সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ৯)

দেবমাল্য

তার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, যে কোনও সময় আশপাশের গাছ থেকে তার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। সে আরও কী কী বলছিল, যত বলছিল ততই রোমাঞ্চ লাগছিল তার। কথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সে। বলেছিল, ওই দেখুন, একটা ময়াল সাপ।
ময়াল কি না ও চিনতে পারেনি। তবে দেখেছিল, কয়েক হাত লম্বা আর এইসা মোটা একটা সাপ অত্যন্ত শ্লথ গতিতে হেলতে-দুলতে হেলতে-দুলতে ওদিকের জঙ্গল থেকে রাস্তা পেরিয়ে এদিকের জঙ্গলে ঢুকছে।
পেছনে রাখা ছিল পাঁচ লিটারের দুটো জার। দুটোরই মুখ সিল করা। কিন্তু হাতের এক লিটারের বোতলটা শেষ হতেই পেছনে ঝুঁকে দেখে, দুটোর একটাতেও জল নেই। কাত হয়ে পড়ে আছে। কী হল! তুলে দেখে, দুটো জারেরই নীচের দিকে ফাটা। অথচ ও তখন জঙ্গলের মাঝামাঝি জায়গায়। ভেতরে গেলে যতটা যেতে হবে, সোজা রাস্তা ধরে অন্য যেদিক দিয়ে ওদের বেরোনোর কথা, সেদিক থেকে বেরোতে গেলেও প্রায় ততটাই যেতে হবে। তাই আর ফেরার রাস্তা ধরেনি ও। জঙ্গলের মাঝে মাঝে আদিবাসীদের গ্রাম চোখে পড়লেও, কারও কাছ থেকে এক গ্লাস জলও খায়নি। ড্রাইভার বলেছিল, এখানকার জল খুব ভাল। খেয়ে দেখতে পারেন।
ও ড্রাইভারের কথায় কান দেয়নি। উল্টে নাক সিঁটকেছিল। বলেছিল, আর তো কিছুক্ষণ। এতক্ষণ যখন জল না খেয়ে থাকতে পেরেছি, বাকি সময়টাও পারব। চলো…
সারাটা পথ জল না খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছিল দেবমাল্য। ও বলে, জল খুব দেখেশুনে খাওয়া উচিত। এই জল থেকেই যত রোগের উৎপত্তি।
সেই দেবমাল্য টেবিলের ওপরে তাকিয়ে দেখল, হোটেলে ঢোকার সময় দু’লিটারের যে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা নীচ থেকে দিয়ে গিয়েছিল, সেটা একদম খালি। পাশে একটা জগ। টুবুটুবু ভর্তি। ওই বোতলের সঙ্গেই ওটা রেখে গিয়েছিল হোটেলের বেয়ারা, যদি লাগে! ও ওটা ছুঁয়েও দেখেনি। এখন সেটাই এক ঝটকায় তুলে ঢকঢক করে খেতে লাগল। যতটা খেল, তার থেকে বেশি উছলে পড়ে মুহূর্তের মধ্যে ওর মুখ, গলা, বুক, পাঞ্জাবি ভিজিয়ে, পেট-টেটও ভাসিয়ে দিল।
জল খেয়ে একটু দম নিল ও। তার পর বাথরুমে ঢুকে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার জলের ঝাপটা মারল মুখে। টাওয়াল দিয়ে মুছে, মোবাইলে দেখল, চারটে বাজতে এখনও অনেক দেরি। সবে দুটো আঠাশ। ও ফের খাটে উঠে গেল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সিলিঙের দিকে। চোখের পলক স্থির হয়ে রইল। মাথার ভেতরে ছোটাছুটি করতে লাগল হাজার একটা চিন্তা, দুশ্চিন্তা।
কিছুতেই সময় কাটছে না। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। এখনও কি সকাল হয়নি? ফের মোবাইল নিয়ে দেখে দুটো চৌত্রিশ। তার মানে এতক্ষণে মাত্র ছ’মিনিট হয়েছে!
কখনও কখনও এ রকম হয়। সময় কাটতেই চায় না। আবার কখন যে হুস করে সময় পেরিয়ে যায়, বোঝা যায় না। আজ তানিয়ার আসার কথা!
