শনিবারের গল্পে সুব্রত সরকার

টিপুর ইচ্ছে

সেই পাখিটা আজ আবার টিপুদের ছাদে এসে বসেছে। টিপু নাম জানে না পাখিটার। ছোট্ট নয়, বেশ বড় লম্বা লেজের একটা নতুন পাখি। ঠোঁটটা লাল, গলাটা হলুদ, ডানাদুটো বেশ সবুজ আর চোখদুটো কি সুন্দর! এমন একটা নতুন পাখি হঠাৎ হঠাৎ এখন চলে আসে টিপুদের ছাদে।
টিপুর স্কুল বন্ধ। লকডাউনের ছুটি। আনলক ওয়ান শুরু হয়েছে। বাবা এখন আবার অফিসে যাচ্ছে। মা দোকানে-বাজারে যাচ্ছে। পার্লারে-মন্দিরে যাচ্ছে। ব্যাঙ্কে যাচ্ছে। কিন্তু টিপু স্কুলে যেতে পারছে না। সাঁতারে যেতে পারছে না। ড্রয়িং ক্লাসে যেতে পারছে না। ছোটদের জন্য সব বন্ধ।
এত লম্বা ছুটি টিপু কোনওদিন পায় নি। তাই মাঝে মাঝে আনন্দ হলেও, আবার ভালোও লাগে না। স্কুলে গেলে কত মজা। বন্ধুদের সাথে খেলা, গল্প করা, একসাথে বসে টিফিন খাওয়া কত কিছু হয়। কিন্তু স্কুল এখনও অনেকদিন বন্ধ থাকবে।
টিপু বাবার সাথে চুপি চুপি ছাদে উঠে এসেছে। আজ পাখিটার একটা ছবি তুলতেই হবে। বাবা মোবাইল ক্যামেরায় দূর থেকে জুম করে পর পর অনেকগুলো ছবি তুলে ফেললো। নতুন পাখিটা চুপ করে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে! টিপু ফিস ফিস করে বাবাকে বলল, “বাবা একটা ভিডিও করো না”।
বাবা ভিডিও অন করে দু’পা এগোতেই পাখিটা উড়ে গেল। উড়তে উড়তে দূরে চলে গেল। পাখিটা হয়তো উড়ত না, কিন্তু হঠাৎ মাইকের আওয়াজ ভেসে আসতেই ও চমকে উঠে পালিয়ে গেল!
একটা ম্যাটাডর ভ্যানের সাথে অনেক লোক হাঁটছে। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, “বন্ধুগণ, আপনারা সবাই জানেন আম্ফান ঝড়ে সুন্দরবন বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ ঘর-বাড়ি সব হারিয়ে ত্রান শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা সেই অসহায় মানুষদের জন্য ত্রান সংগ্রহ করছি। আপনারা সাধ্যমত অর্থ ও পুরনো কাপড়-জামা দিয়ে সাহায্য করবেন। আপনাদের এই দান-সাহায্য আমরা পৌঁছে দেব সুন্দরবনের বিপন্ন সেই সব মানুষগুলোর কাছে”।
বাবা বলল, “টিপু চল নিচে যাই। মাইকে কি বলছে শুনছিস তো?”
–“সুন্দরবনের কথা বলছে তো”।
–“হ্যাঁ রে সেই সুন্দরবন। আমরা লঞ্চে করে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তোর মনে আছে?”
