সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ৩)

কেমিক্যাল বিভ্রাট

ওই সিটটা যাঁর ছিল, উনি নিশ্চয়ই তাঁকে অনেক বার ডাকাডাকি করেছিলেন। কিন্তু তিনি না ওঠায় বাধ্য হয়েই উনি বোধহয় উপরের সিটে গিয়ে শুয়েছিলেন। পর দিন যখন চোখ মেলে তাকালেন, দেখলেন, তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন।

ডাক্তাররা বললেন, আর পি এফের জোয়ানরা টহল দেওয়ার সময় তাঁকে নাকি অচৈতন্য অবস্থায় ট্রেনের মধ্যে থেকে উদ্ধার করেছেন। খানিক বাদে দু’জন পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, কে কোথায় কখন আপনাকে কী খেতে দিয়েছিল? বললেন, এত করে বারবার বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হচ্ছে, অচেনা-অজানা-অপরিচিত কোনও যাত্রীর দেওয়া কোনও খাবার কেউ কখনও খাবেন না, তবু খেলেন? আপনারা শিক্ষিত মানুষেরা যদি এ সব করেন, তা হলে বাকিরা কী করবেন বলুন?

না। ঔপমানব বলতে পারেননি, দু’-চার জন খারাপ লোক কবে কাকে কী খাইয়ে অচেতন করে সর্বস্ব নিয়ে চম্পট দিয়েছে, তার জন্য পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে অবিশ্বাস করব? সন্দেহ করব? বলতে পারেননি, কারণ বলার মতো অবস্থায় তিনি তখন ছিলেন না।

তবু ভাল, সুস্থ হতে তাঁর বেশি দিন লাগেনি। দু’দিন পরেই হাসপাতাল থেকে তিনি ছাড়া পেয়েছিলেন। শুধু পাননি লোয়ার বাঙ্কের নীচে রাখা তাঁর একমাত্র লাগেজটা। না, জামাপ্যান্ট বা টাকা-পয়সার জন্য নয়, তিনি ভেঙে পড়েছিলেন ওই লাগেজের ভেতরে অতিযত্নে রাখা একটি গবেষণাপত্রের জন্য। যেটা তাঁর বহু বছরের সাধনার ফসল। যেটার ওপর তাঁর অনেক কিছু নির্ভর করছে। ইচ্ছে করেই তিনি তার কোনও ফোটোকপি করেননি। ওটা নিয়ে গিয়েছিলেন লন্ডনের ‘নেচার জার্নাল’-এ পাঠানোর আগে জগন্নাথদেবের চরণে একবার ছুঁইয়ে আনার জন্য।

এ বার তাই ট্রেনে উঠেই তিনি সদাসতর্ক ছিলেন। তিনটে লাগেজের কোনওটাতেই সে রকম কোনও গুরুত্বপূর্ণ কিছু না থাকলেও ঔপমানব ঠিক করেছিলেন, ছেলে-বউ আর তিনি পালা করে ঘুমোবেন। কিন্তু নামার সময় তাঁর চক্ষু একেবারে চড়কগাছ। দেখেন, লোয়ার বাঙ্কের নীচে তাঁদের লাগেজগুলির সঙ্গে আরও একটা লাগেজ। আর সেই লাগেজটা অন্য কারও নয়, তাঁরই। যেটা দু’বছর আগে খোয়া গিয়েছিল, সেটা। তার হ্যান্ডেলে একটা ট্যাগ লাগানো। আর তাতে কাঁপা কাঁপা অক্ষরে বড় বড় করে লেখা— সরি।

