T3 || ১লা বৈশাখ || বিশেষ সংখ্যায় শম্পা সাহা

পুরুষ ও প্রকৃতি

রাত যত গভীর হয়, তত শরীরে অস্বস্তি শুরু হয় রথীনের। কেন জানে না, তবে হয়! কী একটা অজানা অচেনা অনুভূতি গ্ৰাস করতে থাকে ওর অস্তিত্ব। চুপটি করে শুয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে যেন মনে হয় , ও আর ও নেই! ওর মধ্যে ভর করেছে অন্য কেউ, অন্য কারো ইচ্ছেরা, অন্য কারো ভয়াবহ শখেরা! ও বুঝতে পারে, ধীরে ধীরে ওর চামড়া বদলে যাচ্ছে, ওর শারীরিক গঠন বদলে যাচ্ছে, ওর মুখের আদল বদলে যাচ্ছে! ওর ইচ্ছেরা হয়ে উঠছে বড্ড বেশি আদিম, বড্ড বেশি প্রাকৃত!
একটা বাস ছুটে চলেছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এটা ঠিক জঙ্গল না। জঙ্গলের বুক চিরে চলে গেছে ন্যাশনাল হাই ওয়ে। যাতে সারাদিন হয়তো তেমন লোকজন, গাড়িঘোড়ার দেখা নেই কিন্তু রাত বাড়লেই যত অবাধ্য ট্রাক তাদের ভারী শরীর আর অন্ধকারে জ্বলতে থাকা চোখ নিয়ে, অন্ধকার আর নৈঃশব্দ্যকে ফালাফালা করে এগিয়ে যায় রণচন্ডির দিকে! এই হঠাৎ আলো আর বেহিসাবি শব্দেরা যেন অন্ধকার আর নৈঃশব্দ্যকে বড় বেশি প্রশয় দেয়, আর তাইতো একটা একলা আলোকে যেন ঠাট্টা করে চাপ চাপ অন্ধকার! দুপাশের ঝুপড়ি শালগাছের বন্ধুবর্গ এক যোগে এখানে কয়েকশ বছর ধরে! কেউ কাটে না, কেউ ছোঁয় না! মানুষের অসীম লোভ এখানে হার মানে প্রকৃতির ঘেরাটোপে। তাই দিনের বেলাতে, যখন সারা বীরভূম বাঁকুড়া জুড়ে সূর্যের তান্ডব, সেই সময়েও এই বনের আনাচে কানাচে সাপের গায়ের হিলহিলে শীতলতা পাক খেয়ে বেড়ায়! এ জঙ্গলে পাখিদের ডানা ঝাপটানোও যেন ভারি সন্তর্পণে!
বরাবরের সাহসী আর ভবঘুরে রথীন সময় সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে পথে পথে। যদিও ব্যাঙ্কের চাকরিতে খুব যে ছুটি ছাটা পায় এমন নয়। শনি রবিবারের ছুটিতে তেমন অবসর কই যে কোনো নিরিবিলি নদীর ধারে বসে বুনো ঘাসের গন্ধে নাক ডুবিয়ে চোখ দিয়ে শুষে নেবে ডুবন্ত সূর্যের “শান-ও-সৌকৎ”! হ্যাঁ, ডুবে যাওয়া সূর্যের আভিজাত্য আর গাম্ভীর্য বড় মোহময় লাগে রথীনের, সঙ্গে ঘরে ফেরা পাখিদের ডানার শব্দ! তাই তিনচার দিনের অবসর ওকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়, অচেনা, অজানা কোনো পাহাড়ি জঙ্গলে বা নাম না জানা নদীর সহজ সরল বাঁকে। যেখানে প্রকৃতি তার ঘোমটা খুলে দাঁড়ায় রোজ, একেবারে লাজহীনা নারীর মত। ও তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে সে আদিম সৌন্দর্য। বরাবর প্রকৃতির প্রেমে এমন মশগুল ও যে, কোনো নারীর প্রতি আর কোনো আকর্ষণ ওর কোনোদিন গড়ে উঠলো না!