–“আছে তো। ক্যানিং, গদখালি, গোসাবা, রাঙ্গাবেলিয়া, সজনেখালি, পাখিরালয় সব নামগুলো লেখা আছে আমার ভ্রমণ ডাইরিতে”।
–“এই গ্রামগুলো এখন আর ভালো নেই। আম্ফান ঝড়ে ওদের বাড়ি-ঘর সব নষ্ট হয়ে গেছে। ওদের জন্য কিছু সাহায্য করা দরকার। চল নিচে যাই। মাকে বলি, পুরানো কাপড় জামাগুলো বের করতে”।
মাইকে আবার ঘোষণা হচ্ছে, “বন্ধুগণ, আমরা অপেক্ষা করছি। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা আপনাদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, আপনাদের দান-সাহায্য ওঁদের হাতে তুলে দিন”।
মা আলমারি খুলে অনেক পুরনো কাপড়-জামা, বিছানার চাদর, মশারি বের করে ফেলল। বাবাও খুঁজে খুঁজে নিজের পাজামা-পাঞ্জাবি, টিশার্ট এনে মাকে দিল। মা একটা পাঞ্জাবি রেখে দিয়ে বলল, “এটা থাক। এই পাঞ্জাবিটা মা তোমাকে জামাইষষ্ঠীতে দিয়েছিল”।
মা-বাবা যখন পুরনো কাপড়-জামা সব গোছাচ্ছে ওঁদের দেওয়ার জন্য, টিপু তখন বাড়ির মধ্যে খালি দৌড়াদৌড়ি করছে। টিপুও যেন কিছু দিতে চায়। কিন্তু কি দেবে ভেবে পাচ্ছে না।
কলিংবেল বেজে উঠল। বাবা বলল, “একটু দাঁড়ান। আসছি”।
গেটের কাছে দু’তিনজন স্বেচ্ছাসেবক কাকু মাস্ক পড়ে দাঁড়িয়ে। বাবা অনেক পুরনো কাপড়-জামা, চাদর, ওষুধ ও পুরনো বাসন দিল। তারপর টাকাও দিল। স্বেচ্ছা সেবক কাকুরা খুব খুশি হয়ে অনেক ধন্যবাদ জানাল বাবাকে। বাবা বলল, “আপনারা কবে যাবেন এসব পৌঁছে দিতে?”
কাকুরা বাবার সাথে কথা বলছে। টিপু সে সময় দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এল দুটো খেলনা রেল গাড়ি, একটা এরোপ্লেন, বাঁশি, জলতরঙ্গ, দুটো মিকি মাউস ও অনেকগুলো রঙ পেন্সিল।
–“কাকু তোমরা এগুলো নাও”। বাবা তো অবাক হয়ে বলছে, “দুর বোকা এসব খেলনা এখন কেউ দেয়?”
টিপু মুখ কালো করে খেলনাগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মা এসে বলল, “এখন ওদের বাড়ি-ঘর সব জলে ভেসে গেছে। এসব খেলনা নিয়ে ওরা কি করবে?”
স্বেচ্ছাসেবক কাকুরা বলল, “না না এই খেলনাগুলো খুব কাজে লাগবে। ত্রাণ শিবিরে অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আছে। ওদের দিলে ওরা দুঃখ ভুলে একটু খেলার আনন্দে মেতে থাকবে। দাও। দাও। তুমি খুব ভালো ভেবেছো”।
টিপুর কি আনন্দ হচ্ছে তখন মনে। সব খেলনাগুলো কাকুরা হাসতে হাসতে নিয়ে বলল, “তোমাকে থ্যাঙ্ক ইয়ু বলতেই হয়। আমরাও ভাবতে পারি নি, এসব পুরনো খেলনাও যে
মানুষের কাছে চাওয়া যায়”।
ম্যাটাডর ভ্যানটা ভরে গেছে জিনিসে। সবাই অনেক কিছু দিয়েছে। খেলনা এই প্রথম কেউ দিল। মাইকে হঠাৎ ভেসে এল ঘোষণা, “বন্ধুগণ, পুরনো কাপড়-জামা, থালাবাসনের সাথে আপনারা চাইলে ছোটদের পুরনো খেলনা, পুতুল এসবও দিতে পারেন। কারণ ত্রাণ শিবিরে অনেক ছোট ছোট বাচ্চারা রয়েছে । তারা একটু খেলতে পারবে। দুঃখ ভুলে হাসতে পারবে”।
মা টিপুকে ঘরে নিয়ে গিয়ে খুব আদর করল। বাবা বলল, “নতুন পাখিটার ছবিগুলো দেখবি না!”
টিপু হাসতে হাসতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “দেখি দেখি!”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।