গদ্যানুশীলনে সুব্রত সরকার (ছোটগল্প)

মুর্গাশূলীর জঙ্গলে
ডিসেম্বর মাসেও হঠাৎ ধেয়ে এল অকাল বর্ষা। তিনদিন আগেই আবহাওয়া দফতর বলেছিল, নিম্নচাপ ধেয়ে আসছে। ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত করেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
বৃষ্টিকে সঙ্গী করেই চার জংলী ট্যুরিস্ট বেরিয়ে পড়েছে। রণে বনে জলে জঙ্গলে এই চারমূর্তি অটুট থাকে।
ট্রেনের টিকিট ও জঙ্গলে বাংলো বুকিং দুটোই করা ছিল। মুর্গাশূলীর জঙ্গলের বাংলো বুকিং চট করে পাওয়া যায় না। তাই ক্যানসেল করার কথা ভাবতেই চায় নি।
ট্রেন লোহাটুলি স্টেশনে থামতেই চারবন্ধু নেমে পড়ল। ছোট্ট স্টেশন। ওদের সাথে নামল কিছু দেহাতি মানুষজন। আদিবাসী মুন্ডা, ওঁরাও, হো আমজনতা। ওদের ভাষায় খুব কথা শুরু করল।
বৃষ্টি এখন একটু ধরেছে। বৃষ্টির ঝিরিঝিরি জল মাথায় করেই ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে চলে এল। স্টেশনের পাশেই আজ হাট বসেছে। হাটের ভিড় চোখে পড়ল বাইরে এসে।
রণজয় বলল, “ড্রাইভারটা কোথায় গাড়ি রেখেছে দেখ তো? “
যিশু বলল, “ওর গাড়ি ব্ল্যাক স্করপিও বলেছে।” তমাল ছটফট করে বলল, “আরে ওই তো লোকটা হাত নেড়ে ডাকছে, মনে হয় ওই আমাদের ড্রাইভার।”
দীপ চিৎকার করে বলল, “আপ কা নাম লাল্লু সিং?”
“হাঁ। হাঁ। ইধার আ জাইয়ে।”
ছুটতে ছুটতে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল চার জংলী। শুরু হয়ে গেল জঙ্গল সফর।
লোহাটুলি স্টেশন থেকে মুর্গাশূলীর জঙ্গল তিরিশ কিমি পথ। পুরো পথটাই খুব রোমাঞ্চকর। বুনো আনন্দ উপভোগ করা যায়। পথের দু’পাশে ঠাস বুনোটের সবুজ জঙ্গল। এই জঙ্গল হাতির জন্য বিখ্যাত। জংলী ভয়ংকর সব হাতিদের আনাগোনা চোখে পড়ে। তাই চোরা শিকারীদেরও লুকোচুরি চলে মুর্গাশূলীর জঙ্গলে।
মুর্গাশূলীর বনবাংলো নতুন করে তৈরী হয়েছে কয়েকবছর আগে। প্রাচীন বাংলোটাকে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল জঙ্গীরা। সেই সাহেবী আমলের বাংলোটাকে নতুন করে আবার তৈরী করে পর্যটকদের জন্য ভাড়া দেয় বন দফতর। কিন্তু চট করে পাওয়া যায় না।
রণজয় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দু’ রাত্রির জন্য বুকিং যোগাড় করেছে। বাংলোতে পৌঁছেই মন ভালো হয়ে গেল সকলের। বৃষ্টিভেজা জঙ্গলে সোঁদামাটির গন্ধ মেখে বনবাংলোটা চমৎকার। চারমূর্তি স্করপিও থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ল। চনমনে ছটফটে চঞ্চলতায় চারবন্ধুই যেন একসাথে বলল, “ওয়াও! জবাব নেই। দিল মাঙ্গে মোর!..”
ছুটে এলো গাড়ির কাছে দুটো দেহাতি যুবক। ওরা এই বনবাংলোর কেয়ারটেকার কাম কুক। রণজয় জানত ওদের কথা। তাই প্রথমেই বলল, “নাম বোলো?”
-‘মঙ্গল হোনহাগা।’ অন্যজন বলল,’ রামুলাল কুর্তি।’
রণজয় আর যিশু ওদের হাতে দুদিনের পুরো রেশনটা তুলে দিয়ে বলল, “চটজলদি চা বানাকে লে আও!..”
বনবাংলোর চারপাশ তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা। সদর দরজাটা বেশ বড়। বাংলোর হাতায় প্রাচীন কয়েকটা অর্জুন, অশথ, শাল, শিমূল, মহুল গাছ চোখে পড়ল। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা গাছও আছে কিছু। তুলনায় ফুলের গাছ কম। বাংলোর চারপাশে ঘন জঙ্গল। একটু দূরে পাহাড়ি একটা আঁকাবাঁকা নদী আছে। নদীর নাম লালমুণি। আর আছে একটা ভালু গুহা। সেটা নাকি ভয়ংকর। এই জঙ্গলে হাতি ও ভালুক দুটোই দেখা যায় বেশি। তাই সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। বাংলোটা মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে বেশ মজবুত করে বানানো। আগের বাংলোটা ছিল কাঠের। এটা একদম ক্রংকিটের শক্তপোক্ত একটা বাড়ি। চট করে হাতি এসে আক্রমণ করতে পারবে না।
অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে হয়। তিনটে বড় বড় ঘর। বিরাট লম্বা বারান্দা। একটা বড় ডাইনিং হল ও কিচেন।
চার বন্ধু মালপত্তর রেখে গা ঝাড়া দিয়ে বারান্দায় এসে বসল। মঙ্গল আর রামুলাল কাজে লেগে গেছে। চা রেডি। যিশু হঠাৎ বলল, “কি আশ্চর্য দেখ এই বাংলোটা কত উঁচুতে কি মজবুত করে বানানো আর ওই দেখ বাংলোর সীমানায় একটা দুবলা ঘর একদম মাটিতে শুয়ে!..”
