সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ২)

কেমিক্যাল বিভ্রাট

কিন্তু যেহেতু মনের মধ্যে একবার খটকা লেগেছে, তাই ওটা বাড়ি নিয়ে এলেও, পাশের বাড়ির জয়া বউদি যখন বললেন, আমি তো কখনও পুরী যাইনি, আর এত দিনেও যখন হয়নি, আর কোনও দিন যাওয়া হবে বলেও আমার মনে হয় না। তুমি যদি এটা আমাকে দাও, তা হলে খুব ভাল হয়। আমি ঠাকুরের আসনে রাখব। তুমি যে দাম দিয়ে এটা কিনে এনেছ, সেই একশো টাকা না-হয় আমি তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। তুমি তো মাঝে মাঝেই পুরী যাও, আবার যখন যাবে, তখন না-হয় কিনে নেবে।

ঔপমানব আর কথা বাড়াননি। ধ্বজাটা তাঁকে দিয়ে দিয়েছিলেন। জয়া বউদি খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু খুশি হননি তাঁর বউ জবালা। বলেছিলেন, সাধ করে কোনও কিছু কিনে এনে এ ভাবে কি কেউ ঠাকুরের জিনিস কাউকে দেয়? একটা মঙ্গল-অমঙ্গল বলে কথা আছে তো, নাকি…

ঔপমানব বলেছিলেন, উনি যে ভাবে বললেন, তার পরেও কি কাউকে না বলা যায়, বলো? ঠিক আছে, তোমাকে কথা দিলাম, এর পরে যখন যাব, তখন এর চেয়েও ভাল একটা নিয়ে আসব। কেমন? কী? এ বার শান্তি তো?

সেই মতো মনে মনে যখন ভাবছেন, ওই সেবাইত নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেকে ছেঁকে ধরার আগেই  চট করে গিয়ে তিনি একটা ধ্বজার টুকরো কিনে নেবেন। সে জন্য আগেই হাতের মধ্যে রেডি করে রেখেছেন একটা একশো টাকার নোট।

কিন্তু কোথায় সেই সেবাইত? উনি তো নামলেন। কিন্তু গেলেন কোথায়? এখনও আসছেন না কেন? পায়ের সামনের আঙুলের ওপরে ভর দিয়ে গোড়ালি উঁচু করে যতটা পারা যায়, টানটান হয়ে সামনের কালো কালো মাথাগুলির ও পারে যখন ইতিউতি তাকাচ্ছেন, হঠাৎ খেয়াল করলেন, পেছন থেকে কে যেন তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে ডাকছেন। কে ডাকছেন? পেছন ফিরতেই দেখেন, একজন সেবাইত। চুপিচুপি তাঁর দিকে একটা ধ্বজা এগিয়ে দিয়ে সেই সেবাইত বললেন, আগে মউ পাখুরু যৌটা কিনেথিলু, সেটা অরজিনাল নোহ্। এটা আসল। এই সাঙ্গে সাঙ্গে ঘিনিআসলি। উপরু তুমকু দেখি চিনি পারিলি। কাউকে কিছু কহিবা দরকার নাহি। নেই যা।

ঔপমানব বুঝতে পারলেন, উনি বলতে চাইছেন, গত বার আমার কাছ থেকে যেটা কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা অরজিনাল ছিল না। এটা আসল। এই মাত্র নামিয়ে আনলাম। উপর থেকে দেখেই আপনাকে চিনতে পেরেছি। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। নিয়ে যান।

তাই আগে থেকেই মুঠো করে রাখা একশো টাকার নোটটা তাঁর দিকে ঔপমানব বাড়িয়ে দিলেন। সেটা দেখে, উনি বললেন, না না, পয়সা লাগিবনি। আপনও গত থরও পয়সা দেইথিলে। যা। নেই যা এইটা। ঔপমানব খুব ভাল ওড়িয়া ভাষা না-জানলেও স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, উনি বলছেন, না না, টাকা লাগবে না। আপনি তো গত বারই টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। যান, এটা নিয়ে যান।

অবাকের পর আবার অবাক। কিন্তু বাড়ি ফেরার আগেই যে আরও একটা বড় অবাকের মুখোমুখি হবেন, উনি তা জানতেন না। গতবারের আগের বার এই জগন্নাথ এক্সপ্রেসে করেই ফিরছিলেন তিনি। সে বার একাই গিয়েছিলেন। জবালা নাকি মানত করেছিলেন, ছেলে যদি মাধ্যমিকে খুব ভাল রেজাল্ট করে, তা হলে পুরীতে গিয়ে পুজো দিয়ে আসবেন। না, খুব ভাল নয়। তার চেয়েও ভাল রেজাল্ট করেছিল তাঁদের একমাত্র ছেলে— অভিমন্যু। নাইন্টি এইট পারসেন্ট মার্কস পেয়ে সেরার সেরা কলেজে সরাসরি ভর্তি হয়ে গিয়েছিল সায়েন্স বিভাগে।

কিন্তু জবালা কিছুতেই ছুটি পাচ্ছিলেন না তাঁর স্কুল থেকে। তাই প্রায় জোর করেই ঔপমানবকে ঠেলে উনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পুরীতে। ফেরার সময় ঔপমানব সিট পেয়েছিলেন আপার বাঙ্কে। গাড়ি ছাড়ার পরেও আরও অনেকের মতো নীচের বাঙ্কেই বসে ছিলেন তিনি। রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে কথা বলতে বলতে উলটো দিকের এক যাত্রী এমন ভাবে তাঁর দিকে একটা গজা এগিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি আর না করতে পারেননি। কাকাতুয়ার গজা বলে কথা! কিন্তু ওটা মুখে দেওয়ার খানিক পরেই তাঁকে যে কী কালঘুমে পেল, তিনি আর দু’চোখের পাতা খুলে রাখতে পারলেন না। যেখানে বসে ছিলেন, সেই সিটেই শুয়ে পড়লেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।