ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || সুব্রত সরকার – ৫

|| জাপানের ডায়েরি – ৫ ||

 Hiroshima, Mon Amor, এই নামে একটা ফরাসি চলচ্চিত্রের খুব নাম শুনেছিলাম এক সময়। আমরা তখন বলতাম, Hiroshima,  My Love। ইংরেজিতে এই উচ্চারণটার মধ্যে আমাদের গভীর একটা প্যাশন ও সহমর্মিতা কাজ করত।

Hiroshima, Mon Amor ছিল ১৯৫৯ সালের এক রোমান্টিক ড্রামা ফিল্ম। ফরাসি পরিচালক অ্যালাইন রেসনাইস  করেছিলেন এই চলচ্চিত্রটি।

১৯৪৫ সালের ৬ অগাস্ট হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তার ১৪ বছর পর এমন একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সে সময় সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন অ্যালাইন রেসনাইস।

হিরোশিমা নামটার মধ্যেই যেন লুকিয়ে রয়েছে- হিরো!..

আজকের হিরোশিমা সত্যিই তাই বটে!..

সেই হিরোশিমায় আজ আমরা যাচ্ছি। এবং কিসে করে যাচ্ছি?… জাপানের বিখ্যাত বুলেট ট্রেনে চড়ে। জাপানিরা বলে “সুপার এক্সপ্রেস!”

এইখানে ছোট্ট একটা মজার কথা না লিখে পারছি না। আমার ধারণা ছিল বুলেট ট্রেন মানে সে বোধহয় বিশেষ একটা ট্রেন, দারুণ তার আগমন। রাজকীয় ডিপার্চার। খুব দুর্লভ একটা কিছু দেখব!..

ওমা!.. স্টেশনে গিয়ে দেখি ওদের সব ট্রেনই বুলেট ট্রেন!.. হুশ করে আসছে ফুশ করে উড়ে যাচ্ছে।  আসছে আর যাচ্ছে! এ যেন আমাদের লোকাল ট্রেন, সারাদিন যেমন আসে যায়- ক্যানিং, ডায়মন্ড, বারুইপুর, লক্ষ্মীকান্তপুর!.. তফাত শুধু ট্রেনের গতি ও গুণমানে!..

আসলে ওরা রোজই পায়েস খায়!..

 

কিওটো থেকে হিরোশিমায় বুলেট ট্রেনে পৌঁছে গেলাম কি সুন্দর স্বচ্ছন্দে। সময় লেগেছিল আনুমানিক এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট। ট্রেনের গতি ঠিক কত ছিল জানি না। কিন্তু দুরন্ত ছিল তো বটেই।  তাই সময়টা বুঝতেই পারি নি। ১৬ বগির ট্রেন। এক মিনিটও লেট রান করে না। ট্রেনে ওয়াই ফাই ছিল।

 

আজ আমাদের হিরোশিমা শহর ও হিরোশিমার সাইট সিয়িং দেখার ভ্রমণ সূচী পুরো একবেলা। বিকেলে যাব জাপানের আরও এক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট – মিয়াজিমা আইল্যান্ডের ইতসুকুশিমা শিরিন দেখতে।

আমাদের জাপানি গাইড কাওয়াসাকি  হিরোশিমার কুখ্যাত সেই Atomic Bomb Dome ধ্বংসাবশেষের এক ভাঙ্গা অট্টালিকা দেখিয়ে শুরু করালেন হিরোশিমা ভ্রমণ। এই দগ্ধ- ভগ্ন বাড়িটা ইতিহাসকে সংরক্ষণ করে রাখার এক সযত্ন প্রয়াস! সব স্মৃতি মুছে ফেলে নি জাপানিরা। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে দেখাতে হবে, দেখো আমরা তারপরও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি। এই এক টুকরো ধ্বংসের স্মৃতির পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে কি অপরূপ সুন্দর এক নদী-Motoyasu-gawa- River। এ নদীতে রিভার ক্রুজ হয়। হিরোশিমাকে ঘুরে দেখার জন্য এই নদীবক্ষে ভ্রমণের দারুণ আয়োজন। নদী আমাকে ভীষণ আকর্ষণ করে। তাই খুব ইচ্ছে ও লোভ হয়েছিল নৌকো ভ্রমণের, কিন্তু করা সম্ভব হয় নি!..

