অনুগল্পে সন্দীপ সাহু

নক্সিকাঁথা
১৯০৬ এ প্রথম বাংলাদেশের ঢাকায় আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সভায় এসে ছিলাম। সেই সময় দিদিমা খুব গোপনে একটা নাম ও ঠিকানা দিয়ে ছিল। দিয়েছিল ছোট্টো একটা চিঠি। খামে ভরা। খুব যত্ন করে খামের মুখটা আঠা দিয়ে লাগানো। বলে ছিল, পারলে খোঁজ নিস। ওনাকে আমার এই চিঠিটা দিস। নামটা দেখে আমি হতবাক! যুবক মুসলমান। আমি দুষ্টু হেসে বলে ছিলাম, কে! বউ এ কি তোমার বয়ফ্রেণ্ড! তাও মুসলমান! দিদাকে আমি বৌ বলেই সেই ছোট্টো বেলা থেকে ডেকে আসছি। এখন বউ বাচ্চারা আমার এই ডাক নিয়ে মজা করে। দিদার বৃদ্ধ চোখে, ভাঁজ পড়া মুখে একটি ষোড়শীকে দেখে ছিলাম।
দিদা বলেছিল, ও ছিল স্বদেশী। বিপ্লবী। স্বদেশীদের একটাই ধর্ম স্বাধীনতা।বলে ছিলাম, দাদুকে তুমি ভালোবাসেনি? তোর দাদু আমার প্রয়োজনের প্রিয় মানুষ। উনি ছিলেন আমার পৃথিবী। আর মহম্মদ আমার আকাশ। ওনাকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। মাস্টারদার দলে ছিল। তবে তোর দাদুকে আমি একদম ঠকিইনি। ওনার স্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে কোনো আন্তরিকতার অভাব রাখিনি।তবে তোদের মতো এই রকম যুগ পেলে মহম্মদকেই স্বর্গ মর্ত করতাম, হলফ করে বলতে পারি।বউ চিন্তা করো না। ঠিক খোঁজ নিয়ে আসবো। ওই দাদুর কাছে তোমার এই প্যার কি প্যাগাম জরুর লেকে যাউঙ্গা কবুতর যেয়েসা! তখন আমি উঠতি কমিউনিস্ট নেতা। তরতাজা আঠাশ। দায়িত্ব নিয়ে দলের কাজ করি। দলেরই এক মহিলা কর্মীর সঙ্গে একটু অন্তরঙ্গতায় আছি।
আমার দাদুকে খুব মনে পড়লো। বছর পাঁচেক হলো স্বর্গবাসী। দিদার প্রেমের গভীরতা এত ছিল, দাদু তার টেরই পেল না।
ঢাকায় পৌঁছে সেখানকার এক কমরেডকে ঠিকানাটা দেখিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করি।কমরেড জানালো, দু’দিন পর সভার কাজ শেষ হলে নিয়ে যাবে। রাশিয়া আমেরিকা পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়া আফ্রিকার কিছু দেশ, প্রায় ত্রিশটি দেশের প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিল।
নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছলাম। খুঁজে পেলাম সেই দাদুর বাড়ি। পুরানো আমলের বর্ধিষ্ণু বাড়ি। জানালাম কোলকাতা থেকে আসছি। দিদা শিখিয়ে দিয়েছিল, কি পরিচয় দেবো। নমস্কার জানিয়ে বললাম জ্যোতির্ময় রায়ের পুঁতি। মহম্মদ দাদুকে বললেই চিনতে পারবেন। আমার বাবার বয়সী ভদ্রলোক জানালেন, আপনি যার খোঁজে এসেছেন উনি আমার বড়চাচাজান। আমি নুর আলী। সেলাম ওয়ালেকম। আমি জ্যোতির্ময় দাদুকে জানি। ওনার নাম বড় চাচার মুখে সবসময় শুনি। এই বাড়িটা তো জ্যোতির্ময় দাদুর-ই। দেশ ভাগের সময় আমার দাদু কিনে নিয়ে ছিলেন। জ্যোতির্ময় দাদু আর আমার দাদু ভালো বন্ধু ছিলেন।
সারা বাড়িতে হৈ হৈ পড়ে গেল। দারুণ আন্তরিকতার সুনামি শুরু হলো। আমার বয়সী আমার থেকে ছোটো যুবক যুবতীর সঙ্গে ভাব জমে একেবারে ক্ষীর। ওদের মধ্যে একজন শেখ আব্বাস বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
খাওয়া দাওয়ার পর কিছুটা থিতু হলে যুবক যুবতীর দল আমাকে ঘিরে ধরে। ইতিমধ্যে বাড়ির কর্তা জানিয়েছেন রাণী খালার কথা বড় চাচাজানের মুখে শুনেছেন। রাণী আমার দিদার নাম। সেই সময় আরো জানান, বড় চাচাজান বছর পাঁচেক হলো ইন্তেকাল করেছেন। মনে মনে ভাবলাম দুই দাদুই এখন স্বর্গে।হয়তো পাশাপাশাই আছেন। কিন্তু কেউ কাউকে চেনেন না!
