ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব – ২)

তীর্থভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

গঙ্গার দক্ষিণ থেকে অজয় নদের উত্তর পর্যন্ত উত্তর রাঢ়, অজয় নদের দক্ষিণ থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত বিভাগ দক্ষিণ রাঢ়।
বল্লাল সেনের নৈহাটি লিপিতে উত্তর রাঢ় বর্ধমান ভুক্তির অন্তর্গত ছিল; কিন্তু প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের মতে উত্তর রাঢ় কঙ্কগ্রামভুক্তির অন্তর্গত। কিভাবে এই পরিবর্তন ঘটে তার কোন কারণ জানা না গেলেও শক্তিপুর পটোলীতে এ তথ্য পাওয়া যায়।(ড. নীহার রঞ্জন রায়– বাঙালির ইতিহাস/ আদিপর্ব ,১৩৮২/পৃঃ ৬৮)‌।
ভবিষ্য পুরাণে বর্ণিত ‘রাঢ়ীখন্ড’ ভাগীরথীর পশ্চিমে এক জনপদ। এর অধীনে বক্রেশ্বর ,বীরভূমি প্রভৃতি স্থানের নাম পাওয়া যায়।
মহাভারতে ভীমের দ্বিগবিজয় বর্ণনায় রাঢ়দেশের যে সীমা নির্দেশ আছে তাতেও ‘বীর দেশের’ উল্লেখ আছে—
” গৌড়স্য পশ্চিমে ভাগে বীরদেশস্য পূর্বতঃ।
দামোদরোত্তরে ভাগে রাঢ়দেশ প্রকীর্ত্তিত।”

অনেকের মতে এই ‘বীরদেশ’—- বীরভূমির ই নামান্তর।
কুলপঞ্জিকার শ্লোক থেকে জানা যায় — বীরভূম পূর্বে ‘কামকোটি’ নামে খ্যাত ছিল। তার চতুঃসীমা ছিল —পূর্বে গঙ্গা( অজয় সম্মিলিতা), পশ্চিমে ঘন অরণ্যভূমি, উত্তরে পাথরের দেশ বা পর্বতশ্রেণী, দক্ষিণে বিন্ধ পর্বত থেকে উৎসারিত দামোদর প্রভৃতি নদনদী।
“বীরাভূঃকামকোটিঃস্যাৎপ্রাচ্যাংগঙ্গাজয়ান্বিতা।
আ্যণ্যকঃ প্রতীচ্যাঞ্চ দেশো‌ দার্ষদ উত্তরে।
বিন্ধ্যপাদোদ্ভবা নদ্যঃ দক্ষিণে বহবাঃ স্থিতাঃ।”

কিন্তু বীরভূমে কামকোটি নামে কোন জায়গা এখন দেখা যায় না। বীরভূমের প্রাচীন অন্যান্য নামের মধ্যে ‘উচ্ছালক’, ‘বজ্জভূমি’ প্রভৃতির নাম পাওয়া যায়।
বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ৪র্থ ও ৫ম খ্রিস্টাব্দেও বীরভূমি অঞ্চল মগধ রাজ্যের
শাসনাধীন ছিল এবং ষষ্ঠ শতাব্দে শশাঙ্কের রাজত্বকালে বীরভূম কর্ণসুবর্ণের অধীন হয়।৭৩২ খ্রিস্টাব্দে রাজা আদিশূরের সময় এই অঞ্চল মানভূম প্রদেশের অধীনে যায়( সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিতে’ এর উল্লেখ আছে)।

