সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ১২)

দেবমাল্য

মোটামুটি সব খোঁজখবর নেওয়া হয়ে গেছে দেবমাল্যর। ঠিক করেছে, পৌঁছনোর পরের দিন, না। একদম গাড়ি ভাড়া করে নয়। গাড়ি হুস করে চলে যায়। দু’চোখ ভরে কিছুই দেখা যায় না। সামশের খবর নিয়ে জেনেছে, ওখানে নাকি রাস্তার মোড়ে মোড়ে, হোটেলের সামনে সার সার মোটর-লাগানো ভ্যানরিকশা দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের বললেই, তারা নাকি গোটা অঞ্চলটাই ঘুরিয়ে দেয়। দেখিয়ে দেয় জম্বুদ্বীপ। ফেজারগঞ্জের মৎস্য প্রকল্প। হেনরি আইল্যান্ডও।
খুব সকালে বেরোতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল সে। সকালে বেরোতে গিয়ে ওর চক্ষু চড়কগাছ। যাচ্ছে তিন দিনের জন্য। কিন্তু তানিয়া এতগুলো লাগেজ নিয়েছে, মনে হচ্ছে তিন মাসের জন্য এমন জায়গায় যাচ্ছে, যেখানে কোনও লোকজন থাকে না। দোকান-পসারও নেই। ও বলেছিল, এত কী নিয়েছ?
তানিয়া বলেছিল, তুমি তো একটা সেট পড়েই যাচ্ছ। এ ছাড়া তোমার চারটে জামা, চারটে প্যান্ট, দুটো স্যুট, তিন রাতের জন্য তিন সেট চোস্তা-পাঞ্জাবি। সমুদ্রে স্নানের জন্য তিনটে শার্ট-প্যান্ট। একটা ঘরে পরার সব সময়ের স্যান্ডেল আর সমুদ্রে যাওয়ার জন্য স্যান্ডাকের একটা চটি। আর আমার খানকতক শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ। তিনটে সালোয়ার-কামিজও নিয়েছি। ওখানে ধোয়াটোয়া যাবে কি না জানি না, তাই দুটো নাইটিও নিয়ে নিয়েছি। একটা কম নিলাম। অসুবিধা হবে না… কী বলো? এ ছাড়া তেল, সাবান, শ্যাম্পু, গামছা, চিরুনি, দাঁত মাজার ব্রাশ, পেস্ট, সেন্ট আর ওখানে গিয়ে হঠাৎ জ্বরজারি, মাথাব্যথা বা গা গুলোলে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, সেজন্য ওষুধও নিয়ে নিয়েছি বেশ কিছু— কী কী নিয়েছি, একটা কাগজে লিখে রেখেছি।
— কেন? অবাক হয়েছিল ও।
তানিয়া বলেছিল, ফেরার সময় মিলিয়ে দেখতে হবে না? যা যা নিয়ে যাচ্ছি, সব ঠিকঠাক ব্যাগে ভরছি কি না…
— সে ঠিক আছে, কিন্তু তা বলে স্যুট নেবে?
— কেন? আমরা যদি বিকেলের দিকে কোথাও বেড়াতে যাই?
— বেড়াতে গেলে আর কোথায় যাব? আমরা কি কোনও পার্টিতে যাব? গেলে তো ওই সমুদ্রের পারেই যাব, না কি? সেখানে কেউ স্যুট পরে যায়?
— না, ভাবলাম…
— আর এত জামাকাপড় কেউ নেয়? যাচ্ছি তো তিন দিনের জন্য। খোলো খোলো খোলো…
এমন তাড়া লাগল দেবমাল্য যে, মুখের ওপরে কোনও কথা বলতে পারেনি তানিয়া, কেবল ফ্যালফ্যাল করে দেখছিল, প্রত্যেকটা লাগেজ খুলে তার স্বামী কীভাবে টেনে টেনে জামাকাপড় বের করছিল। একটা ছোট হালকা সুটকেস আর কাঁধের একটা ব্যাগের মধ্যেই কেমন কায়দা করে ভরে নিয়েছিল সব। তার পরেও যেগুলো পড়ে ছিল, সেগুলো আর তোলার সময় পায়নি। ঘড়ির কাঁটা তখন ঘোড়ার বেগে ছুটছে। তাই ওগুলো বিছানার ওপর টাল দিয়ে রেখে তার ওপরে একটা বড় বেড কভার দিয়ে ঢেকে ওরা বেরিয়ে পড়েছিল।
তিন দিন ভীষণ আনন্দ করেছিল ওরা। সকাল থেকে বেলা পর্যন্ত সমুদ্র দাপিয়ে বেরিয়েছিল। ছোট-বড় ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করেছিল। দুপুরে হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়েই সন্ধে নামতে না নামতেই ফের সমুদ্রে। দারুণ লাগছিল ওদের। কিছুতেই ফিরতে ইচ্ছে করছিল না।
বাড়ি ফিরে তানিয়া দেখেছিল, লাগেজে তখনও ভাঁজ ভাঙা হয়নি একটা প্যান্ট, দুটো জামা, দুটো শাড়ি আর একটা সালোয়ার-কামিজের। দেবমাল্য বলেছিল, দেখলে তো, বেড়াতে গেলে অত কিছু লাগে না। বেড়াতে বেরোলে সবসময় ফুরফুরে মন নিয়ে বেরোবে। লাগেজ বওয়ার কষ্টটা যেন বেড়ানোর আনন্দটাকে মাটি করে না দেয়, বুঝেছ?
ও যে বোঝেনি, দেবমাল্য সেটা টের পেয়েছিল তার ক’দিন পরেই। মুকুটমণিপুরে বেড়াতে যাওয়ার সময়। আগে থেকেই বারবার করে বলছিল দেখে তানিয়া বলেছিল, হ্যাঁ রে বাবা, তোমাকে অত বলতে হবে না। আমার ঠিক মনে আছে। যেটুকু না নিলে নয়, সেটুকুই নেব। রাতে ট্রেন তো, আমি আগে গুছিয়ে নিই। তার পর সন্ধের আগেই তোমাকে সুটকেস খুলে দেখিয়ে দেব কী কী নিয়েছি, ঠিক আছে?
কিন্তু তানিয়া যখন সুটকেস খুলল, মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল দেবমাল্য। তার পর থেকে কোথাও বেড়াতে গেলে, যা যা নেওয়ার মনে হত, তানিয়া বের করে রাখত। লাগেজে ভরত দেবমাল্য এবং প্রতিবারই দেখা যেত, তানিয়া যা বের করেছে, তার টেন পার্সেন্টও ব্যাগে ঢোকায়নি ও।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।