সেবার রণচন্ডি যাবার ইচ্ছে ওকে ছুটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বরাবরের মত। পয়লা বৈশাখের আগে আগে, হঠাৎই কয়েকটা ছুটি সাথে শনি রবি মিলে বেশ দিন চারেকের অখন্ড অবসর। ওর ব্যাগ প্যাকডই থাকে সারা বছর। তাই শুক্রবার অফিস থেকে ফিরেই বেরিয়ে পড়ে রাতের ট্রেনে! তারপর সারারাত প্রায় ট্রেনে কাটিয়ে শালতোড় স্টেশনে ওকে নামিয়ে দিয়ে এগিয়ে যায় ট্রেনটা, আর ও ছুটতে থাকে পাগলের মত আদিমের টানে। তাই ওই পথে একাই হাঁটা দেয় অন্ধকার পথ ধরে। স্টেশনটা প্রায় না থাকার মত। দুয়েকটা চায়ের দোকান, স্টেশন লাগোয়া, তাই দু পা হাঁটলেই স্টেশন ঘেঁষা সেই পিচের পথ! কিছুদূর যেতেই হঠাৎ একটা ট্রাক পেয়ে উঠে বসেছিল তাতে। ড্রাইভার বোধহয় এই পথে পথিক তুলতে অভ্যস্ত নয়, কিন্তু রথীনের কথায় কেন জানি না রাজী হয়ে যায়। তারপর ড্রাইভারের পাশে বসিয়ে হু হু করে ছুটতে থাকা ট্রাক, তার সামনের হেড লাইটের আলোয় যতটা দেখা যায় তাতে রথীন বড় খুশি। এই তো তার চাই, একেবারেই আদিম প্রকৃতি, যেখানে মানুষের গায়ের গন্ধও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বেশ মিনিট চল্লিশেক যাবার পর ওর হঠাৎ প্রকৃতির ডাকে সারা দেওয়ার প্রয়োজন পরে। ড্রাইভার কে বলায়, সে মোটেও রাজী হয়না, এই জঙ্গলের মধ্যে তার বাহন থামাতে। কিন্তু রথীনের তলপেটে চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বুনো গন্ধ খুব কাছ থেকে নেবার তাড়নায় ও নেমে পড়ে মাঝ রাস্তায়। ড্রাইভার রাজী হয় না ওর জন্য অপেক্ষা করতে। অগত্যা তাকে বিদায় জানিয়ে নেমে পড়ে ও একাই সেই অন্ধকারের রাজত্বে! নামার আগে শেষ মোবাইলে দেখে রাত আড়াইটে!
আকাশে তখন হাজার তারা! চৈত্রের শেষ, বাতাসে আগুনের হলকা দিনের বেলায়, বিশেষ করে এই রাঢ় এলাকায়। কিন্তু এখন রথীন যেন বাড়ির এ সি তে! যার তাপমাত্রা সহন সীমার চেয়ে বেশ খানিকটা কম! ওর বেশ শীত শীত লাগে। হালকা হয়ে সোজা রাস্তা ছেড়ে হাঁটতে থাকে সোজা জঙ্গলের ভিতর। রণচন্ডি মন্দিরে সোজা গেলেও যাওয়া যায়, কিন্তু ওর ইচ্ছে সেই মন্দিরে পৌঁছানোর আগে কিছুটা জঙ্গল শুষে নেওয়া! তাই ডায়ে রাস্তা সমান্তরাল রেখে হাঁটতে থাকে সোজাসুজি।
চারিপাশের সোজা শালের গুঁড়ি আর হঠাৎ হওয়া কাঁটা গুল্মের তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগে! রথীন বুক ভরে টেনে নেয় খানিকটা প্রকৃতি। কিছুটা যেতেই এক অন্য রকম গন্ধ ওর নাকে এসে‌ লাগে, অনেকটা ল্যাভেন্ডারের মত! এই এলাকায় ল্যাভেন্ডার! তাও এই সময়ে! রাতের অন্ধকার এখন অনেকটা চোখ সওয়া, তবু ফুলের সৌন্দর্য দেখার জন্য যথেষ্ট নয়। ও পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে। টর্চের আলোয় দেখে সামনের প্রায় এক কাঁটা ঝোপ আলো করে ফুটে রয়েছে থোকা থোকা নীল ফুল। এ ওর কোনো চেনা ফুল তো নয়। ও নাইট মোড অন করে কয়েকটা ছবি তুলে রাখে। নাক ভরে টেনে নেয় অচেনা ফুলের সুবাস! আঃ! আঃ ! এ তো স্বর্গীয়! কী ফুল এ! এমন মাদকতা!
