ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব – ৮)

তীর্থ ভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

রাঢ়ে তথা বীরভূমে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও লোকধর্মের সমন্বয়ে দুর্গা, কালী, মনসা প্রভৃতি দেবীগণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সূর্যের স্থান নিয়েছিল বিষ্ণু এবং ধর্মরাজের উপাসনা। অন্যদিকে নানা মুনির নানা মত থাকলেও রাঢ় দেশ তথা বীরভূমের আদিম অধিবাসী নিষাদগণ। এরপর দ্রাবিড়, তারপরে আসেন কিরাতগণ। দ্রাবিড়গণ ছিলেন লিঙ্গ মূর্তি শিবের পূজক। দ্রাবিড়দের প্রভাবে সারা বীরভূমে বৃষবাহন শিবের পূজা জনপ্রিয় হয়েছিল।
বীরভূমে পৌরাণিক ও লোকায়াত দেবীগণের মধ্যে দুর্গা কালী বাসুলি মনসা যোগাদ্যা সর্বমঙ্গলা চিন্তামণি ইত্যাদি বহুকাল ধরে পুজিত হয়ে আসছেন। দেবীর প্রাচীন রূপটি শৈলসুতার মধ্যে সযত্নে ধরা আছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি শিবের শক্তি। বীরভূম জুড়ে কালিকা অত্যন্ত জনপ্রিয়। কালী একদিকে যেমন ভয়ঙ্করী অপরদিকে তিনি অভয়প্রদায়িনী। শাক্ত সাধক গণ দেবীকে ব্রহ্ম জ্ঞানে আরাধনা করেন–‘সাধকানাং‌ হিতার্থায় ব্রহ্মণি রূপ কল্পনা’।
শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে অতীতে বাংলায় ধর্মমতে দেবীগণের স্থান ছিল গৌণ। কিন্তু ‘:মুসলমান বিজয়ের পর হতে উচ্চকোটির ধর্মমতের উপরে যখন প্রবল আঘাত দেখা দিল তখন স্বাভাবিকভাবেই সমাজদেহের অন্যান্য স্তর ভেদে এই মাতৃতান্ত্রিকতা প্রবল হয়ে উঠল এবং তার ফলেই হয়তো বাংলাদেশে মাতৃ পূজা ও শক্তি সাধনার এত প্রসার।’
কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় দেবীগণ অত্যন্ত মর্যাদা লাভ করেছিলেন এবং ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে তিনি অধিষ্ঠিতা।
কিন্তু সারা বিশ্বব্যাপী মাতৃকা উপাসনা প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকে চলে আসছে, ৪০ হাজার বছরের পুরনো। সব থেকে প্রাচীন মাতৃমূর্তি ৪০ হাজার বছর আগে পুরাতন প্রস্তর যুগে( প্যালিওলিথিক) তৈরি, ইউরোপে পাওয়া গেছে।
সবচেয়ে প্রাচীন সিংহবাহিনী মূর্তি ৮ হাজার বছর আগে নব্য প্রস্তর যুগে তৈরি।
প্রখ্যাত গবেষক তমাল দাশগুপ্তের মতে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে পরিণত হরপ্পা সভ্যতা মাতৃধর্মীয় ছিল। হরপ্পা সভ্যতার মাতৃকাদের মধ্যে পাওয়া গেছে সন্তান কোলে জগজ্জননী মূর্তি, বৃক্ষবাসিনি মূর্তি, বলি গ্রহনরত সপ্তমাতৃকা, দুই হাতে দুটি ব্যাঘ্রকে প্রশমিত করছেন এমন মাতৃকা মূর্তি( সম্ভবত তন্ত্রের ইরা ও পিঙ্গলার মাঝে সুষুম্নার দ্যোতনা)।
এছাড়া হরপ্পা সভ্যতায় নদীমাতা পূজিত ছিলেন। এছাড়াও ঊষা ও নিশা পূজিত হতেন। মা কালীর আদি রূপ হরপ্পা সভ্যতায় পাওয়া গেছে, একজন মাতৃকা যাঁর মুখমণ্ডল মহাভীমা মহাভয়ংকরী। তাছাড়া মহিষ মেধ হত হরপ্পা সভ্যতার তন্ত্র ধর্মে, যেখান থেকে আজকের দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী। হরপ্পা সভ্যতায় একজন তারিণী মাতৃকা পূজিত ছিলেন, যিনি নৌকোবাহিনী। হরপ্পা সভ্যতায় বলাকামাতৃকা পুজিত ছিলেন।
আজ থেকে চার হাজার বছর আগে পান্ডু রাজার ঢিবি, যা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্ন ক্ষেত্র, সেখানকার বাসিন্দারা বলাকা মাতৃকার উপাসনা করতেন, প্রমাণ পাওয়া গেছে।’
অনেকের মতে বীরভূমে তন্ত্র হলো মহাযানী বৌদ্ধদের অবদান। কিন্তু এইরূপ মন্তব্য সঠিক নয়। অধ্যাপক শ্যাম শাস্ত্রীর মতে খ্রীষ্টের জন্মের এক হাজার বছর আগে ভারতে তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের পরিচয় পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন যে, রাঢ়ে বৌদ্ধ ও জৈনদের প্রাদুর্ভাবকালে তান্ত্রিক আচার প্রচলিত ছিল।
শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে’ তান্ত্রিকতার প্রধান প্রধান লক্ষণ গুলি হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম হতে উদ্ভূত হয়নি। ইহা প্রাচীন ভারতীয় একটি ধর্মমত বা ধর্ম শাসন প্রণালী যা হিন্দু দর্শনের সংস্পর্শে এসে হিন্দু তন্ত্র এবং বৌদ্ধ ধর্মের সংস্পর্শে বৌদ্ধ তন্ত্র নামে স্থান করেছিল। তান্ত্রিকতার উদ্ভবের মূলে কোথায় হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম নাই। ভারতীয় ধর্মের ইতিহাসে সুদূর অন্ধকারময় যুগে এই ধর্মের সূচনা হয়েছিল।’

সাধারণের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত আছে যে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন শ্রী চৈতন্যদেব। কিন্তু এদেশের ধর্মের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের প্রায় এক হাজার বছর আগে বৈষ্ণব ধর্ম গৃহীত হয়েছিল রাঢ়ের মানুষের কাছে।
সমগ্র রাঢ়ের তথা বীরভূমের লোকসংস্কৃতি ও সমাজ গঠিত হয়েছে অস্ট্রিক ,দ্রাবিড় ও অ্যালপাইন নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ও সমন্বয়ের ফলে। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়নের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণের মাধ্যমে প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে পশ্চিম দিক থেকে আগত অ্যালপাইন গোষ্ঠীর প্রভাবের ফলে মিশ্র সামাজিক কাঠামোর মধ্যে রাঢ়ের মানুষেরা একত্রে বসবাস করত। পরবর্তীকালে উত্তর ভারত থেকে আগত বৈদিক আর্যগনের দ্বারা রাঢ়ের মানুষ প্রভাবিত হয়েছিল।
জাতি গঠনে রাঢ় তথা বীরভূমের মানুষ যেমন মিশ্রগোষ্ঠীর, ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও দুটি ধারা পাশাপাশি বহমান।
লোকধর্মে গোষ্ঠীভেদে ও স্থানভেদে আচার অনুষ্ঠানের পার্থক্য দেখা গেলেও দেবদেবীর অর্চনা ও প্রকৃতি পূজা গুরুত্বপূর্ণ। লোকধর্মে অনুষ্ঠানের মধ্যে ব্রত উদযাপন সংক্রান্ত ক্রিয়া-কলাপ গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবের ফলে যজ্ঞোপবীতধারী ব্রাহ্মণ গন পুরোহিত হলেও ধর্মরাজ গাজন মনসা প্রভৃতি লৌকিক দেবদেবীর পূজার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের সাহায্য ব্যতীত ব্রত ও লৌকিক দেবদেবীর পূজা অর্চনা হয়।
শিকারীজীবী পর্যায়ে ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কিত কিছু আচার অনুষ্ঠান দেখা যায়। ঠিক সেইভাবে কৃষি আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে স্থায়ী ঘরবাড়ি গঠনের কারণে অরণ্যের কোন নির্দিষ্ট বৃক্ষকে অবলম্বন করে জনবসতির প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছিল।
J.D.Bernal তাঁর Science of History (p 61)
গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, কৃষি কার্য মেয়েদের আবিষ্কার ও তাদের দ্বারাই বর্ধিত হয়েছিল; তাই আদিম কৃষিজীবী মানব সমাজে মেয়েদের প্রাধান্য ছিল এবং যার ফলস্বরূপ গড়ে উঠেছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।
এই প্রসঙ্গে Starbuk বলেন, ‘Female deities have often enjoyed the highest place among the Gods.This depends upon the nature of the social organisation and the respect in which women are held clan life in which the mother is the head of the group is likely to lift the Mother Goddess into a supreme position,provided the nation has risen above the stage on majic.’

