ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || সুব্রত সরকার – ৯

।। জাপানের ডায়েরি ।।
আজ ঘুম থেকে উঠে শুনলাম আমাদের হোটেলের ঘর- বারান্দা থেকে নাকি এক ঝলক মাউন্ট ফুজিকে দেখা গেছে!
জাপানের অন্যতম আকর্ষণ মাউন্ট ফুজি!..
আজ আমরা যাব সেই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তার আগেই অনেকে হোটেলে বসে দূর থেকে ঈষৎ দর্শন করে নিয়েছেন। সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে আমি ছিলাম না!..
আমাদের এই শহরের হোটেলে দেখলাম প্রচুর ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়। কোনও কলেজ থেকে ওরা এসেছে। সম্ভবত ভলিবল টুর্নামেন্টের জন্য মনে হয়। তাই ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে বেশ কলেজ জীবনের দিনগুলোর মত একটা ফিলিং হচ্ছিল। ওরা সবাই খুব হাসিখুশি। কিন্তু কথা বলতে গেলেই বিপত্তি। ভাষা সমস্যায় জর্জরিত হতে হচ্ছে। ইংরেজি বলতেই চায় না বা পারে না। কেমন অবাক চোখে চেয়ে কেবলই সরল ভাবে হাসে। এই হাসিটার মূল্য অনেক!..তাই সবশেষে দুজন দুজনকে “আরিগাতো”( অনেক ধন্যবাদ), ও “সায়োনারা” ( বিদায়!) বলে চলে আসি দূরে!..
আজ আমাদের যাত্রা শুরু হলো লেক আশির উদ্দেশে। শহর থেকে খুব দূরে নয়। যাওয়ার রাস্তাটা অল্প পাকদণ্ডী। পাহাড়ে বেড়ানোর মত আনন্দ হয়। গাছগাছালি অনেক চোখে পড়ল। রোদ ঝলমলে দিন।
লেক আশি বা হাকোনে হ্রদ বা আশিনোকো লেকও বলে। জাপানী ভাষায় এর অর্থ হলো- নলখাগড়ার হ্রদ। ‘আশি’ হলো – নলখাগড়া, ‘কো’ হলো – হ্রদ। হোনশু দ্বীপে অবস্থিত লেক আশি এক কথায় অপূর্ব। এই নীল জলের হ্রদের পাশে এসে দাঁড়ালে মন হারাবেই হারাবে! কী অসাধারণ নিসর্গ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে HAKONE এলাকার এই হ্রদ পর্যটকদের মুগ্ধ করে দেয়। এই হ্রদের নীল জলে যখন আমাদের লঞ্চ ভেসে চলল, তখন তো আনন্দ আর বাঁধ মানে না!.. যেমন সুন্দর হ্রদ, তেমন তার চারপাশের প্রকৃতি। আকাশও কী অসাধারণ নীল! বুূ্দ্ধদেব বসুর বিখ্যাত কবিতা “চিল্কায় সকাল” আমার মনে পড়ে যায়- ” কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায় / কেমন করে বলি? / কী নির্মল নীল আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর /… কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে / চারদিকে সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে / মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।”
আশি হ্রদে ভাসতে ভাসতে সৌভাগ্য থাকলে মাউন্ট ফুজির দেখা পাওয়া যায়। এছাড়া আরও এক আকর্ষণ হলো-জিনজা মন্দিরের কমলা টরি গেট। জলমগ্ন এই সুন্দর গেটটিকে দেখতে এত ভালো লাগে। মিয়াজিমায়ও দেখেছিলাম এমন গেট। এই গেটের অবিকল একটা রূপ দেখা যায় শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায়! জানি না রবীন্দ্রনাথ জাপানে এসেই এমন অপরূপ সুন্দর গেট দেখে গিয়েছিলেন বলেই কি তাঁর প্রিয় শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায় অবিকল তাকে নির্মাণ করিয়েছিলেন!
