ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে সমীরণ সরকার (পর্ব – ৫৮)

সুমনা ও জাদু পালক

বেগুনি রংয়ের পরীর পালক এসে সুমনাকে জিজ্ঞাসা করল, আমাকে স্মরণ করেছ রাজকুমারী রত্নমালা?
——- হ্যাঁ ,আমরা এক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি।
——–কী হয়েছে ?
—– ওই যে সামনে দেখছো বেগুনি রংয়ের পাহাড়, ওটাই আমাদের সমস্যা।
—– ঠিক বুঝলাম না।
রাজকুমারী চন্দ্রকান্ত বললো, “আমি বুঝিয়ে বলছি। সামনের ওই বেগুনি রংয়ের পাহাড়টা এক অদ্ভুত পাহাড় । এমন পাহাড়ের কথা আমি কস্মিনকালে শুনিনি। দুধরাজ আকাশপথে যখনই ওই পাহাড় ডিঙোতে যাচ্ছে, তখনই ওই পাহাড়ের চূড়াটা আরো উঁচু হয়ে যাচ্ছে। এরকম কোন পাহাড় আমি কখনো দেখিনি।”
—— ও ,এই কথা! ওই বেগুনি রঙের পাহাড় তো এরকম আচরণ করবেই।
সুমনা বলল, “তুমি ওই পাহাড়ের বিষয়ে জানো বুঝি?”
—– হ্যাঁ, ওটাতো পাহাড় ই নয়।ওটা জাদুকর হূডুর তৈরি ‘মায়া পাহাড়’।
—— তাহলে আমরা ওটা ডিঙিয়ে যাব কি ভাবে?
—— আমি সে ব্যবস্থা করছি রাজকুমারী রত্নমালা। তোমরা আরেকবার দুধরাজের পিঠে চেপে ওই পাহাড় ডিঙোবার চেষ্টা করে দেখই না কি হয়।
বেগুনি পরীর পালকের কথা শুনে দুধরাজ একবার তার ডানা দুটো‌ নাড়িয়ে দিল জোরে।
তারপর সুমনা ও চন্দ্রকান্তা কে নিয়ে উড়তে শুরু করলো। যেইমাত্র দুধরাজ বেগুনি পাহাড়ের কাছাকাছি হল, অমনি পাহাড়ের চূড়াটা উপর দিকে উঠতে শুরু করল দুধরাজকে আটকাবার জন্য। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা মজার ব্যাপার ঘটল। বেগুনি রঙের পরীর পালক থেকে জন্ম নিল অজস্র বেগুনি রঙের পালক। আর সেই পালকগুলো পুরো পাহাড়ের উপরে চেপে বসলো। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়টা নিচু হতে শুরু করল। দেখে মনে হল যেন কোন ভারী বস্তুর চাপে পাহাড় টা বুঝি বা ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। পাহাড়টা যখন বেশ নিচু হয়ে গেল, দুধরাজ অনায়াসে ডিঙিয়ে গেল পাহাড়।
দুধরাজ পাহাড়টা ডিঙোতেই একটা মজার ব্যাপার ঘটল। হঠাৎ যেন মন্ত্র বলে পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল পাহাড়টা। যেন কখনো কোন কিছু ছিলই না এখানে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ‘মায়া পাহাড়ের’ উপর চেপে বসে থাকা বেগুনি রঙের পালকগুলো আবার আগের মতো জুড়ে একটা হয়ে গেল।
সুমনা আনন্দে হাততালি দিয়ে বলে উঠলো, আরে, সত্যি তো ওটা তো মায়া পাহাড় ছিল। ওগো বেগুনি পরীর পালক , তুমি না বললে আমরা তো বুঝতেই পারতাম না। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
—– আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কোন দরকার নেই। এই পৃথিবীর সবচেয়ে দুষ্টু এবং যাদুবিদ্যায় শক্তিশালী জাদুকর হূডুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাচ্ছ তোমরা। যেখানে তাকে সাহায্য করছে ভয়ংকর দানবী স্থেনা।
—— এই স্থেনার ব্যাপারটা কি আমায় বলতে পারো?
