ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব – ৩)

তীর্থভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

পূর্বে সারা বীরভূম জুড়ে বীরাচারসম্মত ধর্মানুষ্ঠান পালিত হত। বক্রেশ্বর, তারাপুর , লাভপুরের ফুল্লরা তলা, কঙ্কালীতলা ইত্যাদি জায়গায় তার প্রমাণ ‌ পাওয়া যায়।
হিউয়েন সাঙের গ্রন্থে ‘ কিরণ সুবর্ণ’ নামে একটি স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই কিরণ সুবর্ণ প্রাচীন তাম্রলিপ্তি( বর্তমান ,তমলুক) থেকে১১৭ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ছিল বলে জানা যায়। কানিং সাহেবের মতে এই ‘কিরণ সুবর্ণ’ সিংভূমে অবস্থিত। কিন্তু ফার্গুসন সাহেবের মতে বীরভূমির অন্তর্গত ‘নগর’ নামক স্থান ওই প্রাচীন ‘কিরণ সুবর্ণ’। যদিও এটিকে অভ্রান্ত বলে মনে করা যায় না,কারণ, নগরকে পারশি গ্রন্থে ‘লক্ষ্নুর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
বীরভূমে এককালে বৌদ্ধদের প্রাদুর্ভাব ছিল।’শিবাড়ী’ বৌদ্ধদের একটি নাম। ‘শিবাড়ি’ শব্দ হতে ‘ শিয়ারী’ বা অপভ্রংশে’ শিউড়ী’, বর্তমানে বীরভূম জেলার সদর মহকুমা ‘সিউরি’ হওয়া বিচিত্র নয়।

পৌরাণিক বা তান্ত্রিক যুগে বীরভূম সংক্রান্ত কিছু প্রবাদ ছাড়া আর কোনরূপ অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পর মহাদেব তাঁর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে যখন ভয়ঙ্কর প্রলয় নৃত্যে মেতে উঠেছিলেন, তখন সৃষ্টির রক্ষার তাগিদে দেবতাদের অনুরোধে, বিষ্ণু চক্র দিয়ে সতী দেহ ছেদন করায়, দেহের সেই সমস্ত অংশ বিভিন্ন স্থানে পতিত হয়ে 51 টি মহাপীঠ এবং ২৬ টি উপপীঠ তৈরি হয়। যেগুলি হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ ক্ষেত্রে রূপে পরিচিতি লাভ করে। বীরভূম ঐরকম পাঁচটি শক্তি ক্ষেত্র লাভ করায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এককালে সারা বীরভূম জুড়ে তন্ত্রসাধনার বহুল প্রচার ছিল।
রাঢ়ভূমি নিষাদ সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। পরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর বাংলার পুরাবৃত্ত গ্রন্থে বলেছেন–” সবর ও পুলিন্দ জাতীয় বর্বরগণ ও পুণ্ড্রগণ বঙ্গদেশের প্রাচীন অধিবাসী।রাঢ়ী কুলগ্রন্থে লেখা আছে—
” অপরে বলে নিবাসস্থান বীরভূম।
শবর,পুলিন্দ সঙ্গী, জ্ঞানেতে নিধূম।।

ছোটনাগপুর পার্বত্য অঞ্চলে যেসব বর্বর জাতির বাস ছিল, তাদেরকে ঐতিহাসিক রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় দ্রাবিড় জাতীয় বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে,” বঙ্গবাসিগণকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দ্রাবিড় ও মঙ্গলীয় জাতির সংমিশ্রণের ফল বলা যাইতে পারে।”( বাংলার ইতিহাস /১ম/২য় পরিচ্ছেদ/ পুনর্মুদ্রণ,১৩৮৯/পৃঃ১৭)
আর্য উপনিবেশ এর আগে এরাই ছিল প্রাচীন বাংলার অধিবাসী। আর আর্যদের এদেশে আগমনের পরেও অনেকদিন বাংলা ও মগধ স্বাধীন ছিল; সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কিছু আগে বঙ্গ ও মগধে আর্য সভ্যতা প্রচারিত হয় এবং এখানকার প্রাচীন অধিবাসীরা ক্রমে আর্যদের ভাষা আচার ব্যবহার ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি গ্রহণ করে। পার্বত্য নদী গুলি যেমন গঙ্গা এসে মিশে পার হয়েছে, তেমনি রাঢ়বঙ্গে বিভিন্ন অনার্য অভিভূত জাতিগোষ্ঠীর ও আর্য সংস্কৃতির সমন্বয় হয়েছে।
নৃতাত্ত্বিক বিচারে নানা মুনির নানা মত। স্যার হারবার্ট রীজলি বলেন, এখানে মঙ্গোৌলীয় ও দ্রাবিড় সংমিশন ঘটেছে; যদিও নৃতাত্ত্বিক রমা প্রসাদ চন্দ্র ও ডঃবিরজা শংকর গুহ মহাশয় তারা তাঁর মতের বিরোধিতা করেন।ড. অতুল সুর মহাশয় মন্তব্য করেন,” বাঙালি জাতি রীজলির তথাকথিত মঙ্গলীয় দ্রাবিড় গোপী সম্ভূত নয়।” উচ্চ শ্রেণীর বাঙালিরা ‘অ্যালপাইন’ পর্যায় ভুক্ত। এরা ছিলেন বহিরাগত।ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে —- বাংলাদেশের, বিশেষভাবে রাঢ় অঞ্চলের সাঁওতাল ,ভূমিজ, মুন্ডা,বাঁশফোঁড়, মাল পাহাড়ি প্রভৃতিরা যে সেই আদি অস্ট্রেলীয়দের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইহাতে তো সন্দেহ নাই ই নমঃশূদ্র,গোপ,বাউড়ী, বাগদি চন্ডাল প্রভৃতির মধ্যে এমন কি বাঙালি ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়েস্থদের মধ্যেও ভেড্ডিড( আদি অস্ট্রেলিয়) উপাদান রহিয়াছে এমন অনুমান নৃতত্ত্ব বিরোধী নয়।
আদি -অস্ট্রালদের ভাষা ছিল ‘অস্ট্রিক’। এই অস্ট্রিক ভাষাই বাংলা ভাষার ভিত্তি স্বরূপ। বাংলা ভাষায় এই অস্ট্রিক ভাষার রীতি বৈশিষ্ট্য ও শব্দ প্রাচুর্য লক্ষণীয়।
রাঢ়দেশ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজবংশীয়দের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। তারা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাদের প্রভাবে সমগ্র রাঢ়ের জনগণের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক চেতনায় যে পরিবর্তন ঘটে তার প্রভাব সমগ্র জেলার মন্দির নির্মাণে, মন্দির গাত্রের অলংকরণে, ভাস্কর্যে প্রতিফলিত হয়।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।