T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় সৌদামিনী শম্পা

গন্তব্য

-ও মাসী সরো তো!
যতই অফিস ফেরতা শিয়ালদহ স্টেশনের যাত্রীরা মহিলা কামরার প্রথম দিকের বগির শেষ দরজায় বসা প্রতিমাকে সরতে নড়তে বলে, সে ওসব কথায় কান দিতে নারাজ! গোঁজ হয়ে বসে থাকে পাঁচটা আটের ক্যানিং লোকালের দরজার বাঁদিক ঘেঁষে। শুধু ও বসলেও হয়। তার পাশে বিরাট এক ঝুড়ি! তাতে কি নেই? রাজ্যের ধনে পাতা, নটে শাক, সজনে শাক, মূলো, বরবটি, লঙ্কা নিয়ে চলেছে বিকেলের বালিগঞ্জ বাজারে।
এত লোকের ঠালাঠেলি, প্রতিমার যেন গ্রাহ্য নেই ! যেন বোধি প্রাপ্ত হয়েছে ও! চোখ আধবোজা করে, কোঁচড়ে রাখা ঝালমুড়ির ঠোঙা থেকে মুঠো মুঠো মুড়ি মুখে ফেলে, পরম আয়েশে চিবিয়ে যাচ্ছে! পিঠ ট্রেনের দেওয়ালে হেলানো।
-হুঃ! ট্রেন তো নয়, যেন বাড়ির বেড রুম পেয়েছে!
এক সুন্দরী পনিটেল করা, জিন্স পরিহিতা করপরেট হাউসের আধুনিকা নাক সিঁটকে মন্তব্য করে। সঙ্গে সঙ্গে দলে ভারী করে হিজাব আর বোরখা ঢাকা এক পর্দাশীলা।
প্রতিমা ও সবে কান দেয় না, তার ওসব কান দিলে চলে না। তার বড় কাজ এখন, বালিগঞ্জ বাজারে নেমে এই সবজি যত তাড়াতাড়ি বেঁচে বাড়ি ফিরতে হবে। নেপুর বাবা রিক্সা চালিয়ে ফিরবে,তার খাবার করা। নেপু মাস্টারের কাছ থেকে পড়ে আসলে, তার রুটি তরকারি কোনোদিন বা দুটো ভাত! ছেলে স্কুল থেকে ফিরে কিছু খেতে পায় না। দুটো বিস্কুট খেয়ে দৌড় দেয় পড়তে। নেপুর বাবা আগে ছিল মদখোর মাতাল। যা দু পয়সা রোজগার করতো, সবই ওই মদের পেছনে। মাঝে মাঝে প্রতিমার কাছে চাইতো, না পেলে মারধোর, নেপুকে গালিগালাজ এ সবই চলতো। কিন্তু গত বছর থেকে গল্পটা গেছে আমূল বদলে!
নেপু মাধ্যমিকে ইস্টার পেয়েছে, প্রতিমা কি আর ইস্টার ফিষ্টার বোঝে? তবে স্কুলের মাস্টার বলেছিল,
-খুব ভালো রেজাল্ট! ও সাইন্স নিয়ে পড়বে!
তা প্রতিমা আর আপত্তি করেনি। ছেলে নাকি বড় হয়ে ডাক্তার হবে। শুনেই প্রতিমার সেকি হাসি! মাস্টার বলে কি? রিক্সাওয়ালার ছেলে ডাক্তার ! কিন্তু এমনি সেমনি তো না, নেপু যে ওদের স্কুল, শুধু স্কুল কেন গাঁয়ের বাকি সব মাস্টার দিদিমণিদের ছেলেমেয়েদের হারিয়ে পুরো জেলায় ফার্স্ট, যাকে বলে প্রথম হয়েছে। সে নাকি ভারি সম্মানের। সেই দিন ছেলের ভালো রেজাল্টের আনন্দে প্রতিমা এট্টু মাংস এনেছিল, খাসীর মাংস। ছেলেটা কবে থেকে খাবো খাবো করছে। হাঘরের ঘর! খাসীর মাংস কি আর রোজ রোজ হয়? কিন্তু আজকের দিনে না আনলে মায়ের মন যে বড় কাঁড়ায়, আছড়ায়!
নেপু রাত আটটা নাগাদ খেতে বসেছে। আজ একটু তাড়াতাড়িই বটে। কদ্দিন বাদে মাংস! তার উপরে আজ আবার রেজাল্ট বেরিয়েছে। ফোনে ফোনে কতলোক প্রশংসা করছে। প্রতিমার আজ আন্দে বুক ভরে উঠছে। বার বার কপালে হাত ঠেকাচ্ছে।
-তুমি আছো ঠাকুর, তুমি আছো।
সবে বেগুন ভাজা দিয়ে দুটো ভাত খেয়ে, মাংসের ঝোল পাতে পড়েছে। এক গরাস মুখে তুলেছে কি তোলেনি, কোথা থেকে নেপুর বাপ এসে হুজ্জুতি জোড়ে। প্রথমটা প্রতিমা গা করেনি। আজ আনন্দের দিন। তাড়াতাড়ি থালাতে ভাত বেরে ডেকেছে,
-কই গো নেপুর বাপ, এসো। তুমিও বসি পড়ো। গরম গরম খেইয়ি নাও।
হরেণ তখন চুর ! নেশার ধুনকি মাথায় চড়েছে! সে কি আর ওসব কথায় ভোলে? তার এখন রঙীন জল চাই, তবে না তেষ্টা মিটবে!
