ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে সমীরণ সরকার (পর্ব – ২৬)

সুমনা ও জাদু পালক

অদৃশ্য কন্ঠ বলে, এই মন্দিরে তোমার আর একটা ছোট্ট কাজ আছে সুমনা।
—–কী?
—– শিবলিঙ্গের চারপাশে অজস্র বেলপাতা দেখতে পাচ্ছ তো?
— হ্যাঁ।
—– ওখান থেকে নিখুঁত দেখে তিন ফলক ওয়ালা চারটে বেলপাতা বেছে নিয়ে সঙ্গে রাখো।
—কেন?
—- ওগুলো ভবিষ্যতে কাজে লাগবে তোমার। আরেকটা জিনিস ওই বেল পাতার নিচে আছে।
—–কী?
—– হরিতকী ফল দিয়ে গাঁথা একটা মালা আছে। ওটাও সঙ্গে নেবে। যাদুকরের রাজ্যে যাওয়ার পথে ওটা কাজে লাগবে তোমার।
সুমনা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, জাদুকরের রাজ্যে কেন যেতে হবে আমাদের ,কি কাজ আছে সেখানে?
—– ওখানেই তো আসল কাজ।
——মানে?
——— ওখানেই তো দুষ্টু জাদুকর হূডু বন্দি করে রেখেছে পরীদের রানী কে, লুকিয়ে রেখেছে পরীদের রানীর একজোড়া সাদা ডানা আর তার জাদুদণ্ড। এগুলো উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিতে হবে পরীরাজ্যের রানীকে। আরো কাজ আছে।
—-কী?
—–হূডুর জাদুদন্ড কেড়ে নিয়ে আসতে হবে এই ঘুমন্ত রাজপুরীতে। এখানে শিব মন্দিরে এসে পুড়িয়ে ফেলতে হবে ওই জাদুদন্ড। আর তাহলেই অভিশাপ মুক্ত হবে রাজকুমার হীরক,অভিশাপ মুক্ত হবে হাসিখুশি দ্বীপের এই কনকনগর রাজ্য। অভিশাপ মুক্ত হয়ে আবার জেগে উঠবে ঘুমন্ত রাজপুরী।
—– আর রাজকুমারী রত্নমালা ?
—– ওর খোঁজও পেয়ে যাবে তুমি।
—– জাদুকর হূডুর রাজ্য কোথায়, কিভাবে যাব
ওখানে?
—— যেভাবে এখানে এসেছিলে,ঠিক সেভাবেই আবার তোমাকে ফিরে যেতে হবে এই রাজপুরীর মূল ফটকে।তবে ফেরার
সময় দুটো কথা মনে রাখতে হবে।
——-কী?
——– বারান্দা পার হয়ে ফলের বাগানে ঢোকার
আগে একটা নীল রঙের বড় দরজা খোলার জন্য তিনবার ‘ওম নমঃ শিবায়’ মন্ত্র বলেছিলে।
—- হ্যাঁ ,মনে আছে।
—– এবারো দেখবে, ওই দরজা বন্ধ আছে।
—-তাহলে আবার তিনবার শিব ঠাকুরের মন্ত্র বলবো, তাহলেই তো খুলে যাবে দরজা।
—— হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, তবে এবারে তিনবার নয়,
পাঁচবার ‘ওম নমঃ শিবায়’ বলতে হবে।
—-বেশ।
—– আর রাজসভার সেই সুন্দর ময়ূরটার কথা মনে আছে তো ?
—– হ্যাঁ।
—– ওটার সামনে গিয়ে এবার তিনবার নয়,দুবার
হাততালি দিতে হবে। তাহলে ওটা এবারে বাঁদিকে সরে গিয়ে তোমার যাওয়ার রাস্তা করে দেবে। আগের মত রাজসভা পার হয়ে ,বাগান পার হয়ে মূল ফটকের কাছে গেলে দেখবে ,ওটা খোলা আছে।
—–বেশ।
—– আর ওই কথাটা কিন্তু ভুলোনা সুমনা।
—কী?
—— ভুল করেও কোন জিনিসে হাত দেবে না, নাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে!
