অণুগল্পে সুব্রত সরকার
ব্রতীনের স্কুল
সুব্রত সরকার
সন্ধ্যা ঘন হতেই আঁধার নেমে এল চারপাশে।
গাঁয়ের শেষপ্রান্তে ব্রতীনের স্কুল। সকালে গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা পড়ে। সন্ধে বেলায় পড়তে আসে ওদের মায়েরা।
ব্রতীনের এই অবৈতনিক সহায়ক শিক্ষার পাঠশালাটি দিনে দিনে বেড়ে উঠে একটা পরিচিতি পেয়েছে। ফলে সম- মনোভাবাপন্ন মানুষজনদের পাশে পেয়েছে অনেক। সকলের সহযোগিতায় ব্রতীনের স্কুল এখন এই গ্রামের সকলের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে।
সপ্তাহে দুদিন সন্ধেবেলায় আদিবাসী মায়েরা পড়তে আসে। প্রথমে কথা হয়েছিল ওরা নাম লেখাটা শুধু শিখবে। সেই কথা মত চল্লিশ জন আদিবাসী মহিলা নাম লেখাটা মোটামুটি শিখে নিতেই ওদের উৎসাহ বেড়ে যায়। আবদার করে বলে, “দাদা, আমরা আরেট্টু শিখব। তুই শিখা।”
এখন ওরা ছোট ছোট যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ শিখছে। এক দুই… একশো পারে। ওয়ান টু..হান্ড্রেড বলতে পারে। লিখতে পারে। এক থেকে দশ ঘরের নামতা বলতে পারে। নিজের নাম ঠিকানা বাংলা- ইংরেজি দু’ভাষাতেই লিখছে। শিখছে।
কদিন আগেই সুখি সরেন হাসতে হাসতে বলল, “দাদা, কাল লোনের ফরমে সই করে এলাম”। টিপ ছাপ দেওয়ার কলঙ্ক থেকে মুক্তির আনন্দ ওর চোখে মুখে ছিল।
এই আদিবাসী শিক্ষার্থী মায়েদের ক্লাস দেখতে আজ শহর থেকে কয়েকজন শুভাকাঙ্খী এসেছেন। এদের মধ্যে একজন ব্রতীনের পূর্ব পরিচিত। বাকি তিনজন অপরিচিত। সকলেই প্রবীণ প্রাজ্ঞ মানুষ। ব্রতীনের এই কাজের অনেক প্রশংসা করলেন। মায়েদের এই ইচ্ছের জয়গান করলেন। মায়েদের সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলেন। ওদের আরো উৎসাহ দিলেন।
শিক্ষার্থী মায়েরা এখন বেশ সপ্রতিভ হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিক ভাবে সুন্দর কথা চালিয়ে যেতে পারে। এমন কথার ছলে গল্প করতে করতে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী প্রবীণ বললেন, “তোমরা কতদূর থেকে আসো?”
মায়েরা বলল, “হুই সাঁওতাল পাড়া থেককে আসি?”
“অন্ধকারে আসতে ভয় করে না?”
“কি করব!.. আসতি তো হবেক। শিখতি যে চাই পড়ালিখা।”
“তোমাদের বর’রা কিছু বলে না?”
“কি বুলবে? পড়ালিখা কি খারাপ?”
“তোমরা কিছু করো?”
“হাঁ করি। মাঠে কাজ করি। লজে কাজ করি।”
“লজে কি কাজ করো?”
“ঝাঁট দিই। বাসন মাজি। কাপড় কাচি।”
“তোমাদের কাছেই তো জঙ্গল ? জঙ্গলে যাও?”
“যাই। কুখনো সুখনো যাই।”
“কেন যাও?”
“কাঠ কুড়াতে যাই। সরকারী গাছ রুইতে যাই। গাছ রুইয়ে পয়সা পাই।”
“জঙ্গলের কাঠ কাটো তোমরা?”
হঠাৎ করে কথার প্যাঁচে ফেলে দিয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী উদগ্রীব এবার উত্তর শোনার জন্য। ওদের তিন দিদিমণিও চমকে গেছে, কি বলবে কে জানে!.. ব্রতীন শান্ত হয়েই এই কথোপকথন পর্ব উপভোগ করছে। বাকি তিনজন শুভাকাঙ্ক্ষী চেয়ে আছেন ওদের মুখের দিকে। এমন সময় দীপা টুডু বলল, “জঙ্গলে মরা কাঠ, ঝরা কাঠ, শুখা কাঠ কিছু কুড়াই দাদাবাবু। ওগুলাই বোঝা করে করে আঁটি বেঁন্ধে লিয়ে আসি। জ্বালানি হয়।”…
শুভাকাঙ্খী বন্ধুজনরা এবার চলে যাচ্ছেন। স্কুলের গেটের কাছে এসে ব্রতীনের একটা হাত শক্ত করে ধরে তিনি বললেন, “আসলে আমি তো দীর্ঘদিন ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছি। ফিল্ডে যেতে হোত। তাই এইরকম কথা বলে বলে কথা বের করার বদঅভ্যাসটা রয়ে গেছে। চাকরী জীবনে এভাবে অনেকবার জিতেছি। আজ পারলাম না। দীপা টুডু জিতে গেল!..”
ব্রতীন এসে এবার ওদের কাছে দাঁড়াল। দিদিরা ক্লাস শুরু করে দিয়েছে। সবাই বোর্ডের দিকে তাকিয়ে লিখছে। দীপা দাদার দিকে চেয়ে বলল, “তুমার ঐ লুকটা সহজ মানুষ লয় গো দাদা!”
সমাপ্ত