-টাকা দে।
-আগে খেইয়ি নাও।
-আগে টাকা দে শালী!
ছেলের সামনেই চেপে ধরে প্রতিমার চুলের মুঠি। লাথি মেরে উল্টে দেয় নিজের পাতের ভাত , পাশে থাকা নেপুর থালাও গিয়ে ছিটকে পড়ে উঠোনে। রাতের অন্ধকার চিড়ে খনখন শব্দ যেন হরেণের চিৎকার ছাপিয়ে বড় বেশি সোচ্চার। দু চার বার কেঁপে থালাটা স্থির হয় মাটির উঠোনে। মাংসের টুকরোতে কাদা মেখে তখন কালচে। ঝোল ভাত ছিটকে পড়েছে চারিদিকে। প্রতিমা নিস্তব্ধ, ভেবে পাচ্ছে না কি করবে? বাড়ির বেড়ালটা সব চুপচাপ দেখে গুটি মেরে এগোতে থাকে ঝোল মাখা ছেটানো ভাতের দিকে। প্রতিমা, সাত চড়ে রা না কাড়া, লক্ষ্মী প্রতিমা, স্বামীর মঙ্গল কামনায় এক মাথা সিঁদুর আর বড় টিপ পরা প্রতিমা, হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পায়! আশেপাশে খুঁজতে থাকে, হঠাৎই বুকের ভেতরের পড়ে পড়ে মার খাওয়া বাঘিনীটা ফুঁসে ওঠে।‌হাতের কাছে থাকা উনুনের চেলাকাঠ তুলে, উই মার! মারতে মারতে বার বার ছেলেটার দিকে চোখ চলে যায়! নেপুটার চোখ ভরা জল, আর সদ্য ওঠা সবজে গোঁফের রেখায় পোটা মেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হু হু করে ওঠে মায়ের বুক! আমার নেপু আর সব ছেলেদের মত না। ও এখনো সরল, মায়ের আঁচল ধরা, শান্ত, ঘরকুণো, বই মুখো! বুকের ভেতর আগুন দাউ দাউ করে ওঠে, জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চায় সব।
-তবে রে হতচ্ছাড়া মিনসে? আজ তোর একদিন কি আমার একদিন! আমার ছেইলির মুকের ভাত তুই কেড়ে নিলি!
আজ লক্ষ্মী প্রতিমার ওপর যেন চামুণ্ডা ভর করেছে! পিটিয়েই যাচ্ছে , পিটিয়েই যাচ্ছে, পিটিয়েই যাচ্ছে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। বুকের আঁচল আলগা হয়ে মাটিতে লুটোচ্ছে, খোঁপা এলো, কিছু চুল ঘামে ভিজে লেপটে রয়েছে কপালের দুপাশে, সিঁদুর সারা কপালময়। কালো মুখখানা রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় যেন আরো কালো! স্বয়ং দুর্গা হয়ে প্রতিমা যেন হরেণ রূপী অসুরকে আজ মেরেই ফেলবে। নেপু উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখছে তার শান্ত মায়ের এক নতুন রূপ!
যদি পাশের বাড়ির জগাই আর মদনা এসে না সামলাতো, তাহলে হয়তো একটা খুনোখুনিই হয়ে যেত। মেয়েরা তো কেউ কাছে ঘেঁষতেই সাহস পায়নি, অথবা চায়নি। তারাও তো ওই একই কাজ করতে চায় কিন্তু পেরে ওঠে না। তাদের হয়ে প্রতিমা পারছে! এ যেন ওই সব পড়ে পড়ে মার খাওয়া, কালোকোলো, গরীবগুর্বো , পুরুষ পদপিষ্ট মেয়েগুলোর বদলা, তাদেরই জয়!
নেপুর ঘাড় সেই যে সোজা হলো, আর বেঁকলো না কোনোদিন! মদ ছাড়লো জন্মের মত। তারপর থেকে একেবারেই সরল রেখা। প্রতিমা ডায়ে বলে তো ডায়ে, বাঁয়ে বলে তো বাঁয়ে। বাপরে! কি মার! কি মার! এখনো ডান পাঁজরে মাঝে মাঝে ব্যথাটা চিড়িক করে জানান দেয়, সে ছিল, সে আছে, সে থাকবে! নেপু সাইন্স নিয়ে পড়ে, বারো কেলাসে উঠেছে। এগারো কেলাসেও তার খুব ভালো রেজাল্ট!
-উফ্!
কে যেন উঠতে গিয়ে অসাবধানে হোক বা ইচ্ছে করেই হোক, দিয়েছে প্রতিমার বাম পায়ের কড়ে আঙুল মাড়িয়ে। প্রতিমার ওসব খেয়াল নেই। ছেলের পড়ার খুব চাপ। সারারাত জেগেই থাকে। একটু ভালোমন্দ না রেঁধে দিলে হয়? নেপুর মা ছেলের ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে, চোখ বুজে মুড়ি চিবোতে থাকে। ক্যানিং লোকাল স্টেশন ছেড়ে এগিয়ে চলে নিজের গন্তব্যে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।