এছাড়াও আছে -Hiroshima World Heritage Sea Route, হিরোশিমার উল্লেখযোগ্য সব কিছু দেখার জন্য Honkawa River দিয়ে সমুদ্রপথে মিয়াজিমায় পৌঁছে যাওয়া যায়। এসব জলভ্রমণ  হিরোশিমাকে জানতে বুঝতে খুব ভালো।

অ্যাটমিক বোম ডোম এর কাছে একজন জাপানি মহিলাকে দেখলাম যুদ্ধ বিরোধী মতামত গঠনের পক্ষে একটা কাগজে সই সংগ্রহ করছেন। যারা এগিয়ে এসে সই করছেন, তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ছোট্ট এক উপহার- জাপানের বিখ্যাত কাগজের শিল্পকর্ম ‘অরিগামি’। এমন রঙিন কাগজ দিয়ে বানানো এমন একটা ‘অরিগামি’ আমিও উপহার পেয়েছি!

অ্যাটমিক বোম ডোম থেকে একটু এগিয়েই পেয়ে গেলাম Children’s  peace Monument। আরও একটু এগিয়ে দেখলাম Flame of Peace, তারপর পেলাম Cenotaph for the A- Bomb Victims । এসব দেখতে দেখতে ইতিহাসের গল্প মনে পড়ে যায়। মন বিষন্ন হয়, আবার মন প্রফুল্লও হয় এই ভেবে যে, হেরেও হারে নি জাপান, মাথা তুলে উঁচু করে দাঁড় করিয়েছে সেই  হিরোশিমাকে। আজকের হিরোশিমাকে দেখে চমকে উঠতে হয়, তাক লেগে যায় শহরের আধুনিকতায়!

Hiroshima Peace Memorial Park বিশাল এক জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে। একটা গোটাদিন এখানে ঘুরে বেড়াতে পারলে ভালো হয়। শুনলাম জওহরলাল নেহেরুর উপহার দেওয়া একটা গাছ নাকি আজও পিস পার্কে রয়েছে।

হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল হল ও মিউজিয়ামও দেখে নিলাম। এই দুই জায়গা অবশ্যই দেখার মত। যেতেই হবে। ইতিহাসকে দেখতে, জানতে, বুঝতে বড় জরুরি এই হল ও মিউজিয়ামে যাওয়া। এখানে অনেক ঐতিহাসিক ছবি ও মূল্যবান জিনিসপত্র রয়েছে। ঘুরে ঘুরে দেখতে বিস্ময় জাগে। এমন কিছু স্মৃতি চিহ্ন সাজিয়ে রাখা রয়েছে- নিজের চোখে দেখলে কেমন অস্থিরতা অনুভব হয়ে শরীর ও মনে। একটা কয়েক মিনিটের ভিডিও আছে অ্যাটমিক বোম বিস্ফোরণের – শিউরে উঠতে হয় দেখে। খুব অল্প সময়ে এত বড় মিউজিয়াম ও হলটা ঘুরে দেখা সম্ভব হয় না। এই সময়গুলোয় খুব রাগ হয়,  দুঃখ হয়, এসব প্যাকেজ ট্যুরে আর আসব না মনে হয়!..

তাই তাড়াহুড়ো করে যতটুকু দেখেছি খুব ভালো লেগেছে। মন ভরে গেছে হিরোশিমার এই একবেলার ভ্রমণে। হয়তো হলো না অনেক কিছুই দেখা, তবু প্রধান জিনিসগুলো দেখার আনন্দ অভিজ্ঞতার মূল্য অমূল্য।

বিকেলের ভ্রমণে গেলাম মিয়াজিমা আইল্যান্ডে। হিরোশিমা থেকে আমাদের লাক্সারি বাসে করে পৌঁছে গেলাম ফেরি ঘাটে। প্রত্যেক দশ-পনেরো মিনিট অন্তর ফেরি  ছাড়ছে মিয়াজিমাগুছি স্টেশন থেকে। যাচ্ছে ওপারে। সমুদ্রের নীল জলে ভাসতে ভাসতে চলে গেলাম ওপারে। এই ছোট্ট ফেরি সার্ভিসটা খুব সুন্দর ছিল। ওপারে নেমে সামান্য হেঁটে পৌঁছে গেলাম ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্বীকৃতি আদায় করা অপূর্ব সুন্দর Itsukushima Shrine এর কাছে। এই কাঠের মন্দিরটি প্রথম নির্মাণ হয়েছিল ৫৯৩ সালে, তার পর পুনরায় তাকে বিনির্মাণ করেন Taira-no- Kiyomori ১১৬৮ সালে। ইউনেস্কো হেরিটেজ মর্যাদা প্রদান করেছেন ১৯৯৬ সালে। প্রাচীন এই বিশালাকার মন্দিরটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছে। মন্দির থেকে সামান্য দূরে নীল জল সমুদ্রে  যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা The Great Toril মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে হয়।

ফেরি ঘাট থেকে চাইলে জাপানি রিক্সায় চড়েও এই আনন্দ ভ্রমণ করা যায়। সুন্দর সুন্দর হাতে টানা রিক্সা আছে। সুপুরুষ চালক। সে গাইডও বটে!