আশি লেকে জলভ্রমণ মনে রাখার মত স্মরণীয় স্মৃতি। নীল জলের ঢেউয়ে ভেসে ভেসে Moto Hakone Port, Hakone Sekishoato Port হয়ে পৌঁছে গেলাম Komagatake। তারপর কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে রোপওয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবার হবে এক অন্যভ্রমণ। এই Komagatake ropeway আমাদের পৌঁছে দেবে এক অপরূপ সুন্দর জায়গায়। ‘a unique experience offering stunning views of volcanic activity. And Soaring to breathtaking alpine views and thrilling hiking trails.’ এই কথাগুলো শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের আকর্ষণীয় ভাষ্য নয়, প্রকৃত সত্য কথা। কোমাগাটোকে রোপওয়েতে চড়ে ওপরের দিকে যেতে যেতে চারপাশের যে ল্যান্ডস্কেপ বিউটি, অ্যালপাইন ভিউ, এবং ঢেউ খেলানো অনেক সোনালি মেডো দেখেছি , তা দৃষ্টিসুখের আনন্দ তো বটেই, সার্থক সুন্দর এক বেড়ানোর সেরা স্মৃতিও!..
রোপওয়ে থেকে নামতে না নামতেই কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় সারা শরীর কেঁপে গেল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাও যাচ্ছিল না। প্রবল ঠান্ডা বাতাসে নিজেকে সামলে নিতে বেশ সময় লাগল। তারপর শুরু হলো এক অন্যরকম রোমাঞ্চ। চোখের সামনে অপরূপের আঙিনা। কি অপূর্ব সে এক দৃশ্য। হলুদ হয়ে আছে চারপাশের ঘাসজমি। দূরে বহুদূরে পাহাড়, ঝাপসা শৃঙ্গ আর মেঘে মেঘে ঢেকে যাওয়া আকাশ। সারা বিশ্বের পর্যটকরা এসে জড়ো হয়েছেন এই সুন্দরকে নিজের চোখে দেখবেন বলে, সাক্ষী হয়ে থাকতে চান এই রোমাঞ্চকর দৃশ্যসুখের স্মৃতি নিয়ে আজীবন।
আমি নিজের মতই একলা হয়ে গেলাম এই অপরূপের মাঝে। পায়ে পায়ে চলে গেলাম পাহাড় চূড়ায়। জায়গাটার নাম – Hakone Shrine Mototsumiy। সেখানে মন্দিরের মত একটা বন্ধ ঘর দেখলাম। এখানেও জাপানের সেই বিখ্যাত কমলা রঙের টরি গেট। আলাপ হলো জার্মানি থেকে আসা কয়েকজন পর্যটক বন্ধুর সঙ্গে। তাঁরাও এই প্রবল ঠান্ডা হাওয়ায় কাবু। দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। ওঁদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ফিরে এলাম আবার রোপওয়ের কাছে। আবহাওয়া অনুকূল পেলাম না। ভালো থাকলে এখান থেকে মাউন্ট ফুজিকে দুরন্ত দেখা যেত। এই না দেখার দুঃখগুলো আমাকে কখনো ভীষণ ভাবে মর্মাহত করে না। এটাই তো স্বাভাবিক। প্রকৃতি আমার খেয়াল মত তো চলবে না! এসেছি তাঁর দুয়ারে, খোলা মন ও খোলা চোখ নিয়ে অপেক্ষা করার মানসিকতা তৈরী করেছি অনেক দিনের সাধনায়, দেখতে পেলে ভালো, না পেলে দুঃখ করব না। যতটুকু দেখলাম, পেলাম, দিনের শেষে সেও অনেক!..