চা চলে এসেছে। সবাই চা হাতে নিয়ে প্রথম চুমুকটা দিয়ে তৃপ্ত হয়ে হাসল। দীপ বলল, “এবেলা কি রান্না হবে বলে দে রণো।”
রণজয় মঙ্গলকে দুপুরের রান্না বুঝিয়ে দিচ্ছে। ওকে সাহায্য করছে দীপ। যিশু চা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল বাগানে। রামুলাল বাগানের এককোণে কুয়োতলায় বসে বাসন ডেকচি সব ধুয়ে সাফা করছে।
যিশু গিয়ে ওকে বলল, “এই বাংলো এত উঁচু করে বানিয়েছে কেন?”
-বাবু, ইধার বহুত হাতি হ্যায়। একদোম জংলী হাতি। কাভি কাভি ও আ যাতা হ্যায় বাংলোমে।
– উসলিয়েই ইতনা উচা করকে বাংলো বানায়ে ফরেস্ট লোক!.
– হাঁ। হাঁ। একদোম ঠিক বাত হ্যায়।
– আচ্ছা,ও ছোটা ঘর কিস লিয়ে।
– বাবু ও তো চৌকিদারকা ঘর। রাত মে চৌকিদার আতা হ্যায়।
– আচ্ছা!.. উনকো ঘর কাঁহা?
– ইস গা্ওমে হ্যাঁয়। হামলোক ঘর চল যাতা হ্যায় রাতমে। চৌকিদার রহেতে হ্যায় ইধার।
যিশু ওকে আর কিছু না বলে চৌকিদারের ঘরটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোট্ট একটা মাটির ঘর। ঘরে চৌকি রয়েছে একটা। মলিন বিছানা, বালিশ। ও এখানেই থেকে রাতপাহারা দেয়। দূরে বনবাংলো। বাংলোয় অতিথিরা থাকে। তাদের দেখভাল করাই ওর কাজ।
যিশু আনমনে দাঁড়িয়ে ছিল ঘরটার কাছে। কখন যে তমাল এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করে নি। তাই চমকে উঠে বলল, “তুই কখন এলি!..”
-“এত গম্ভীর ভাবে কি ভাবছিলিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখতে চুপিচুপি চলে এলাম।”
“দেখ কি ইন্টারেস্টিং, বনবাংলো পাহারা দেওয়ার জন্য চৌকিদারের ঘরটা। “
-“দেখছি তো!..”
– “বনবাংলোটা দেখছিস?”
– “হ্যাঁ দেখছি।”
– “কোন ফারাক বুঝতে পারছিস?”
– “বনবাংলোটা অনেক উঁচু করে বানানো হাতির কথা ভেবে।”
– “ঠিক। আর হাতি তাড়ানোর জন্য যে চৌকিদার থাকবে তার ঘরটা দেখ মাটির সাথে শুয়ে.. “
– “হা হা হা… তুই পারিসও এসব নজর করতে..”
– “কি ইন্টারেস্টিং না!..”
– “সে তো বটেই। চল চল এখন আসর বসবে!.. “
এত সিরিয়াস হয়ে পড়লে মজা করা যাবে না!..
আসর জমে গেছে। মঙ্গল আর রামুলাল সমানে যোগান দিয়ে যাচ্ছে চাট-মশলা, ছোলা, বাদাম সব কিছু। মোরগা কষা হচ্ছ। একটু পরেই দিয়ে যাবে। একসময় রণজয় বলল, “শোন ওদের দু’জনকেও একটু মাল খাইয়ে দেব। খুব খাটছে বেচারিরা!..”
“আলবাৎ দিবি!..”তমাল জড়ানো গলায় বলল, “আর বলবি এক নম্বর মহুয়া পাওয়া যায় কিনা?..”
-“তুই কি মহুয়াও খাবি!..”
-“পেলে এট্টু খেতাম। লাস্ট খেয়েছিলাম সেই কবে কাঁকড়াঝোরে, গোপীরাম মাহাতোর ঘরে।”
“যিশুটা কোথায় গেল রে! এক পেগ খেয়েই ধাওয়া!.” দীপ টাল খাওয়া মেজাজে বলল।
তমাল বলল, “বলে তো গেল না কোথায় যাচ্ছে..”
রণজয় হাসতে হাসতে বলল, “বলেছে, আমাকে বলেছে , ও একটু সাব অল্টার্ণ স্টাডিজে গেছে!..”
“মানে!..” তমাল অবাক হয়ে বলল!..
দীপ বলল, “ও তো একটু আমাদের মধ্যে আঁতেল, তাই..”
রণো বলল,”জেরুজালেমেও ঘুরে আসতে পারে!..”
তমাল এক চুমুকে পেগটা শেষ করে বলল,” অ! বুঝেছি..”
“কি বুঝেছিস!..”রণো চোখ নাচিয়ে বলল।
“বুঝেছি। কিন্তু বলব কেন!..”তমালও চোখ নাচায়।
“ও হা হা.. ও হা হা হা.. হো হো হো…” মুর্গাশূলীর জঙ্গল এবার তিন বন্ধুর অনাবিল অট্টহাসিতে গম গম করে উঠল।