—– সেটা বলতে একটু সময় লাগবে। দুধরাজকে তাহলে নেমে আসতে হবে নিচে, মাটিতে।
দুধরাজ বলল, সে আর এমন কি ব্যাপার। গল্প শুনতে আমিও তো খুব ভালোবাসি।
দুধরাজ নেমে এলো মাটিতে। তার পিঠ থেকে চন্দ্রকান্তা এবং সুমনা দুজনেই নিচে নেমে এলো।
বেগুনি রঙের পরীর পালক শুরু করলো গল্প বলতে, ” এই স্থেনা বা স্থেনো,ইউরিয়ালে এবং মেডুসা হল তিন বোন। এরা তিনজনই দানবী। এদের একত্রে গর্গন বলা হয়। গর্গন মানে ভয়ংকর নারী। এদের তিনজনের মধ্যে স্থেনা হচ্ছে বড় আর মেডুসা সবার ছোট।
বিশাল দানব টাইফরিয়াস এবং অর্ধেক মানব এবং অর্ধেক সাপ এচিনার সন্তান এরা।
কথিত আছে মেডুসা আগে স্বর্ণকেশী অপূর্ব সুন্দরী মানবী ছিলেন। খুব সুন্দর দুটো চোখ ছিল তাঁর। দেবী এথেনার মন্দিরের প্রধান পূজারিণী ছিলেন তিনি।পরে কোন একটা কারণে গ্রীক দেবী এথেনা তার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে অভিশাপ দিয়ে দানবী করে দেন। তার মাথার সোনালি চুলগুলো বিষাক্ত সাপে পরিবর্তিত হয় ।তাঁর দুধ আলতা রঙের গায়ের চামড়া খসখসে এবং সবুজ হয়ে যায়। তাঁর সুন্দর চোখ অভিশপ্ত হয়ে যায়। দেবী এথেনার অভিশাপে মেডুসার চোখের দিকে কেউ তাকালেই সে পাথর হয়ে যেত। মেডুসার অস্ত্র ছিল একটা বড় ধনুক। অভিশপ্ত হওয়ার পর মেডুসা নিজের কুৎসিত অবস্থা দেখে বাড়ি ছেড়ে দূরে চলে যায় এবং তার ক্ষোভ পরিণত হয় হিংস্রতাতে।সে শান্তির খোঁজে আফ্রিকাতে যায়। কথিত আছে সেখানে থাকার সময় অনেক বিষাক্ত সাপ তাঁর মাথা থেকে খসে পড়ে।আর এর ফলেই নাকি আফ্রিকা বিষাক্ত সাপেদের বাসভূমি হয়ে যায়।
গর্গনদের তিন বোনের মধ্যে একমাত্র মেডুসা ছিল মরণশীল বাকি দুই বোন ছিল অমর। এই মেডুসার মৃত্যু হয় দেবরাজ জিউসের পুত্র গ্রিক বীর ডেমিগড ( অর্ধেক মানব আর অর্ধেক দেবতা)পার্সিয়ুসের হাতে। পার্সিয়ুস মেডুসার মাথা কেটে একটা থলিতে ভরে আনার সময় এক ফোঁটা রক্ত পড়ে সমুদ্রে। আর সেই রক্ত ফোঁটা থেকে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত ঘোড়া পেগাসাস। যেটা পক্ষীরাজ ঘোড়ার মত ই এক অদ্ভুত ঘোড়া।
হূডু একসময় ব্ল্যাক ম্যাজিক শিখতে আফ্রিকায় গেছিল। সেই সময় তার পরিচয় হয়েছিল মেডুসার সঙ্গে। মেডুসাকে সে কথা দিয়েছিল যে, মন্ত্র বলে অভিশাপ মুক্ত করে তাঁকে পূর্বের অবস্থায় না হোক মেডুসার মাথার বিষাক্ত সাপগুলোকে দূর করে সোনালী চুল ফিরিয়ে দেবে সে।মেডুসাও হূডু কে কথা দিয়েছিল যে,
হূডু এটা করতে পারলে মেডুসা তাঁকে বিয়ে করবে।
হূডু তখন তন্ত্র সাধনা করার জন্য প্রথমে চীন দেশে এবং পরে তিব্বতে যায়। আর সেই সময় পার্সিয়ুস হত্যা করে মেডুসাকে। হূডু তিব্বত থেকে ফিরে এই ঘটনা জেনে খুব দুঃখিত হয় এবং শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই সময় হূডুকে সান্ত্বনা দিতে মেডুসার বড়দিদি স্থেনা তার পাশে দাঁড়ায়। আর এরপরই হূডু ও স্থেনার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই স্থেনা শুধু খুব ভয়ঙ্কর নয়, খুব বুদ্ধিমান ও।”
কথা শেষ করে বেগুনি পরীর পালক বললো, রাজকুমারী রত্নমালা, এবার বিদায় নেব আমি।
চলে যাওয়ার আগে শুধু একটা কথা বলতে চাই তোমাকে।
—- হ্যাঁ বল।
—- সমগ্র পরী রাজ্য তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তুমি ছাড়া আর কেউ উদ্ধার করতে পারবে না পরি রানী কে। আমাদের পক্ষেই যতটুকু সম্ভব, সাহায্য করেছি তোমাকে। এবারে বাকিটুকু করতে হবে তোমাকে সাহস আর বুদ্ধি দিয়ে। বিদায়।
মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল বেগুনি রংয়ের পরীর পালক।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।