ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে সমীরণ সরকার (অন্তিম পর্ব)

সুমনা ও জাদু পালক

সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঘরের পরে ঘর পার হয়ে বড় ঘরে উপস্থিত হয়েছিল ওরা। সুমনা দেখল, সেখানে সবাই নানারকম কাজে ব্যস্ত। সুমনাকে দেখেই তারা কেমন যেন অবাক হয়ে ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করতে শুরু করলো। তারা হীরক কুমার কে দেখে সমস্বরে বলে উঠলো, প্রণাম হই রাজকুমার । হীরক কুমার কিছু না বলে মৃদু হেসে ডান হাত তুলে নাড়ালো।
সুমনার হাত ধরে হীরক এবার এসে উপস্থিত হলো সেই বড় ময়ূরের সামনে। গুনে গুনে দুবার হাততালি দিল হীরক কুমার। ময়ূরটা বাঁদিকে সরে গেল।
ওরা এসে উপস্থিত হলো রাজ দরবারে।
রাজ সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজা ও রানী। রাজ দরবারে সমস্ত আসনে যারা আগে বসেছিলেন পাথরের মত নিশ্চুপ, তাদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল ওদের, বিশেষত সুমনাকে।
রাজা মশাই ও রানীমা হঠাৎ যেন ওদের দেখতে পেয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। রাণীমা সিংহাসন থেকে নেমে প্রায় ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন সুমনাকে। রাজামশাই পিছু পিছু এসে বললেন, আমি জানতাম, তুই ফিরে আসবি মা। দুষ্টু জাদুকর কিছুতেই তোকে ধরে রাখতে পারবে না।
রানীমা বললেন, আর কোন ভয় নেই মা রত্নমালা, এবার আমরা সবাই মিলে মজা করে থাকবো এখানে।
সুমনা বলল, কোথায়?
—–কেন এখানে, আমাদের এই কনকনগর রাজ্যে।
—–কিন্তু আমাকে যে ফিরে যেতে হবে।
রাজামশাই যেন খুব আশ্চর্য হয়ে বললেন, কোথায় যাবে তুমি?

——-আমাদের গ্রামে, সিঁদুরটোপায়।
——সিঁদুরটোপা গ্রাম! সেটা আবার কোথায়?
——-ওই যেখানে সরকার বাবুদের বাড়িতে তিনশো বছরের পুরনো রাধামাধব মন্দির আছে, যে মন্দিরে বাদল ঠাকুর কে ভোগ রান্নার কাজে সাহায্য করে আমার মা, ওটাই তো সিঁদুরটোপা গ্রাম। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঝকঝকে আয়না নদী।আয়না নদীর পাড়ে মস্ত বড় এক বটগাছ আছে। ভোলা দাদু বলে, গাছটার বয়স নাকি তিন হাজার বছর। ওই বটগাছে সারাদিন খেলা করে হাজার হাজার রঙ বেরঙের পাখি, কাঠবিড়ালিগুলো সারাদিন ছোটাছুটি করে গাছের ডালে ডালে। ওই গাছের গোড়ায় ভাঙ্গা মন্দিরে শিব ঠাকুর আছেন।ওটাই তো আমাদের সিঁদুর টোপা গ্রাম।
রাজামশাই আর রাণীমা সুমনার কথা শুনে যেন হতবাক হয়ে গেছিলেন।
হীরক কুমার বলল, সে যাই হোক, আমি তোকে আর কোত্থাও চলে যেতে দেবো না দিদি ।আমি তো বলেছি যে, ওই হাতির মুখোশটা তোকে দিয়ে দেব। আর কোনদিন ঝগড়া করবো না তোর সঙ্গে।
রাজা মশাই বললেন, কিসের মুখোশ?
রানী বললেন, ওই যে সেই হাতির মুখোশটা, যেটা আপনি মাজুলি দ্বীপে শিকার করতে গিয়ে
এক আদিবাসীর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন,সেটা।
——হ্যাঁ ,মনে পড়েছে!
