিশ অফিসারটি বললেন, কত দিন ধরে চেনেন?
— খুব ছোটবেলা থেকেই। আমাদের পরিবারেরই একজন বলতে পারেন। কিন্তু আজ ওকে এখানে দেখে আমার কেমন যেন একটু সন্দেহ হচ্ছে…
— কী রকম?
— কারণ, আমার বউকে ট্রেনে তুলে দিয়ে কাল রাতে ফোন করে ও-ই আমাকে বলেছিল, এইমাত্র ট্রেন ছেড়ে দিল। তার সঙ্গে পইপই করে বলেছিল, চারটে নাগাদ বহরমপুরে ট্রেন ঢুকবে। আমি যেন তার আগেই স্টেশনে পৌঁছে যাই।
— এর মধ্যে আর একটা কাণ্ড ঘটেছে। মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটল রণো।
পুলিশ অফিসারটি ভ্রু কোঁচকালেন— কী?
— আমরা যখন খুব ভোরে ওনার বউকে আনতে যাওয়ার জন্য স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি ওনার বউ একটা জিপে করে স্টেশনের দিক থেকে এসে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল।
— সে কী! কখন?
— চারটের আগেই। তখন বুঝি পৌনে চারটে-টারটে হবে।
— তার মানে তখনও বহরমপুরে ট্রেন ঢোকেনি?
— না। ট্রেন তো আজ পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেটে ঢুকেছে।
আপনারা তখন কী করলেন? দেবমাল্যর দিকে তাকালেন পুলিশ অফিসারটি। দেবমাল্য বলল, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘুরিয়ে আমরা ওই জিপটার পিছু নিলাম।
— তার পর?
— অনেকটা ছুটে গেলাম। এক-দেড় মাইল তো হবেই।
— তার পরে?
— গিয়ে দেখি গাড়িটা নেই।
— তার মানে!
— আমরা তো সেটাই ভাবছি। আর তার চেয়েও বড় কথা কী জানেন, আমি দৌলতাবাদে যে হোটেলটায় উঠেছি, কাল রাতে সেখানে খুব গুলিগালা চলেছে।
— দৌলতাবাদে তো? হ্যাঁ, খবর পেয়েছি। দু’জন অ্যারেস্টও হয়েছে। ও সব এখানে চলবে না। তার পর?
— তা, ব্যাপারটা কী, দেখার জন্য জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি, পেছনের রাস্তাটা একেবারে শুনশান। একটা কুকুর-বেড়ালও নেই। সেখানে একটা ল্যাম্পপোস্টের নীচে বোরখা পরা দু’জন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের দৃষ্টি আমার জানালার দিকে।
— সেটা আপনার মনের ভুলও হতে পারে। আর তারা যদি তাকিয়েও থেকে থাকে, তার সঙ্গে আপনার বউ মিসিং হওয়ার সম্পর্ক কী?
— ওই দু’জনই তো আমার বউয়ের সঙ্গে ছিল।
— কখন?
— সকালে। ওই জিপটার মধ্যে। ড্রাইভারের পেছনের সিটে ওরা বসেছিল। দু’পাশে দু’জন। আর ওদের মধ্যিখানে আমার বউ।
— আপনি তাদের চেনেন?
— চিনব কী করে? দেখিইনি কোনও দিন।
পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞেস করলেন, জিপটার নম্বর নিয়েছিলেন?
— নম্বর নেব কী? এত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটল, নম্বরটা টোকার কথা মাথাতেই আসেনি। আসলেও টুকতে পারতাম কি না সন্দেহ আছে
— কেন?
— গাড়িটা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল যে…
— ঝড়ের বেগে?
— তা হলে আর বলছি কী?
— আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?
— পর্টিকুলারলি কাউকে… বলেই, পুলিশ অফিসারটির পেছনের জানালার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল দেবমাল্য। সন্দেহজনক মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করতে লাগল এবং বিশেষ কাউকে চিহ্নিত করার আগেই ফের আর একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল সেই পুলিশ অফিসারটি, আপনার কি কোনও শত্রু আছে?