সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ১)

কেমিক্যাল বিভ্রাট

দরজা খুলতেই ঔপমানব দেখলেন আঠেরো-উনিশ বছরের একটা গাট্টাগোট্টা ছেলে তাঁর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কাকে চাই? জিজ্ঞেস করার আগেই ছেলেটি জানতে চাইল, আপনার নাম কি ঔপমানব?
ঔপমানব হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তেই সে বলল, আপনি বোধহয় বাজারের এই ব্যাগ দুটো রাস্তার ওপরে রেখে এসেছিলেন, তাই নিয়ে এলাম। বেশ ভারী কিন্তু। আপনি কি ভেতর অবধি বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন? না, আমিই পৌঁছে দিয়ে আসব?
— না না পারব, পারব। থ্যাঙ্ক ইউ।
— এতে আবার থ্যাঙ্ক ইউ বলার কী আছে? আপনাকেই তো আমার থ্যাঙ্ক ইউ জানানো উচিত। আপনি যদি এই চিরকুটে নাম-ঠিকানা লিখে আনাজপত্রের এই ব্যাগের উপরে মানিব্যাগটা চাপা দিয়ে রেখে না-আসতেন, তা হলে আপনাকে খুঁজে বার করতে আমাকে কত হয়রানি হতে হত, একবার ভাবুন তো?
— হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটা অবশ্য ঠিক। আমি অস্বীকার করছি না। তবু… থ্যাঙ্ক ইউ বাবা থ্যাঙ্ক ইউ।
— আবার থ্যাঙ্ক ইউ?
— না না, ঠিক আছে, ঠিক আছে।
গতকালই পুরী থেকে ফিরেছেন ঔপমানব। দু’-এক বছর পর পরই যান। আবার কখনও সখনও বছরে দু’বারও হয়ে যায়। কিন্তু এ বার তার একদম অন্য রকম একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। অন্যান্য বার দেখেছেন, অনেকেই, বিশেষ করে ইসকনের লোকেরা জলে নামার আগে তাঁদের মানিব্যাগ, চশমা, ঘড়ি-টরি রুমালে জড়িয়ে সি-বিচের বালির নীচে পুঁতে তার উপরে কোনও কিছু দিয়ে একটা চিহ্ন রেখে দেন। কিন্তু এবার দেখলেন, শুধু ও সবই নয়, তার সঙ্গে দামি মোবাইলও বালি-টালি না খুঁড়েই, খোলা আকাশের নীচে সি-বিচের ওপরে রেখেই অবলীলায় নেমে এলেন সমুদ্রে। সে দিকে একবার ফিরেও তাকালেন না।
শুধু তাই-ই নয়, জল বাড়তে বাড়তে আর একটু হলেই ঢেউ যখন ওগুলোকে ছুঁয়ে ফেলল বলে, তখনও তাঁর সে দিকে হুঁশ নেই। লাফিয়ে লাফিয়ে বাচ্চাদের মতো ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করে যাচ্ছেন। ঔপমানব যখন ভাবছেন, এই রে, ঢেউ তো এ বার ওগুলোকে ভিজিয়ে দেবে। টাকা-পয়সা না-হয় শুকিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু ঘড়ি বা মোবাইল? মোবাইলে জল ঢুকলেই তো গেল… ঠিক তখনই দেখলেন, সমুদ্রে নামতে আসা একজন লোক ওগুলোকে তুলে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখলেন।
ঔপমানব অবাক। এ রকম আবার হয় নাকি! শুধু পুরীর সমুদ্র সৈকতেই নয়, খোদ পুরীর মন্দির প্রাঙ্গণেও ঘটে গেল আরও একটি ঘটনা। সন্ধের আগেই মন্দিরের লাগোয়া চাতালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বউ-ছেলে নিয়ে তিনি যখন চূড়ায় ধ্বজা বাঁধা দেখার জন্য উপর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। দেখছেন, কোমরে এক গাদা ধ্বজা নিয়ে মন্দিরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে হনুমানের চেয়েও দ্রুত কী সুন্দর তরতর করে উঠে যাচ্ছেন এক সেবাইত, ভাবছেন, নতুনগুলো লাগিয়ে আগের ধ্বজাগুলি নিয়ে নামলেই তাঁর কাছ থেকে ধ্বজার একটা টুকরো কিনবেন। গত বারও একশো টাকা দিয়ে একটা কিনেছিলেন।
পরে শুনেছিলেন, ওগুলো নাকি আসল নয়। নামার সময় অত্যন্ত কৌশলে অন্য কতগুলো কাপড়ের টুকরো নিয়ে এসে এমন ভান করেন, যেন এক্ষুনি এগুলি পেড়ে আনলেন। পুরীর মন্দিরের ধ্বজা বলে কথা! বহু লোক বিশ্বাস করেন, এগুলো বাড়িতে রাখলে সমস্ত বিপদ-আপদ কেটে যায়। ঘরে শান্তি ফিরে আসে। সন্তান-সন্ততিদের মঙ্গল হয়। তাই অনেকেই টপাটপ করে একটা নয়, দুটো-তিনটে-চারটেও কিনে নেন। অথচ স্থানীয়রা বলেন, আসল ধ্বজাগুলো নামানোর সঙ্গে সঙ্গেই ওঁরা নাকি হাত সাফাই করে সরিয়ে ফেলেন। পরে সেগুলোই লোক বুঝে অনেক চড়া দামে বিক্রি করেন। আবার যে দিন কেনার লোক অনেক বেশি থাকে, সে দিন নাকি সুযোগ বুঝে কখনও সখনও নিলামও করেন। তখন যে বেশি দাম হাঁকেন, তখন নাকি তিনিই সেটা পান। যদিও গত বার যেটা কিনেছিলেন, সেটা যে একশো শতাংশ খাঁটি, তার প্রমাণ স্বরূপ তাতে সিলমোহর মারা ছিল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।