——ওই মুখোশটা নিয়েই তো দিন রাত ঝগড়া করতে ভাই বোনে!
রাজা মশাই হো হো করে হেসে উঠলেন।
হীরক কুমার বলল, আমি তোকে যেতে দেব না, দেব না, দেব না! এই বলে রাখলাম।
হঠাৎ কে যেন গম্ভীর গলায় বলে উঠলো, ওকে যে চলে যেতে হবেই হীরক কুমার।
কে, কে বলল এই কথা? সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে শুরু করল।
সুমনা দেখল,রাজ সিংহাসনের মাথায় বসে আছে সেই ছোট্ট নীলকন্ঠ পাখিটা।
রাজা নীলকন্ঠ পাখিটাকে দেখে বললেন, ও তুমি!
——হ্যাঁ মহারাজ, আমি। আমি রাজকুমারী রত্নমালাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি। রাজকুমারী রত্নমালা দুষ্টু জাদুকর হূডুর জাদুদন্ড ধ্বংস করে
দিয়েছে।
——সত্যি বলছ তুমি ? সত্যি ধ্বংস হয়েছে হূডুর জাদুদণ্ড?
——-হ্যাঁ মহারাজ ,সত্যি বলছি।
রানী মা বললেন, আর হূডু? সে যদি আবার ফিরে আসে!
—-সে সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে রানী মা। পরীরানী ওকে ব্যাঙ বানিয়ে বন্দী করেছে মন্ত্রপুতঃ ঘটে। আর সেই ঘট পুষ্পনগর রাজ্যের এক দুর্গম এলাকায় খরস্রোতা নদীর নিচে প্রোথিত আছে। পুষ্পনগর রাজ্যের হাজার হাজার বীর সৈনিক পাহারা দিচ্ছে ওই এলাকা।
রাজা বললেন, তোমার কথা শুনে নিশ্চিন্ত হলাম।
নীলকন্ঠ বলল, রাজা মশাই,আজ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই আমার সঙ্গে যাত্রা করতে হবে রাজকুমারী রত্নমালাকে। ওকে ফিরতেই হবে।
রাজা বললেন, আর কোনদিন কি দেখা হবে না আমাদের?
—–সে কথা কি বলা যায় রাজা মশাই? বাবা ভোলানাথ চাইলে আবার দেখা হতে পারে।
সারাটি দিন হীরক কুমারের হাত ধরে কনকনগর রাজ্য ঘুরে দেখল সুমনা। কত নাম না জানা গাছ আর তাদের সুমিষ্ট ফলের স্বাদ নিলো সুমনা। কত জানা-অজানা রংবেরঙের ফুল দেখল, কত রকমের পাখি দেখলো, পাখিদের মিষ্টি গান শুনলো, কত সুন্দর সুন্দর প্রজাপতি দেখলো, কত কাঠবিড়ালি দেখল, খরগোশ দেখল, ময়ূর দেখল।
সন্ধ্যার আগেই ওরা ফিরে এলো রাজপ্রাসাদে।
নীলকন্ঠপাখি ডাকলো দুধরাজকে। দুধরাজ আসতেই সুমনা চেপে বসলো তার পিঠে।
দুধরাজ সাদা ডানা বের করে উড়তে শুরু করল। নিচ থেকে হাত নাড়াচ্ছিলেন রাজা, রানী হীরক কুমার আর রাজসভার অনেকে।
হাসিখুশি দ্বীপের কনকনগর রাজ্য পার হতেই গতি বাড়িয়ে দিল দুধরাজ। সাঁই সাঁই করে বইছে বাতাস। দুধরাজ ঝড়ের গতিতে একের পর এক পেরিয়ে যাচ্ছে পাহাড় ,জঙ্গল ,নদী , সাগর, জনপদ।
ঠিক রাত্রি শেষে, পাখিদের ঘুম ভাঙার আগে, সূর্য ওঠার অনেকটা আগে ই দুধরাজ পৌঁছে গেল সুমনাদের বাড়ির সামনে সেই বকুল গাছের নিচে।
সুমনা দুধরাজের পিঠ থেকে নেমে নিচে দাঁড়াতেই নীলকন্ঠ পাখি বললো, এবার তো আমাদের চলে যেতে হবে সুমনা।
সুমনা চোখ ছল ছল করে জিজ্ঞাসা করলো, আর কি আমাদের কোনদিন দেখা হবে না নীলকন্ঠপাখি?