আবুল ফজল রচিত আইন ই আকবরী গ্রন্থ থেকে জানতে পারি যে, সম্রাট আকবর তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যকে বারোটি সুবায় বিভক্ত করেন( পরবর্তীকালে 15 টি)।সুবা বাংলা তার মধ্যে অন্যতম । এই সুবা বাংলা ২৪ টি সরকারে এবং এক একটি সরকার কয়েকশ মহাল নিয়ে গঠিত ছিল। বীর ভূমি মহাল মাদারুন সরকারের 16 টি মহালের একটি ছিল।
খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে সুবা বাংলার নবাব নাজিম মুর্শিদকুলি খা ছোটনাগপুরের বর্বর দস্যু গনের ভয়াবহ আক্রমণ থেকে সীমান্তকে রক্ষা করার জন্য পাঠান বংশীয় আসাদুল্লাহ খাঁকে বীরভূমের জমিদারি এবং সৈন্য প্রতিপালনের জন্য বহুতর জমি নিষ্করূপে ভোগ করতে অনুমতি দেন।
১৭২২ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার রাজস্ব আদায়ের পাকা বন্দোবস্ত করেন। সেই সময় তিনি বাংলাকে ১৩ টি চাকলা বা বিভাগে বিভক্ত করেন। এই বিভাগের অন্তর্গত মুর্শিদাবাদ চাকলা রাজশাহী, বোগরা(বগুড়া) ,পাবনা, বীরভূম ও নদীয়ার অধিকাংশ নিয়ে গঠিত হয় এই চাকলার অন্তর্গত বীরভূমের জমিদারি বাংলার মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল আয়তনে।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজগণ বাংলার দেওয়ানী সনদ পান; কিন্তু ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইংরেজরা প্রত্যক্ষভাবে বীরভূমের শাসনকার্যে সংক্ষেপ করেননি। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নতুন বিভাগ তৈরি করার সময় তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস বীরভূমকে বাঁকুড়ার সঙ্গে যুক্ত করে( মুর্শিদাবাদের অধীনে না রেখে) ২৯ শে মার্চ তারিখে কলকাতা গেজেটে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র যুক্ত বিভাগ রূপে গঠন করে প্রচার করলেন।
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ ই ফেব্রুয়ারি বোর্ড অফ রেভিনিউ এর আদেশ মত বীরভূম থেকে বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুরের জমিদারি বর্ধমানে স্থানান্তরিত হয়।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল হাঙ্গামা নিবৃত্ত হওয়ার পর , বীরভূম ও ভাগলপুর জেলার যে অংশে সাঁওতালগণ বাস করে, সেই অঞ্চলগুলো একসঙ্গে মিলে সাঁওতাল পরগনা নামে একটি নতুন জেলা সৃষ্টি হয়।
“প্রায় চোদ্দ কোটি বছর আগে জুরাসিক যুগে বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তর পশ্চিমে অগ্নুৎপাতের ফলে ব্যাসেল্টের লাভা প্রবাহ ঘটে। এটি রাজমহল ট্রাপ নামে পরিচিত, ক্লে যুক্ত ব্যাসল্ট লাভা দ্বারা গঠিত।
কুড়ি থেকে দশ লক্ষ বছর আগে তুষার যুগ— কো-আর্টানারি যুগে বীরভূম ডেল্টার অন্তর্গত বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলা অঞ্চলের সমুদ্র সরে যেতে শুরু করলে রাজমহল পাহাড় থেকে নেমে আসে প্রাচীন নদীগুলি–গুমানী, বাঁশলাই, পাগলা, দ্বারকা, ব্রাহ্মণী ,ময়ূরাক্ষী প্রভৃতি…।….
পরে ওই সব নদী গুলির ধারে ধারে প্রাচীন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষেরা বসবাস শুরু করে। শীঘ্রই নিষাদ ও ব্যাধ নরগোষ্ঠীর সঙ্গে আগ্রাসন ও সংঘর্ষ শুরু হয়। অতঃপর দুই নরগোষ্ঠীর সাঙ্গীকরণ চলতে থাকে। এটি নব্য প্রস্তর যুগে ঘটনা।”
” অতি সম্প্রতি মুশিদাবাদের সাগরদিঘির হাটপাড়া অঞ্চলে পুরাতত্ত্বিক খননে পাওয়া গেছে, প্রচুর পাথরের ফলক এবং অতি সূক্ষ্ম অস্ত্রগুলি সম্ভবত রাজ মহল পাহাড়ের পাথরে তৈরি।’
অজয় তীরে বীরভূম বর্ধমান সীমান্তে ২৫০০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পান্ডু রাজার ঢিবি, সুরথ রাজার ঢিবি আবিষ্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ বীরভূমের অতীতকালের ইতিহাস মনুষ্য জাতির প্রাচীন ইতিহাসের সমগোত্রীয়।
বীরভূম নামের উৎস কী?
‘পন্ডিতের বীরভূম বিবরণী’ (1868 সালে প্রকাশিত W.W.HUNTER লিখিত T HE ANNALS OF RURAL BENGAL বইয়ের APPENDIX E / THE PANDITS CHRONICLE OF BISHENPORE অংশ )থেকে জানা যায় যে,” একদা তাঁর শিক্ষিত বাজপাখিদের সহায়তায় শিকারের জন্য বিষ্ণুপুরের রাজা রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলে যান। একটি সারস পাখির পশ্চাদ্ধাবনে একটি বাজপাখিকে তিনি ইঙ্গিত করেন, তখন সচরাচর বাজপাখি দিয়ে এগুলো শিকার করা হতো। সারসটি প্রচন্ড বিক্রমে অনুসরণকারী বাজটিকে আক্রমণ করে ও বিজয়ী হয়। এই অস্বাভাবিক ঘটনায় রাজা বিস্মিত হন। তিনি ভাবেন যে নিশ্চিতভাবে মাটির কোন রহস্যজনক গুণের কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে অর্থাৎ এইখানের মাটি বীর মাটি এবং এই মৃত্তিকাজাত যে কোনো বস্তুই বীরত্ব ও শক্তিমন্ডিত হবে। সেই কারণে তিনি এখানের নামকরণ করেন ‘বীরভূমি’, তারপর থেকে সর্বদা এই পার্বত্য অঞ্চল ওই নামে পরিচিত হয়েছে।’
১৯১০ সালে বেঙ্গল ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স এর অন্তর্গত,L.S.S. O’MALLEY রচিত বীরভূম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার এ এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করা আছে।
এই ‘বীরভূমি’ নামের অনুরূপ, পার্শ্ববর্তী প্রদেশে আমরা আরো অনেকগুলি নামের উল্লেখ দেখতে পাই।যথা- মল্লভূমি, সিংহভূমি, শিখর ভূমি, বরাহ ভূমি, ধলভূমি, ইত্যাদি।
প্রবাদ যে, খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে

( ঐতিহাসিকগণের মতে 1244 খ্রিস্টাব্দ) বীরভূমের পুরাতন রাজধানী লক্ষ্নুর ( বর্তমানে রাজনগর) পার্বত্য জাতি কর্তৃক সময় সময়ে লুণ্ঠে আক্রান্ত হতো।……. এই সময় ” বীর” উপাধিধারী এক হিন্দু লখ্নুরে আধিপত্য স্থাপন করেন। অনেকেই অনুমান করেন যে,এই “বীর” উপাধিধারী রাজার স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ এই দেশ ‘বীরভূমি’ নামে অভিহিত হয়েছে।
বল্লাল সেনের সীতা হাটি তাম্র শাসন থেকে জানা যায় যে, বীরসেন নামে চন্দ্র বংশীয় এক রাজা ছিলেন।তাঁহার বংশে সামন্ত সেন বিজয় সেন বল্লাল সেন প্রভৃতি রাঢ়ের সেন বংশীয় রাজারা জন্মগ্রহণ করেন। অনেকের মতে তাঁহারা তাঁদের পূর্বপুরুষ বীর সেনের নামে এই অঞ্চলের নাম ‘বীরভূমি’ বলে প্রখ্যাত করেন।
প্রবাদ আছে যে সাত আটশ বছর আগে পশ্চিম উত্তর প্রদেশ থেকে( কাহারো মতে পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে) বীরসিংহ ও চৈতন্য সিংহ নামে দুই ভাই বীরভূমে এসে অসভ্য আদিম অধিবাসীদের পরাজিত করেন। বীর সিংহ বর্তমান সিউড়ির ছয় মাইল পশ্চিমে নিজের নাম অনুসারে বীরসিংহ পুরের রাজধানী স্থাপন করেন। বীর সিংহ রাজাই জরাসন্ধ রাজার বা তার পুরোহিতের বংশধর এবং বীরভূমের শেষ হিন্দু রাজা। কেউ কেউ বলেন, বীর সিংহ রাজার নাম থেকেই বীরভূমি নামের উৎপত্তি হয়েছে।
সাঁওতালি ভাষায় ‘বির’ শব্দের অর্থ জঙ্গল। এই জন্য কেউ কেউ মনে করেন যে ‘বীরভূমি ‘শব্দটি সাঁওতালি ভাষা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।
নাম যেভাবেই হোক না কেন জেলার সংস্কৃতি বিবর্তনের ইতিহাস অতি প্রাচীন। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত সমস্ত সাংস্কৃতিক পর্যায়ের চিহ্ন এই জেলায় দেখা যায়।
বীরভূম জেলার ভূতাত্ত্বিক বিন্যাসে আর্কিয়ান যুগ থেকে পরবর্তী সব যুগের আস্তরণ লক্ষণীয়। আর্কিয়ান যুগের গ্রানাইট নিস, বায়োটাইট সিস্ট, পেগমে টাইট বিভিন্ন পাথরের নিদর্শন পাওয়া যায়। সবার উপরে প্রাচীন পলিমাটি যা মধ্য প্লাই স্টোসিন যুগের চিহ্ন বহন করে।
আদিতে সারা বীরভূম জুড়ে অস্ট্রিক জনগণের বসবাস ছিল। তারপর সেন ভূমি দ্রাবিড়গণ এসে পণিয়ভূমি বা পাণ্ড্র ভূমিতে বসবাস করতে লাগলেন। অন্তত এক হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই দেশে কিরাত জনগণের আবির্ভাব হয়। তাঁরা উত্তর বীরভূম জুড়ে বাস করছিলেন। বৌদ্ধদেশের আর্যগণ আদিম অধিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে ভাবতেন বসবাসের অনুপযোগী। পরে এখানে প্রাগার্য ও আর্য বৈদিক ব্রাহ্মণ গনের আবির্ভাব ঘটে পর্বে পর্বে।
অশোক খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বেই আর্যগণ বিভিন্ন ধারায় এখানে আসতে শুরু করেন।
সারা বীরভূম জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব।
এই জেলার প্রত্ন সামগ্রী, ইতিহাসের অজস্র দলিল আর অজস্র পৌরাণিক কাহিনী রাঙ্গামাটির মাঠে-ঘাটে বট পাকুড়ের তলায় নদী কাঁদরের তীরে তীরে , আখড়ায় জনপদে একতারা হাতে আলখাল্লা পরিহিত বাউলের কণ্ঠে বাজে,’ আমি কোথায় পাবো তারে!, কিংবা “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়”!

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।