—মনে থাকবে।
—-যাও। মন্দির ছেড়ে যাওয়ার আগে বেলপাতা আর হরিতকী মালা সঙ্গে নিতে ভুলনা।
—-ঠিক আছে।
সুমনা মনস্থির করে নেয়। তারপর অদৃশ্য কন্ঠের
নির্দেশমতো একসময় পৌঁছে যায় রাজবাড়ির মূল ফটকে। খোলা ফটক দিয়ে বাইরে যাওয়ার আগে একবার পিছন ফিরে দেখে নেয় রাজবাড়ি টা কে।
অদৃশ্য কন্ঠ বলে ওঠে, ধন্যবাদ সুমনা। তোমার জন্য দুধরাজ তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তোমাকে এবার পরিখা পার করে ওর পিঠে বসিয়ে দেবো।নাও,এবারে চোখ বন্ধ করো ।
সুমনা চোখ বন্ধ করে।আর অনুভব করতে পারে, কেউ যেন তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে দুধরাজের পিঠে বসিয়ে দিল।
অদৃশ্য কন্ঠ বলল, এবারে চোখ খোলো সুমনা। ভালো করে দুধরাজের গলা জড়িয়ে ধরে বস। অনেকটা পথ যেতে হবে তোমাদের। পথে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে।একদম ভয় পেওনা,আমি সঙ্গে আছি।
দুধরাজ,যাও,এবার হূডুর রাজ্যে নিয়ে যাও সুমনাকে।
দুধরাজের পিঠের দুপাশে ধবধবে সাদা দুটো পাখনা বের হতেই আকাশে উড়লো সে।
রাজবাড়ীর সীমানা পার হয়ে আবার বন জঙ্গলের উপর দিয়ে উড়তে উড়তে দুধরাজ এক সময় পার হয়ে গেল হাসিখুশি দ্বীপের সীমানা।
দুধরাজ উড়ছে তো উড়ছেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত।রাত গভীর হলে কোথাও দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নেয় দুধরাজ। আবার ভোর হলেই শুরু হয় ওর ওড়া।
দুধরাজ খায় না কিছু ,মাঝে মাঝে শুধু টলটলে জল ভর্তি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে জল পান করে। কিন্তু সুমনার তো খিদে পায়, পায় পিপাসাও।
আর তখন সে অদৃশ্য কন্ঠের নির্দেশ অনুযায়ী হরিতকীর মালা থেকে একটা করে হরিতকী ছিঁড়ে মুখে দেয়। আর কি আশ্চর্য, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর হয়ে যায় তার।
দুধরাজ উড়তে উড়তে গ্রাম, নগর,সবুজ ফসলে ভরা মাঠ,ধূ ধূ প্রান্তর ,
পাহাড়, জঙ্গল , খাল-বিল,নদী পেরিয়ে যায় ।
এইভাবে কেটে যায় সাত সাতটা দিন ও রাত।
একদিন সকালে উড়ছে দুধরাজ। হঠাৎ উঠল ঝোড়ো হওয়া। প্রচন্ড জোর সে হাওয়ার। সুমনার মনে হয়,সে বুঝি পড়ে যাবে দুধরাজের পিঠ থেকে।
সে ভয়ে অদৃশ্য কণ্ঠের উদ্দেশ্যে বলল,তুমি কোথায় বন্ধু, বাঁচাও আমাকে।
অদৃশ্য কন্ঠ বললো, কোন চিন্তা নেই, আমি আছি তো।
সুমনা দেখতে পেল,হঠাৎ ওদের চারধারে কুয়াশার মতো একটা বলয় তৈরি হলো। সেই বলয়ের চারধারের ঝোড়ো হাওয়া গায়ে লাগছে না ওদের। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ ওড়ার পর হঠাৎ উজ্জ্বল হলুদ আলো চারধার থেকে যেন ঘিরে ধরল ওদের। সেই উজ্জ্বল হলুদ রঙের আলোয় চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছিল সুমনার। সুমনা বুঝতে পারছিল যে, দুধরাজের ও বেশ অসুবিধা হচ্ছে উড়তে। কি করবে ভাবতে ভাবতে সুমনার হঠাৎ হলুদ পরীর পালকের কথা মনে পড়ল।
স্মরণ করতে না করতেই হাজির হলো হলুদ পরীর পালক। সুমনার মুখে সব কথা জেনে হলুদ পরীর পালক ধীরে ধীরে নিজেকে বড় করতে শুরু করল।দুধরাজের সামনে ঢালের মত এগিয়ে চলল সে‌। হলুদ উজ্জ্বল আলো আর কোনো সমস্যা তৈরি করতে পারছিল না দুধ রাজের চলার পথে। কিন্তু হঠাৎ মনে হল, কেউ যেন প্রবল শক্তিতে আকর্ষণ করছে ওদের।
সেই বাধা কাটিয়ে উড়তে বেশ কষ্ট হচ্ছিল দুধরাজের।
অদৃশ্য কন্ঠ বলল, আর উপায় নেই, এখানে নামতে হবে দুধরাজ। ভেবেছিলাম, ওদের এড়িয়ে যাবো, কিন্তু পারলাম না।
সুমনা বলল,কেন,এখানে নামতে হবে কেন?
অদৃশ্য কন্ঠ বলল,এটা হলুদ দৈত্যের রাজ্য।
ওরা আকর্ষণ করে নিচে নামাচ্ছে তোমাদের।
ওই আকর্ষণ শক্তি কাটিয়ে দেওয়ার সাধ্য নেই আমার।নেমে চল দুধরাজ।
সুমনা অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে বলল, কিন্তু………..!
—— কোন ভয় নেই সুমনা, আমি সঙ্গে আছি তো।
অজানা কন্ঠ আশ্বস্ত করল।
দুধরাজ নামতে শুরু করল।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।