আদিপর্বের রাঢ়ে প্রকৃতি পূজা, নদী পূজা, নাগ পূজা, পশু পূজা ও বাস্তু পূজা ইত্যাদির মাধ্যমে যে ধর্মানুষ্ঠানের প্রচলন হয়েছিল তা পরে বৈদিক ধর্মিচরণের সঙ্গে মিশে বিভিন্ন রূপ নিয়ে সমাজে স্থায়ী হয়েছিল ।
নদীবেষ্টিত রাঢ়ে পলিমাটি ও ল্যাটেরাইটের অরণ্যে বসবাসকারী মানব গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজব্যবস্থা তৈরি করেছিল।রাঢ় এলাকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় , প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে অস্ট্রিক দ্রাবিড় অ্যালপাইন মানব গোষ্ঠীর মিলন মিশ্রণ সম্ভূত জনগোষ্ঠী ময়ূরাক্ষী অজয় দামোদর দ্বারকেশ্বর , কংসাবতী ইত্যাদি নদীর উপত্যকা বাস করত। এর মধ্যে সম্ভবত দামোদর নদীর ভয়াবহতার জন্য তারা সরে গিয়ে ময়ূরাক্ষী ও অজয় উপত্যকাকে তাদের প্রধান বসবাসের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিল। সেই কারণে তাম্র প্রস্তর যুগের সভ্যতার প্রত্নস্থলের সন্ধান মিলেছে বীরভূমের ময়ূরাক্ষী ও বীরভূম বর্ধমানের বর্তমানের সীমানা নির্ধারক অজয় নদের উপত্যকায়।
রাঢ় বঙ্গের সমাজ ব্যবস্থায় দুটি বর্ণের প্রাধান্য দেখা যায় যথা ব্রাহ্মণ ও শূদ্র এবং হিন্দু ধর্মের বৃত্তের বাইরে থাকা আদিবাসী সমাজ। রাঢ়ের ধর্মীয় আচার-আচরণে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
জাতিভের প্রথা আর্য সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
রাঢ়ে আর্যরা বসবাস করার ফলে জাতিভেদ প্রথার প্রবর্তন হয়েছিল আর তার প্রভাব পড়েছিল সমগ্র রাঢ়ে।
গুপ্ত অধিকারের পর রাঢ়ের সমাজবিন্যাসের ক্ষেত্রে বহু পরিবর্তন দেখা যায়। রাষ্ট্রের সহায়তায় এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্রাহ্মণ প্রধান সমাজব্যবস্থা ধীরে গড়ে ওঠে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্রাহ্মণ গন এসে রাঢ়ে বসবাস শুরু করে।
পাল রাজারা ধর্মে বৌদ্ধ হলেও ধর্মবিষয়ে তাদের কোনো গোঁড়ামি ছিল না। তারা মন্দির বৌদ্ধবিহার জৈনবিহার নির্মাণের জন্য প্রচুর ভূমি দান করেছিলেন।।
পাল পর্বে রাঢ় বঙ্গে বর্ণ বিন্যাসের আদর্শ উদার ও নমনীয় হলেও বর্মন ও সেন যুগে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের জন্য বর্ণবিন্যাসকে সুদৃঢ ় সুনির্দিষ্ট ও অনমনীয় করে তুলেছিল।
সেন ও বর্মন রাজবংশ দক্ষিণ দেশ থেকে আগত রাজপুরুষ ছিলেন এবং তারা দাক্ষিণাত্যে ধর্ম ও সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নত ব্যবস্থার উত্তরাধিকার নিয়ে রাঢ়ে এসেছিলেন। বিষ্ণু ভক্ত ক্ষত্রিয় বর্মন রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
হরি বর্মদেবের মহামন্ত্রী ভট্ট ভবদেবের প্রশস্তিলিপিতে বলা আছে যে ,স্মার্ত পন্ডিত ভট্ট ভবদের অগস্ত মুনির ন্যায় বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রাস করেন এবং পাষণ্ড বৈতাণ্ডিকদের যুক্তি তর্ক খন্ডনে বিশেষ পারদর্শীতার জন্য গর্ব অনুভব করতেন।
এই ভবদেব ভট্টের মা সাঙ্গোকা সিদ্ধল গাঁঞী নিবাসী কোন বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণ কন্যা ছিলেন। এই ভবদেব ভট্টের বাড়ি ছিল বীরভূমের লাভপুরের কাছে সিদ্ধল গ্রাম বা বর্তমানের শীতল গ্রাম একথা আগেই আলোচনা করেছি।
রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ ভবদেব ব্রাহ্মবিদ্যা, সিদ্ধান্ত তন্ত্র গণিত ফল সংহিতা ও হোরাশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। এছাড়া তিনি মীমাংসা গ্রন্থের টিকাকার, বিবিধ স্মৃতি গ্রন্থের রচনাকার এবং অর্থশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, অস্ত্রবেদ ও আগমবেদ আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি বীরভূম সহ রাঢ় দেশের বিভিন্ন এলাকায় জলাশয় খনন ও নারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সেন রাজারা কর্ণাটক দেশ থেকে আগত ব্রহ্ম ক্ষত্রিয় ছিলেন অর্থাৎ জাতিগতভাবে প্রথমে ব্রাহ্মণ ও পরে যুদ্ধবিদদের অবলম্বন করায় এরূপ জাতি নাম পেয়েছিলেন। বিজয় সেনের দেওপাড়া লিপি থেকে জানা যায়, আদিপুরুষ সামন্ত সেন কর্ণাটক থেকে রাঢ় অঞ্চলে এসে
গঙ্গার তীরে বসবাস শুরু করেন। সামন্তসেনের
পৌত্র হল ইতিহাসখ্যাত বিজয় সেন। বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন ও তাঁর পুত্র লক্ষণ সেনের আমলে বাংলার সমাজ বিন্যাসের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হয়। এই বিজয় সেনের নামেই লিখিত স্তম্ভ লিপি বীরভূমের পাইকরে রক্ষিত আছে আর লক্ষণ সেনের কীর্তি সারা বীরভূম জুড়ে ছড়িয়ে আছে।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।