সে যখন কালীবাবুর বাজারে থাকে না, তার ব্যবসাটা মূলত সামশেরই দেখে। ভীষণ বিশ্বস্ত। নিজের ভাইয়ের চেয়েও বেশি। ঘরের ছেলেই হয়ে গেছে বলা যায়। পুজোর সময় কেনাকাটায় কিংবা তানিয়াকে বাপের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপার থাকলে, দেবমাল্য যদি সময় করে উঠতে না পারে, সামশেরকে একবার বললেই হল, ঝপাঝপ কারখানার সব কাজ সেরে ও ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে বউদির কাছে। নিজের বউদির থেকেও বেশি সম্মান করে তার বউকে।
ওকেই দায়িত্ব দিয়েছিল, তানিয়াকে যেন ঠিকভাবে ট্রেনে তুলে দেয়। ও বলেছিল, বউদি একা একা যাবে, সেটা কি ঠিক হবে? কোনও দিন তো এভাবে কোথাও যায়নি, আমি কি পৌঁছে দিয়ে আসব?
দেবমাল্য বলেছিল, কী দরকার? তুই ওখান থেকে ট্রেনে তুলে দিবি। আমি এখান থেকে নিয়ে আসব। মাঝে তো মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। কিছু হবে না। তুই বরং কারখানাটা সামলা। কোনও ঝামেলাটামেলা হলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করিস, কেমন?
যদিও ও জানে, শুধু ছোটখাটো নয়, বড় কোনও সমস্যা হলেও সামশের কখনও ওকে খুব একটা মাথা ঘামাতে দেয় না। যত বড় ঝড়-জলই হোক, ও ঠিক সামলে নেয়। আর তার থেকেও বড় কথা, ও ভীষণ দায়িত্ববান।
তানিয়াকে ট্রেনে তুলে দিয়ে সামশের কাল রাত এগারোটা নাগাদ ফোন করেছিল। বলেছিল, এইমাত্র ট্রেন ছেড়ে দিল। মনে আছে তো কোচ নম্বর? এস ফোর। সিট নম্বর তেইশ। যেদিকে ছ’টা সিট থাকে, সেই খোপের সামনে জানালা বরাবর যে মুখোমুখি দুটো সিট থাকে তার একটা। বউদির উল্টো দিকে যে বয়স্ক ভদ্রলোক বসেছেন, একটু পরেই তিনি ওপরের বাঙ্কে চলে যাবেন। বউদি তখন নীচের সিট দুটোকে জোড়া লাগিয়ে শুয়ে পড়তে পারবেন। কোনও অসুবিধা হবে না। যাবার সময় শুধু পাম্প বালিশটা নিতে ভুলে গিয়েছিলেন, তাই একটা কিনে দিয়েছি।
দেবমাল্য বলেছিল, আমি থাকলে তাও কোনও অসুবিধে হতে পারত। কিন্তু তুই সঙ্গে থাকলে যে তোর বউদির কোনও অসুবিধা হবে না, তা আমি জানি।
— চারটে নাগাদ ট্রেনটা ওখানে পৌঁছনোর কথা। একটু এদিক ওদিক হতে পারে। আমার মনে হয়, একটু আগে গিয়ে দাঁড়ালে খুব ভাল হয়। বলা তো যায় না, ট্রেনটা যদি আগে পৌঁছে যায়। বউদি তো ওখানকার কিছু চেনে না…
সামশের ভারী অদ্ভুতভাবে কথা বলে। তার বউকে আপনি-আজ্ঞে করে বললেও, তাকে কিন্তু কখনও কোনও সম্বোধন করে কিছু বলে না। যা বলে, সবটাই সম্মোধন উহ্য রেখে বলে। ভাববাচ্যে।
আসলে দেবমাল্যর বাবার আমলে সামশেরের বাবা কাজ করতেন। সে সময় বাবার হাত ধরে প্রায়ই সামশের চলে আসত দেবমাল্যদের কারখানায়। দেবমাল্যর চেয়ে বয়সে একটু ছোট হলেও সামশেরের সঙ্গে ওর খুব ভাব ছিল। সামশেরের পাল্লায় পড়েই ও রোজ সকালে ওর সঙ্গে পার্কে হাঁটতে যেত। সামশেরের দেখিয়ে দেওয়া ফ্রি-হ্যান্ড এক্সাসাইজ করত। গোটা পার্ক রোজ চারবার দৌড়ত। আর এটা করতে করতেই বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল দু’জনের। দেবমাল্য ওকে ‘তুই’ করে বললেও সামশের ওকে ‘তুমি’ করে বলত। কিন্তু পরে, যখন দেবমাল্যর বাবা শারীরিক কারণে আস্তে আস্তে কারখানায় আসা কমিয়ে দিলেন, কারখানায় বসা শুরু করল দেবমাল্য, তখন সামশেরের বাবা সামশেরকে নিয়ে একদিন দেবমাল্যর কাছে এলেন। যদি তাঁর ছেলেকে এই কারখানায় একটা কাজ দেওয়া যায়!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।