রোপওয়ে করে আবার নিচে নেমে এলাম। ফেরার পথেও সেই দৃশ্যসুখের আনন্দ। পাইনের বন, ঢেউ খেলানো হলুদ বুগিয়াল। নিচে নেমে এসে দেখি আমাদের বাস অপেক্ষা করছে। এবার হাকোনে ছেড়ে চলে যাব। এই হাকোনে জায়গায়টা দারুণ সুন্দর এক ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসাবে আদৃত। এখানে লেক আশি ছাড়াও অনেক কিছু দেখার আছে। যেমন Hakone Pampas Grass Fields, Gora park, Stone Buddhas, Chisuji falls, Odawarn Castle, Hotoku Ninomiya Shrine. এসব দেখতে হলে একটা দুটো দিন হাকোনেতে থাকতে হবে। লেক আশির সন্ধ্যা- রাত্রির রূপ দেখার আনন্দও পাওয়া সম্ভব হবে। আমাদের ট্যুর আইটিনারিতে যেতেতু একদিনে বাজিমাত প্রোগ্রাম, তাই অনেক না দেখা নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।
এবার আমাদের মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। শহরের মধ্যে এক সুন্দর রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলাম। CHOICE KITCHEN এর অন্দরে ঢুকে খুব ভালো লাগল। সুন্দর সুন্দর ক্রকারিজ, দেওয়াল জু্ড়ে ছবি ও বসার জায়গাটা অপূর্ব। খাবারগুলোও ভালো ছিল। ইন্ডিয়ান ও জাপানিজ দু’রকম খাবারই যথেষ্ট পেলাম। সঙ্গে ফ্রুট জুস, আইসক্রিম। সবাই বেশ তৃপ্তি করে খেয়েছি। তারপর শহরের খুব কাছেই দারুণ সুন্দর এক সরোবর ও বাগানের কাছে নিয়ে গেলেন আমাদের গাইড কাওয়াসাকি। এই জায়গাটা একটা শপিং সেন্টারও বটে। উজ্বল ঝকঝকে রোদ তখন। প্রচুর ট্যুরিস্ট ছড়িয়ে রয়েছে। ফুলের বাগানে শুধুই সেল্ফি তোলার ভিড়। কয়েকটা গোলাপী ও সাদা রঙের চেরি ফুলের গাছ দেখে মুগ্ধ হলাম। রোদ একটু নরম হয়ে আসতেই কাওয়াসাকি আমাদের তাড়া দিয়ে নিয়ে চললেন আজকের শেষ আকর্ষনীয় স্পটের কাছে।
এগিয়ে চললাম মাউন্ট ফুজির সেরা ভিউ পয়েন্টের কাছে-Izu National Park। এখনো পর্যন্ত জাপানের বিখ্যাত জনপ্রিয় মাউন্ট ফুজিকে সেভাবে দেখতে পাই নি। জাপানের তিনটি পবিত্র পর্বতের একটি হল মাউন্ট ফুজি। বাকি দুটো পর্বত – মাউন্ট তাতে ও মাউন্ট হাকু। মাউন্ট ফুজির উচ্চতা ৩৭৭৬ মিটার। এটি একটি লাভাগঠিত আগ্নেয়গিরি। ১৭০৭- ০৮ সালে শেষবারের মত অগ্নুৎপাত ঘটেছিল। ইউনেস্কো মাউন্ট ফুজিকে ২০১৩ সালের ২২ জুন বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ( World Cultural Heritage) স্বীকৃতি দেয়।
মাউন্ট ফুজির ভিউ পয়েন্টে যাওয়ার পথে অনেক বরফ পড়ে রয়েছে দেখলাম বাস রাস্তার দু’ধারে। পাইনের জঙ্গলে ঢাকা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথটা বেশ সুন্দর। তারমধ্যে আবার আকাশ মেঘলা, মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আছে চারপাশ। এই সব সময় পাহাড়ি পথে মেঘ-কুয়াশার লুকোচুরি খেলা চলে, পর্যটক হিসেবে দারুণ উপভোগ করতে পারাও একটা বড় আনন্দ ।
মাউন্ট ফুজির ভিউ পয়েন্টে যখন পৌঁছলাম আকাশ পুরো মেঘে ঢেকে গেল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। মাউন্ট ফুজি যেহেতু খুব পবিত্র জাপানিদের কাছে, তাই দেখলাম বহু মানুষ মেঘের আড়ালে কুয়াশায় মোড়া মাউন্ট ফুজিকে ভক্তিভরে প্রণাম করছেন। নিজের মনে প্রার্থনা করছেন। চারদিকে দেখলাম ইতস্তত বরফ পড়ে রয়েছে। উৎসাহিরা বরফ নিয়ে খেলছে, ছবি তুলছে।
এখানে এসেও ফুজি দর্শন হলো না। অনেকেরই মন খারাপ। আশাহত। তখনও জানতাম না, আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে- শহরের পথে রূপোর মুকুট পড়া ঝকঝকে মাউন্ট ফুজি!..