খুব চিন্তায় পড়লাম। দিদার খামটা নিয়ে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। রাতে খাওয়ার পর যুবক যুবতীরা ঘিরে ধরলো আমায়। মহম্মদ দাদুর খোঁজে কেন এসেছি? কে পাঠিয়েছে? এক যোগে প্রশ্নবান।
আমি সবটা জানালাম। দেখালাম খাম। সবাই চরম উত্তেজিত। এই জন্য বড় আব্বাজান আর সাদিই করলেন না! মহম্মদ দাদু বিয়ে করেননি শুনে ওনার প্রতি শ্রদ্ধা গাঢ় হলো। সবাই খাম ছিঁড়ে চিঠি পড়তে চাইলো। আব্বাস বাধা দিয়ে জানালো, এটা একদম ঠিক নয়। আমরা কেউ এই চিঠি পড়বো না। যাকে পাঠানো হয়েছে, তার কাছেই চিঠি পৌঁছে দেওয়া হবে। এই চিঠির কথা গোপন রাখতে হবে। কখনো এই চিঠির কথা আমরা কাউকে বলবো না। মুহূর্তে মিটিংটা কমিউনিস্ট পার্টির মিটিংয়ে পরিণত হলো। মহম্মদ দাদু ও রাণী দিদার মর্যাদা কোনো মতেই ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। Pin drop silenc. সবার চোখ চিক্ চিক্ করছে। আমিও চাইছিলাম না চিঠিটা খোলা হোক।
একজন বলল, বড় আব্বার কাছে কিভাবে চিঠি পৌঁছে দেওয়া হবে? আব্বাস বলে, মৃত্যুর পর সব শেষ। বড় আব্বার কাছে পৌঁছানো একটা কথার কথা। বড় আব্বাকে নিয়ে ক্লাবে যে মিউজিয়াম আছে সেখানেই স্বদেশী বিপ্লবী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বড় আব্বার ব্যবহৃত জিনিসের সঙ্গেই থাকবে। আমি খুব গোপনে রেখে আসবো। তারপর সময় সুযোগ করে এই পবিত্র সম্পর্কের কথা যথাযোগ্য মর্যাদায় সবার সামনে আনা হবে। সবাই সহমত জানায়।
দেশে ফিরে প্রথমে মামাবাড়ি যাই। আমাকে দেখে দিদার চেহারায় ষোড়শীর উত্তেজনা অনুভব করি।
কিরে, দেখা হলো? আমার কথা বললি? খামটা দিয়েছিস? শুনে উনি কি বললেন? খুব বুড়ো হয়ে গেছেন না? শরীর কেমন আছে? মামা এসে যেতেই বউ আমার চুপ করলো। কিরে বাংলাদেশ কেমন ঘুরলি? মামা জিজ্ঞেস করে। না মামা ব্যস্ত ছিলাম। ঘোরা হয়নি। দিদা তার ঘর থেকে আমায় ডাকে। আমি যেতেই দরজা বন্ধ করে।
আমি কি উত্তর দেবো বুঝতে পারি না। হাল্কা চালে হেসে বললাম, তোমার বয়ফ্রেন্ড আর দাদু একই জায়গায় আছেন। বন্ধুর মতো। সুখেই আছেন। উনিও দাদুর মতোই পাঁচ বছর আগে একই জায়গায় গেছেন। কী! কী! কী বললি! কী বললি! মুহূর্তে বসা অবস্থা থেকে ধপাস করে বিছানায় পড়ে যায় দিদা। আমি ডাকি, বউ বউ বউ…! কোনো সাড়া পেলাম না। মামা মামা চিৎকার করলাম।
সব শেষ। ভোর চারটে নাগাদ। আব্বাসকে WhatsApp এ ফোন করলাম। আব্বাস দিদা মারা গেছেন। সব বললাম। কান্নায় কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল। তবুও আব্বাস সবটা বুঝতে পারলো। জিজ্ঞাসা করলো দাদি আম্মা এখন কোথায়? জানালাম নার্সিং হোমে। বডি পেতে একটু সময় লাগবে। এখান থেকে বাড়ি যাবো। আত্মীয়দের খবর দেওয়া হচ্ছে। সবাই আসবে। শ্মশানে যেতে যেতে সেই বিকাল হয়ে যাবে। আব্বাসের ভাই রফিক পাশে ছিল। সে ফোনটা নিয়ে বলল, ইল্লালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহী রাজিউন। আল্লাহ ওনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসে নসিব করুন। কান্নায় তারও গলা বন্ধ হয়ে আসছিল। আব্বাস বলল, আমরা সবাই মোবাইলের সামনে থাকবো। শ্মশানে পৌঁছে পুরো বিষয়টা ভিডিও কল করে দেখাবে। দিদি আম্মাকে আমরাও শেষ বিদায় জানাবে।
আজকের অনুষ্ঠানের নাম নক্সিকাঁথা। ক্লাবে মহম্মদ দাদুর নামাঙ্কিত মিউজিয়ামের নাম হয়েছে ননক্সিকাঁথা। মিউজিয়ামে লুকিয়ে রাখা দিদার খাম সবাইকে দেখানো হয়, দাদু-দিদার কাহিনী বেশ মর্যাদার সঙ্গে গম্ভীর পরিবেশে সবাইকে জানানো হয়। খাম না খোলার কথা ঘোষণা হয়। বলা হয়, এই খাম অপঠিত হিসেবেই বড় আব্বার জিনিসের সঙ্গেই থাকবে। কোলকাতা থেকে আনা দাদি আম্মার চিতাভস্ম বড় আব্বার কবরের একেবারে পাশে একটা ছোট্টো কবর বানিয়ে তাতে যত্নের সঙ্গে রাখা হয়। কবরে চড়ানো হয় চাদর। চাদরে মোহাম্মদ দাদু ও রিনা দিদার ছবি আঁকা। বড় করে তাদের নাম লেখা। ঘোষণা করা হয় আজ থেকে এই কবর স্থানের নাম হবে নক্সিকাঁথা। শত শত গ্রামবাসী চোখের জলে নীরবে মহম্মদ দাদু ও রাণী দিদার কথা খুব নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে করতে অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরে যায়।
স্পষ্ট দেখতে পাই মহম্মদ দাদুর মাথা কোলে নিয়ে আমার বউর আনন্দ আর ধরে না। মোহাম্মদ দাদুও যেন আমাকে আশীর্বাদ করছেন!