——কে বললে হবে না? যখন খুব দেখতে ইচ্ছে হবে আমাকে অথবা কোন সমস্যায় পড়বে, আয়না নদীর পাড়ে শিব ঠাকুরের কাছে গিয়ে মনে মনে আমার কথা ভাববে। দেখবে ঠিক চলে আসবো আমি।
—–এখন কোথায় যাবে তুমি?
——তোমার মত যে সব ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা গাছ ভালবাসে ,ফুল ভালোবাসে, পাখি ভালোবাসে ,মানুষকে ভালোবাসে—-আমি যাব তাদের কাছে। তারা অসুবিধায় পড়ে আমাকে ডাকলেই আমি তাদের কাছে যাই।
—–আমার মা ভালো হয়ে যাবে তো, পাখি?
——অবশ্যই ভালো হবে। এই নাও ,আমার একটা পালক দিচ্ছি তোমায়। এটা তোমার মায়ের মাথায় ছুঁয়ে দিলেই তোমার মা একদম ভালো হয়ে যাবে। নীলকন্ঠ পাখি ডানা ঝেড়ে একটা ছোট্ট পালক খুলে দিল। সুমনা সযত্নে কুড়িয়ে নিলো পালকটা।
ওরা চলে গেল। সুমনা ঘরে ঢুকে দেখে, মা তখনও শুয়ে। মায়ের মাথায় পালকটা ছুঁয়ে সুমনা চুপিচুপি শুয়ে পড়ে মায়ের পাশে।

হঠাৎ মায়ের ডাক কানে গিয়ে ঘুম ভাঙ্গে সুমনার। সুমনা চোখ মেলে। জানালা দিয়ে সকালের সূর্যের ঝকঝকে আলো ঢুকেছে ঘরে।
সুমনা শুনতে পায় ওর মা হাসতে হাসতে বলছে, তাড়াতাড়ি ওঠ সুমনা, দ্যাখ ,কে এসেছে আমাদের ঘরে!
সুমনা চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে বলে,
কে এসেছো গো মা?
—– আয়, আমার সঙ্গে বাইরে আয়, দেখতে পাবি কে এসেছে।
সুমনা তাড়াতাড়ি তক্তপোশ থেকে নেমে বাইরে বারান্দায় এসে দেখে, একটা মোড়াতে বসে আছে দামি পোশাক পরা একজন অচেনা ভদ্রলোক। সুপুরুষ যুবক।
একটু দূরেই আরেকটা মোড়ায় বসে আছেন সরকার বাড়ির বড় গিন্নিমা কমলা দেবী।
উনি হাসি হাসি মুখ করে সুমনার দিকে তাকিয়ে আছেন।
হঠাৎ সুমনার চোখ যায় বারান্দার এক কোণে জবুথুবু হয়ে বসে থাকা দাড়ি গোঁফ ওয়ালা একটা লোকের দিকে। লোকটা দু হাঁটুর ফাঁকে মাথায় গুঁজে বসে আছে।কে লোকটা? খুব চেনা চেনা লাগছে?
আরে লাল মুক্তো তো একেই দেখিয়েছিল। লোকটা হঠাৎ মুখ তুলে সুমনার দিকে তাকায়।
লোকটাকে ভালো করে লক্ষ্য করতে করতে সুমনা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো, বাবা!
কমলা দেবীও উল্লাসে প্রায় চিৎকার করে ওঠেন, দেখেছ পুতুল ,দেখেছো, মেয়ে ঠিক চিনে নিয়েছে বাবাকে।
সুমনা বলে, চিনবো না কেন, আমি তো দেখেছি বাবাকে।
সুপুরুষ ভদ্রলোকটি বললেন ,কোথায়?