আমরা ফিরে চলেছি এবার জাপানের রাজধানী শহর টোকিওতে। স্বভাবতই একটা বাড়তি আনন্দ উত্তেজনা হচ্ছে মনের মধ্যে। একটা দেশের রাজধানী শহরে যাচ্ছি। আজ রাতে থাকব সেখানে। এই টোকিও যাওয়ার পথে শহরের রাস্তায় বহুদূরের মাউন্ট ফুজি
হঠাৎ যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে রূপোর মুকুটটি পড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল! উফ সে যে কী অপরূপা, কী অসাধারণ লাগছিল ঝকঝকে বরফ-সাদা মাউন্ট ফুজিকে। কত ছবি যে তোলা হলো চলন্ত বাসের জানলা থেকে। লম্বা লম্বা ভিডিও করল আমাদের মধ্যে অনেকেই। দীর্ঘক্ষণ ধরে মাউন্ট ফুজিকে দেখেছিলাম। দুচোখ ভরে দেখেছি- তোমায় হৃদকমলে রাখব, ভুলে যাব না!.. সেদিনের এ-দেখার আনন্দ কোনওদিন কেউ আমরা ভুলব না।
আজ রাতে টোকিও শহরের ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ডিনার। খুব ছোট্ট রেস্টুরেন্টটা ছিল। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর নিয়েই রোজ ডিনার করে ফিরতে হয় হোটেলে। এটা খুব ভালো লাগত না। কিন্তু উপায় তো নেই। ট্যুর অপারেটর এভাবেই সাজিয়েছেন ট্যুরগুলোকে।
ডিনারে নিজের পছন্দ মত খাবার খেয়ে নিয়ে ছোট্ট রেস্টুরেন্টটা থেকে বেরিয়ে এলাম পথে। রাত তখন সবে গভীর হচ্ছে। এই রেস্টুরেন্টের পাড়াটা ঝলমলে হয়ে উঠছে। অনেক বিয়ার পাব চোখে পড়ল। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম দেখতে। গিয়ে দেখি প্রত্যেক পাবের গেটে এক বা একাধিক জাপানী সুন্দরীরা দাঁড়িয়ে আছেন আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। খুব আদুরী আপ্যায়ন! বাইরে থেকে শুনতে পেলাম ভেতরে নাচ গান হচ্ছে। রীতিমত নাইট লাইফ।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের বইতে পড়েছি জাপানী ‘গেইশা’দের কথা। এই রাতের সুন্দরীরা প্রকৃতই ‘গেইশা’কিনা জানি না। বুঝতেও পারলাম না। সব কিছু দেখে বুঝে ওঠার আগেই ডাক শুনলাম, “চলে আসুন, চলে আসুন, তাড়াতাড়ি। গাড়ি ছাড়বে!..”
গাড়ি এগিয়ে চলল হোটেলের দিকে। রাতের টোকিও শহরটাকে দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম হোটেলের কাছে। আজ আমাদের বেশ বড় হোটেল। এবং হোটেলের পাশেই আছে একটা সুন্দর নদী ও এয়ারপোর্ট। মনে মনে বললাম, আজ তো অষ্টমীর ভ্রমণ শেষ হলো!.. আগামীকাল টোকিও শহর ভ্রমণ শেষ হবে নবমীতে। পরশু ফিরে যাব নিজ দেশে, নিজ নিকেতনের পথে!..
“Japan, Love in Tokyo…মহম্মদ রফির উদাত্ত কন্ঠে গাওয়া সেই গানটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। গুন গুন করে গাইতে গাইতে ঘরের চাবি নিয়ে লিফ্টে গিয়ে উঠলাম- “লে গায়ি দিল গুড়িয়া জাপান কি, পাগল মুছে কর দিয়া…Japan, Love in Tokyo.. “
সেই টোকিও শহরে আমি চলে এসেছি!…
ক্রমশ…