রথীনের চোখ বুজে আসে ভালোলাগায়! যেন নেশা কোনো! ও ওর পিঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখে নীচে । তারপর দুই হাত বাড়িয়ে থোকা ধরে ডেনে আনে ডাল , শুঁকতে থাকে পাগলের মত! কত ক্ষণ টানে ওর মনে নেই। আকাশে চৈত্রের চাঁদ বৈশাখীর আবাহনে অনেক বেশি উজ্জ্বল, অনেক বেশি প্রাণবন্ত। সামনের রণচন্ডি মন্দির, যা আজ পরিত্যক্ত কয়েক দশক, হঠাৎ মানুষ বলির ঘটনা চাউড় হবার পর। সেই পথে কতটা এগিয়েছে ও জানে না! সেই মুহূর্তে মনে হয়, ব্যাঙ্কের অফিসার রথীন লাহিড়ী নয়, ও যেন এই শালের জঙ্গলের এক অন্যতম সদস্য। যে এইখানে দাঁড়িয়ে আছে আজ কয়েক শত। ওর শরীরে যেন পোষাক নেই, ওর হাত নেই, মাথা নেই, বদলে কিছু ডালপালা আর পাতা! ওর পা নেই, বদলে এক শক্ত গুঁড়ি। ওর গায়ের ওপর বেয়ে বেড়াচ্ছে শতেক কালো লাল পিঁপড়ে, আরো অনেক বুনো পতঙ্গেরা! ওর দুহাত, ওর শাখা প্রশাখা তুলে দেয় আকাশের দিকে। ওর চারিপাশে ঘিরে থাকে সেই নীল ফুলের তীব্র বুনো সুবাস। ওর বুকের ভেতরের ঘুমিয়ে থাকাপুরুষালি প্রেম, ওর শরীরের ভেতরের জেগে থাকা কামুক শরীর তার শিকড় বাড়িয়ে দেয় সোজাসুজি প্রকৃতির গভীর গহনে। ওর যৌন তৃপ্তি যেন প্রকৃতির বুক খুঁড়ে! সেই মুহূর্তে ও আর রথীন নয় একটা গোটা প্রকৃতি প্রেমিক পুরুষ, যার প্রেয়সী প্রকৃতির সঙ্গে সে মৈথুনে রত!
রথীনকে খুঁজে পাওয়া যায় প্রায় দুদিন পরে, চেতনাহীন অবস্থায়, তাও ওর মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে, রণচন্ডি মন্দিরের চাতালে! কে বা কারা যেন ওকে টেনে নিয়ে এসেছে এখানে। এই মন্দিরে এক সময় নর বলি হতো। প্রচলিত, নতুন বছরের শুরুতে, এই জঙ্গলের পথে হারিয়ে যাওয়া পথিককে ধরে এনে বেঁধে রাখা হতো। আর ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বলি দিয়ে সেই বলির রক্তে মায়ের বেদি আর চরণ কমল ধৌত করে শুরু হতো এই এলাকার নতুন বছর। পরে তা বন্ধ হলেও আগের রাতের পথহারা পথিক পেয়ে হয়তো আবার সে রাতের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চেয়েছিল কেউ! পুলিশ এসে উদ্ধার করে ওকে, এবং পুলিশের ধারণ তাই। হয়তো মাদক দিয়ে বলির জন্যেই রথীনকে আটকে রাখা হয়। কিন্তু কেন বলি দেওয়া হয়নি তা নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামায়নি!তারপর বহুদিন হাসপাতালে থাকার পর বাড়ি! কিন্তু বাড়ি ফিরে দিনের বেলা ওর রথীন থাকলেও রাত বাড়লেই ও যেন ফিরে যায় সেই শালের জঙ্গলে। যেখানে ও ওর শিকড় বাড়িয়ে শুষে নেয় মাটির বুকের গভীরে থাকা সকল নারীত্ব! সেখানে ও বড় বেআব্রু, বড় বেশিই আদিম! তারপর থেকে চৈতী রোদ আর চৈত্রের চাঁদ ওর কাছে আগামী নতুন বৈশাখ নয়, বরং ফিরে যাওয়া আদিম পুরুষে, যে প্রকৃতির প্রথম প্রেমিক, প্রথম শোষকও বটে!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।