——-চারিদিকে পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা এক ভাঙ্গা মন্দিরের মধ্যে।
ভদ্রলোক বললেন, আশ্চর্য!
সুমনা বলল, মন্দিরটা শিব ঠাকুরের। ধবধবে সাদা শিবলিঙ্গ আছেন মন্দিরের ভিতরে।
——একদম ঠিক বলেছো তুমি। ঠিক ওই অবস্থাতেই তো আমি জঙ্গলের ভিতর পেয়েছি ওকে। শাশুড়ি মা ওর ছবিটা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছিলেন আমাকে। তার সঙ্গে চেহারাটা মিলে গেল আর ওর ডান হাতে উল্কিতে লেখা ‘বাচ্চু’ নামটা দেখে আমার সন্দেহ হলো। স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিয়ে অনেক কষ্টে ওকে নিয়ে এসেছি এখানে। কিন্তু তুমি ওই জায়গাটা চিনলে কি করে?
——লাল মুক্তা দেখিয়েছে আমাকে।
ওদের কথার মাঝেই হঠাৎ একটা ছেলে প্রায় দৌড়ে এসে কমলাদেবীর কাছে এসে দাঁড়ালো। মুখ দেখা যাচ্ছে না। একটা হাতির মুখোশ লাগানো।
কমলা দেবী বললেন, তোমার বাগান দেখা হয়ে গেল বাবুসোনা?
——হ্যাঁ দিদুন।
ওর দিকে তাকাতেই আবার চমকে উঠলো সুমনা। একি! এই মুখোশটা ও পেল কোথায়?
এটাতো—–!
সুমনা প্রায় দৌড়ে এসে ছেলেটাকে বলল, আমাকে মুখোশটা একটু দাও তো। এটা আমার চেনা মুখোশ, একটু দেখব।
ভদ্রলোক বললেন, এটাতো আমি—–
—–মাজুলিতে পেয়েছেন।
বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠে ভদ্রলোক বললেন, ঠিক। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?
——-এক আদিবাসীর ঘরে পেয়েছেন, তাইতো?
——একদম ঠিক।
সুমনা আবার ছেলেটাকে বলল, একটু দাও না ভাই মুখোশটা আমাকে।
—না না, দেব না, এটা আমার মুখোশ।
এই কথা বলে ছেলেটা দৌড়ে পালাতে গেল। কিন্তু পারল না। সুমনা ওকে ধরে ফেলল। এক টানে ওর মুখ থেকে মুখোশটা খুলে নিলো। এবার আবার অবাক হওয়ার পালা সুমনার।
এ কাকে দেখছে সে।
বিস্মিত সুমনা চিৎকার করে উঠলো, একি ভাই, তুই এখানে?
কমলা দেবী বললেন, কাকে কি বলছিস তুই সুমনা? ও তো আমার নাতি, আমার মেজ মেয়ের ছেলে। আমার জামাই বিদেশে চাকরি করত। ওখানেই তো জন্ম হয়েছে আমার নাতির। সেখান থেকে আসাম সরকারের চাকরি নিয়ে আমার মেজ জামাই মাজুলি দ্বীপে গেছিল।
মোড়ায় বসা সুপুরুষ ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ, একটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ চলছে ওই দ্বীপে। আর সেই কাজে একটা টিমকে সাহায্য করার জন্যই আমার বিদেশ থেকে আসা। আসাম সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তি হওয়ায় আমি মাজুলি দ্বীপে গেছিলাম।
সুমনা দূরে কিছু যেন দেখছে এমন উদাস দৃষ্টিতে বকুল গাছের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে বলল, হতেই পারে, তবুও ও আমার ভাই। ওর নাম হীরক, হীরক কুমার।

সবিস্ময়ে ভদ্রলোক মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক ঠিক ঠিক, একদম ঠিক! কিন্তু……….???

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।