সাপ্তাহিক গল্প নেই-তে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – ৩৬


গল্প নেই – ৩৬

তখন শিয়ালদা থেকে অফিসপাড়ায় ট্রাম যেত।আমরা উঠতাম না।ট্রেন থেকে নেমে কয়েকজন বন্ধু মিলে হেঁটে গল্প করতে করতে অফিসে যেতাম।একদিন আমি সময়ে ট্রেনে উঠতে পারিনি ফলে যাদের সঙ্গে অফিসের দিকে যাই তারা কেউ না থাকায় একা হাঁটতে ভালো লাগছিল না। তাছাড়া হাঁটলে দেরি হবে ভেবে ট্রামে উঠলাম।
ট্রাম কোলে মার্কেট ছাড়িয়ে একটা ব্যাংকের স্টপেজে আসার আগেই কন্ডাক্টার এসে টিকিটের পয়সা নিল।
একটু বাদে শুনলাম সেই কন্ডাক্টার খুব হম্বিতম্বি করছে।বাসে যাঁরা টিকিট কাটেন তাঁদের তুলনায় ট্রামের কন্ডাক্টারকে দেখেছি অনেকটা নরম স্বভাবের। ওনাকে সেরকম মনে হল না।
চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি একজন সুন্দর পোশাক পরা সুদর্শন ভদ্রলোকের দিকে হাত নাড়িয়ে কন্ডাক্টার ধমকাচ্ছেন আর বলছেন,‘ভালো জামা কাপড় পরলেই ভদ্রলোক হয় না। আগে টিকিট কাটুন।’   
ভদ্রলোক কেমন অপ্রস্তুত।বললেন,‘আমার কাছে এটা ছাড়া আর কোন টাকা পয়সা নেই।’ এই বলে তিনি একটি ৫০ টাকার নোট দেখালেন।অমনি চারিদিক থেকে বেশকিছু কটূক্তির বৃষ্টি শুরু হল।    
ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে সবাই বলতে চাইল ওই ৫০ টাকার নোট দেখিয়ে ফুটুনি না করে টিকিটটা কাটুন।
একজন কন্ডাক্টারকে বলল, ‘এই ফালতু লোকটাকে নামিয়ে দাও।’
কন্ডাক্টার বললেন,‘না নামতে দেব না।আগে টিকিটের পয়সা দেবেন তবে ছাড়ব।’
সমস্যা জটিল হচ্ছে দেখে আমি এগিয়ে গেলাম।তখন ট্রামের সামান্য ভাড়া।ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম উনি লালবাজার স্টপেজে নামবেন।বললাম,‘আমি আপনার ভাড়া দিচ্ছি। আপত্তি নেই তো?’
ভদ্রলোক বাধা দিতেই আমি বললাম,‘এমনি দিচ্ছি না। পরে না হয় আপনি শোধ দিয়ে দেবেন।’    
টিকিট কাটার পর কন্ডাক্টার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।বললাম,‘চুপ।একটা কথাও যেন না শুনি।’  
ভদ্রলোক আমার দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।বললেন,‘আপনি কোথায় নামবেন?   
লালবাজারের আগেই আমি নামব শুনে বললেন,‘আপনার অফিস কোথায় বলুন। আমি বিকেলে দেখা করব। তখন আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে।’
বিকেলে আমার অফিসের সামনে এলেন।বললেন,‘কোথায় যাবেন।বাড়ি?’
বললাম,‘বাড়ি যাবার আগে কলেজস্ট্রিট যাব।’
ভদ্রলোক বললেন,‘হাঁটতে অসুবিধা নেই তো?’