ইতসুকুশিমা মন্দিরে অনেকটা সময় সুন্দর কাটালাম। খুব ভালোলাগার একটা জায়গা। ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মনে পড়ে গিয়েছিল আমাদের বলিউডের সেই বিখ্যাত সিনেমা “টোকিও, আই লাভ ইউ” এর  কথা। মহম্মদ রফির কন্ঠে সেই গান, “ও মেরে শাহেবুবা,ও মেরি জানে যা না.. ” জয় মুখার্জি ও আশা পারেখ গানের তালে নেচে গেয়ে এই মন্দিরের চাতালে অভিনয় করেছেন। ১৯৬৬ সালে রিলিজ হওয়া ছবি। বলিউডের বিখ্যাত পরিচালক প্রমোদ চক্রবর্তীর সুপার হিট সিনেমা। সেই কতকাল  আগে  বলিউড এখানে এসেও শুটিং করে গেছে!

ইতসুকুশিমায় সুন্দর শপিং করা যায়। অনেকেই  স্যুভেনির সংগ্রহ করছে।  সারা পৃথিবীর পর্যটকদের ভিড় থাকে ইতসুকুশিমায়। বহু বর্ণের, বহু ধর্মের কত মানুষকে দেখলাম। বিদেশ ভ্রমণে বড় বৈচিত্র্যময় মানুষজনকে দেখার সুযোগ হয়।

বিকেলের রোদ যখন নরম হয়ে আসছে, তার আলো ছায়ায় ইতসুকুশিমাকে কেমন অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছিল তার গাঢ় কমলা রঙের জন্য। তাই ফিরে আসার সময় একটু মন কেমন করছিল। ভীষণ মনে হয়েছিল, এই আইল্যান্ডে একটা দিনরাত্রি থাকতে পারলে  কি ভালো লাগত!

সন্ধে হওয়ার একটু আগে আবার ফেরি সার্ভিসে  ফিরে এলাম মিয়াজিমাগুছি স্টেশনে। লঞ্চের খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে বিকেলের ক্লান্ত সূর্যকে সমুদ্রের জলে ঢলে পড়তে দেখে বেশ লাগছিল।

 মিয়াজিমাগুছি স্টেশনে ফিরে এসে কফি খেয়ে বাসে গিয়ে বসলাম। ফুরিয়ে গেল আরও একটা দিন। দেশ বিদেশ দেখার এই নানারঙের দিনগুলো স্মৃতি-খাতার পাতায় পাতায় থেকে যাবে।

অশোকদা প্রতিদিনের মতই একবার কাউন্ট করে দেখে নিলেন, সবাই এসেছি কিনা! সবাই এসেছে!..

ইশ একদিন যদি না এসে ইচ্ছে করে হারিয়ে যাই তো কেমন হবে!.. ছেলেমানুষী ভাবনা, কিন্তু সত্যিই মনেও হয় কখনো সখনো!..

বাস গড়িয়ে চলেছে!.. সূর্যাস্ত চোখের সামনে অপরূপ হয়ে ধরা দিল। নীল সমুদ্রের জলে অস্তাচলে ঢলে পড়া সূর্যের কুসুম যেন মিলেমিশে গেছে। আকাশের বুকে তাই রংমহলের রোশনাই।  এই আকাশপানে চেয়ে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললাম, স্মৃতির অ্যালবাম থেকে ভেসে আসে গান, ক্লান্ত দু’চোখ বুজে শুনি সে গান আপন মনে,” মুসাফির হু ইয়ারো, না ঘর হ্যায় না ঠিকানা, মুঝে চলতে যানা  হ্যায়, ব্যাস চলতে যানা…”

আজও ডিনার করে হোটেলে ফিরব। জাপানী ডিনার। শহরের বিখ্যাত এক মলের রেস্টুরেন্টে ডিনারের আয়োজন করা রয়েছে।

তারপর রাত্রিবাস হিরোশিমায়।…

আগামীকাল নতুন ভ্রমণে চলে যাব ওসাকা।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।