সাপ্তাহিক অণু উপন্যাসে সুব্রত সরকার (পর্ব – ৬)

বনবাসের বর্ণমালা

ছয়

পাহাড়-জঙ্গলের আড়ালে এমন সুন্দর একটা ঝোরা লুকিয়ে আছে ভাবা যায় না। বেশ গা ছমছম, দুর্গম, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে হরিশংকরের পিছু পিছু হেঁটে এই পাহাড়ি ঝোরার কাছে এসে শুভ্র মুগ্ধ হয়ে গেছে। পাহাড়ের অনেকটা উঁচু থেকে এক প্রবল জলস্রোত ঝরে পড়ছে। সেই জলের উচ্ছল ফোয়ারা থেকে চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা। শীতল ঠাণ্ডা সেই জলকণার স্পর্শে শুভ্রর পথশ্রমের সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে গেল। শুভ্র খুব খুশি হয়ে বলল, “হরিদা, এই ঝোরাটার কি নাম যেন বললে?”
“মুন্নি ঝোরা। সাল ভর জল থাকে। এ ঝোরার জল শুকায় না। ইয়ে পানি বহুত মিঠা আছে।” হরিশংকর এক কোষ জল হাতে তুলে চুমুক দিয়ে খেয়ে নিল।
মুন্নি ঝোরার সৌন্দর্যে শুভ্র বিহ্বল হয়ে গেছে। বেশ শান্ত, নির্জন জায়গাটা। শুভ্র ঝোরাটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ভীষণ ভালো লাগছে। এসময় জঙ্গলের কোনো এক আড়াল থেকে অদেখা এক পাখি কি মিষ্টি সুরে শিস দিয়ে উঠল। অরণ্যের এই আবহে পাখির শিসটা যেন এক দৈব উপহার!
বড় একটা পাথড়ের উপর শুভ্র চুপ করে বসল। একদিকে এই জঙ্গলের নির্জন নিঝুমতা, অন্যদিকে মুন্নি ঝোরার ঝর ঝর শব্দ-দুইয়ে মিলে পরিবেশটা অদ্ভুত রূপময় হয়ে রয়েছে।
হরিশংকর শুভ্রকে এখানেই বসে থাকতে বলে জঙ্গলের সবুজে নিমেষে হারিয়ে গেল। একটু পরই ফিরে আসব বলে গেল, কিন্তু এমন হঠাৎ উধাও হওয়ার কোন মানে হয়!
নির্জন, নিঝুম জঙ্গলে শুভ্র একা একা বসে আছে। চোখের সামনে মুন্নি ঝোরা ও তার জলধ্বনি। এখানে বিষাক্ত সাপ, কত ধরণের পোকামাকড়, জোঁক সবই আছে। তাই এমন একা একা কিছুক্ষণ বসে থাকার পর শুভ্রর এবার একটু ভয় করছে। মনের ভেতরে একটা চাপা উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছে। এখন একা একা ফিরে যেতেও পারবে না। পাহাড়-জঙ্গলের কত ঝোপ-ঝাড়, আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে হরি ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। সে সব পথ এখন আর ওর মনে নেই।
হরি চলে যাওয়ার সময় ওর পিঠের ডোকোটা নামিয়ে রেখে গেছে। ডোকো হল বাঁশের ঝুড়ি। লম্বা গড়ন। পিঠে ঝুলিয়ে ওরা হাট-বাজার-জঙ্গলে যায়। এই ঝুড়িকে নেপালিরা বলে ডোকো। ডুকপারা বলে, চিউ। এই নামদুটো শুভ্র আরাধনার কাছে শিখেছে। আরাধনাদের বাড়ির উঠোনেই প্রথম দেখেছিল এমন দু’তিনটে ডোকো। হাতে নিয়ে পরখ করে বারবার দেখছিল দেখে, আরাধনা হাসতে হাসতে বলেছিল, “আরে বাবা একবার পিঠে নিয়ে দেখুন না। জাস্ট লাইক ইয়োর রাকস্যাক।”