তো, আজ সকালে পুরী থেকে সপরিবার ফেরার পরে চা খেয়েই বাজারে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। এ ক’দিন ছিলেন না। ফলে না-ফ্রিজে, না-ঝুরিতে, কোথাও কোনও শাক-সবজি ছিল না। মাছ মাংস তো দূরের কথা। একটা ডিমও ছিল না। এমনিতে সপ্তাহে দু’বার বাজারে যান তিনি। কিন্তু বাড়ি ফিরে হারানো লাগেজটা খুলে ইনট্যাক্ট সব কিছু দেখে, বিশেষ করে ওই গবেষণাপত্রটি পেয়ে তিনি এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, প্রচুর বাজার করে ফেলেছিলেন। বাজার থেকে বেরিয়ে দু’হাতে ঢাউস ঢাউস দুটো ব্যাগ নিয়ে অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও যখন কোনও রিকশা পেলেন না, তখন হঠাৎ তাঁর মনে হল, দামি দামি শুধু নয়, অমূল্য জিনিসও যখন অবলীলায় আজকাল ফেরত পাচ্ছি, তখন এ তো সামান্য বাজার, আমি যদি ইচ্ছে করেও ব্যাগ দুটো রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যাই, আমার বিশ্বাস, কেউ না কেউ ঠিকই বাড়িতে এসে ওটা ফেরত দিয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় দেবে?

মাথার মধ্যে প্রশ্নটা উঁকি মারতেই জবালার লিখে দেওয়া বাজারের ফর্দর নীচের সাদা অংশটা ছিঁড়ে, যাতে আবার কিনে না ফেলেন, সে জন্য কেনার সঙ্গে সঙ্গে যেটা কেনা হল, তার পাশে টিক মার্ক দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে নিয়ে আসা কলম দিয়ে নিজের নাম, ঠিকানা লিখে উপচে-পড়া ব্যাগের ওপরে রেখে যখন ভাবছেন, যা হাওয়া দিচ্ছে, কাগজটা আবার উড়ে যাবে না তো! তখন দেখেন, পাঞ্জাবির পকেটে রাখা টাকা-ভর্তি ব্যাগটা এত ভারী যে, তার জন্য তাঁর কাঁধ থেকে পাঞ্জাবিটা নেমে নেমে যাচ্ছে।

তাই ওই মানিব্যাগটা বার করে চিরকূটটাকে চাপা দিয়ে রাখলেন। তার পর, কারও যাতে যাতায়াতের অসুবিধে না-হয়, সে জন্য রাস্তার এক ধারে ব্যাগ দুটো রেখে তিনি বাড়ি চলে এসেছিলেন।

না, দশ মিনিটও হয়নি। তার আগেই কলিংবেলের শব্দ। দরজা খুলতেই আঠারো-উনিশ বছরের একটা গাট্টাগোট্টা ছেলে। কাকে চাই? জিজ্ঞেস করার আগেই ছেলেটি তাঁর নাম জানতে চাইল। তার পরে বলল, আপনি বোধহয় বাজারের এই ব্যাগ দুটো রাস্তার উপরে রেখে এসেছিলেন? তাই নিয়ে এলাম।

ব্যাগ দুটো নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই জবালা বললেন, বাজারের সঙ্গে সঙ্গে মানিব্যাগটাও রেখে এসেছিলে?

ঔপমানব বললেন, কী করব? পাঞ্জাবির যে দিকের পকেটে ওটা রেখেছিলাম, মানিব্যাগের ভারে সে দিকের পাঞ্জাবিটা যে বারবার কাঁধ থেকে নেমে যাচ্ছিল, তাই… কত বার তোলা যায়, বলো?

ঔপমানবের বউ একেবারে তাজ্জব হয়ে গেলেন। তাঁর স্বামী না-হয় এটা করতে পারেন। যে-লোক বাজার করতে বেরিয়ে চিড়িয়াখানায় ঘুরতে চলে যান, যে-লোক চেকে সই করতে গিয়ে ভুলে যান, তাঁর নাম কী, যে-লোক ছেলেকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে গিয়ে নিজের ছেলে মনে করে ভুল করে অন্য একটা ছেলেকে বাড়ি নিয়ে আসেন, তাঁর পক্ষে এ সব সম্ভব। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে? সবাই হঠাৎ করে তাঁর মতো হয়ে গেল কী করে! তাঁর মতো হল, না সত্যি সত্যিই সবাই ভাল হয়ে গেল! ভাল হলে তো ভাল কথা। কিন্তু হঠাৎ করে এত ভাল হল কী করে! কী করে! কী করে!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।