বললাম,‘আমি বেশিরভাগ সময়ই হেঁটে যাতায়াত করি।’
শুনে খুব খুশি হলেন তিনি।বললেন,‘আমারও হাঁটতে অসুবিধা নেই।পথে বউবাজারের কাছে একটি মিষ্টির দোকানে আমাকে নিয়ে গেলেন। ওই সময়টা ওখানে গরম কচুরি ভাজা হয়।আমিও মাঝেমধ্যে যাই ওখানে। 
ভদ্রলোক দোকানে ঢোকার আগে বললেন,‘আমি আজ আপনাকে খাওয়াব।পয়সা দেওয়া নিয়ে কিন্তু কোনো গোলমাল করবেন না।’
হেসে বললাম, ‘বেশ তাই হবে।’
কচুরির সঙ্গে কয়েকটা মিষ্টিও খাওয়া হল।দাম মিটিয়ে দেওয়ার সময় ভদ্রলোক পকেট থেকে সকালের সেই ৫০ টাকার নোট দেখালেন। বললেন,‘এখনও এটার কোনো হিল্লে করতে পারিনি।’    
দোকানদারকে টাকাটা দিয়ে বাকি টাকা ফেরত নিয়ে আমাকে বললেন,‘এবার আমাকে ঋণমুক্ত করুন।’
‘মানে? কি যে বলেন।’বললাম,‘ও পয়সা আপনাকে দিতে হবে না।’
‘বললে তো হবে না।তখন আপনি আমার পরিচিত ছিলেন না।তবু যে উপকার করে আজ আপনি আমার ইজ্জত বাঁচিয়েছেন আমি তা কোনদিন ভুলব না। ট্রামের ভিতরে আমার নিজেকে তখন খুব অসহায় লাগছিল। তাড়াহুড়োয় সব খুচরো টাকা পয়সা বাড়িতে টেবিলের উপর থেকে নিতে মনে নেই।’
বললাম,‘এমন তো হতেই পারে।সকালে এমন অবস্থা থাকে তাতে মনে করে নিজেকে নিয়ে যদি ঠিকঠাক অফিসে পৌঁছতে পারি তো সেটাই অনেক।’
ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘চলুন।আপনার কি কাজ আছে সেটা হয়ে গেলে কফিহাউসে গিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।’ 
আমি কোনো কথা বলার আগেই বললেন,‘আজ সব খরচ কিন্তু আমার।আপনার কথা শুনব না।ট্রামে আজ  আপনি যেভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন কোনো মূল্যে তা শোধ করা যাবে না।’
তারপর তিন বছর আমার ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।দেখা হত। আমাদের আড্ডা হত। উনি যে চাকরি করতেন সেটা বদলির। বহুদিন দেখা না হওয়ায় বুঝেছিলাম হয়তো উনি অন্যত্র চলে গেছেন।বছরের পর বছর কেটে গেল।আমার অফিস গণেশ এভিনিউ থেকে সল্টলেকে স্থানান্তরিত হল।আর  কোনোদিন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়নি।মনে হয় আর হয়ত ওই ভদ্রলোককে দেখতে পাব না। আমার ঠিকানা উনি লিখে নিয়েছিলেন একটা টুকরো কাগজে। তাতে উনি আমাকে খুঁজে পাবেন না। কতবার যে ঠিকানা বদল করতে হয়েছে আমাকে! আমি তো নিজেই নিজেকে খুঁজে পাই না।
এখন যখন দেখি চারিদিকে সব ভুয়ো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে দিব্যি আছে,তখন ভদ্রলোকের কথা খুব মনে হয়।এখন কত কেলেঙ্কারির নায়করা বুক ফুলিয়ে চলছে।গলাবাজি করছে।এদের কথা শুনলে নিজেদেরই কেমন লজ্জা করে।এ কেমন পৃথিবী তৈরি হল যেখানে চারিদিকে কেবল বেলাজ মুখের মেলা। কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কি অদ্ভুত ভাবে বেঁচে আছে।যখন এরা কথা বলে মনে হয় যেন একেকটি মহাপুরুষ।
আমি অসহায় হয়ে একটা সুন্দর আশ্রয় খুঁজি। চকিতে মনে পড়ে যায় ওই ভদ্রলোকের কথা। ৫০ টাকার নোটে ট্রামের ভাড়া দেওয়া যাচ্ছে না বলে কতটা সঙ্কুচিত।তখন আমার ভাড়া দেওয়াটা আমার কাছে খুব সামান্য ঘটনা হলেও উনি সেটাকে কত সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন এক বন্ধুত্বের প্রসাধনে।
এমন মানুষ কোথায়? এখনও আকুল হয়ে খুঁজে বেড়াই।মেলে না।কিছুতেই মেলে না। 
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।