শুভ্র বেশ খুশি হয়ে ডোকোটা পিঠে নিয়ে দাঁড়াতেই আরাধনা উচ্ছল হাসিতে হো হো করে হেসে উঠে বলেছিল, “আই ওয়ান্ট টু টেক অ্যা স্ন্যাপ। মে আই?”
শুভ্রর হাসির মধ্যেই যেন সম্মতি ছিল। আরাধনা ওর মোবাইল ক্যামেরায় পর পর দুটো ছবি তুলে নিল। ডোকো কাঁধে ছবি দুটো দেখে শুভ্ররও বেশ মজা লেগেছিল। আরাধনা নিজের থেকেই তখন বলেছিল, “আপনার হোয়াটসঅ্যাপে আমি ছবি দুটো পাঠিয়ে দেব।”
হরির ডোকোর মধ্যে এক গোছা শক্ত দড়ি ও ধারালো একটা দাঁ রয়েছে। চকচকে দাঁ টা বেশ ভারী ও বড়। হরির কোমড়ে গোঁজা ছিল ‘ছুপ্পি’, এক ছোট্ট ছুরি। ওরা জঙ্গলে গেলে ছুপ্পি কোমড়ে ঝুলিয়ে নেবেই।
ডোকোর মধ্যে যে এমন ধারালো দাঁ থাকতে পারে শুভ্র ভাবে নি। হরি আসার সময় বলছিল, জঙ্গল থেকে কিছু লকড়ি নিয়ে আসব। ভালো কচু আছে জঙ্গলে, মাটি খুঁড়ে নিয়ে আসব। আর এই জঙ্গলে আছে অনেক ধরণের ঔষধি গাছ। খুঁজে খুঁজে সে সব গাছ, লতা-পাতা, শিকড়-বাঁকর নিয়ে ফিরবে। এই সব বনৌষধি ওদের রক্ষাকবচের কাজ করে। গায়ে ব্যাথা, সর্দি-কাশি, জ্বর-বিমারি হলে ঘরে বানানো এই সব ভেষজ ঔষধ দিয়েই রোগ সারায়।
ডোকোর থেকে ধারালো দাঁ টা বের করে হাতের কাছে নিয়ে বসল শুভ্র। হরি এখনো ফিরে এলো না। কোথায় গেছে তাও তো বলে যায় নি! শুভ্র মনে মনে খুব বিরক্ত হচ্ছে হরির ওপর।
মুন্নি ঝোরার জল অবিশ্রান্ত ভাবে পাহাড়ের ওপর থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে। আজ দিনটা একটু মেঘলা। রোদ খুব দুর্বল। গভীর এই জঙ্গলে এমন একা একা চুপ করে বসে থাকতে আর যেন ভালো লাগছে না শুভ্রর। এতক্ষণ বসে ছিল যে পাথরটার ওপর, এবার উঠে দাঁড়িয়ে শুভ্র গলা ছেড়ে হাঁক দিল, “হরিশংকরদা দা দা দা…”
ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হতে হতে ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ে-জঙ্গলে। শুভ্র এবার দু’হাত দিয়ে মুখগহ্বর ঢেকে আরও একবার হাঁক দিল, “হরিশংকরদা তুম কাঁহা হো হো হো হো…”
কোনও উত্তর ফিরে এলো না। হরিশংকর কতদূর চলে গেছে কে জানে? কোথায় গেছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। শুভ্র আর বসে অপেক্ষা করতে চাইল না। এবার একটু কাছাকাছির জঙ্গলটা দেখে নিতে চায় শুভ্র। হাতে ধারালো দাঁ টা নিয়ে খুব সতর্ক, সাবধানী হয়ে মুন্নি ঝোরার পিছনের জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল। হরিকে এ পথ দিয়েই ও চলে যেতে দেখেছিল।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।