সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ৪)

দেবমাল্য

মাছ স্বপন ক’দিন ধরে দেবমাল্যকে খুব হুমকি দিচ্ছিল ফোনে। সেলফোনে। এখান থেকে ব্যবসা তুলে নিয়ে যেতে হলে আমাদের পঁচিশ লাখ টাকা দিতে হবে। আর তা যদি না দেন, যদি মনে করেন, রাতারাতি ব্যবসা তুলে নিয়ে চুপিচুপি অন্য জায়গায় চলে যাব, তা হলে যেখানেই যান না কেন, তার ফল কী হবে, আশা করি আপনাকে নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না…
তাই ফোন বাজলেই ওর বুক ধড়ফড় করে উঠত। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেত। ফলে দিনকতক ধরে ও সেলফোনের সুইচ অফ রেখেছিল। বাড়ি আর কারখানার ল্যান্ড ফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ও তখন বুঝতে পারেনি এতে কোনও সুরাহা হবে না।
সে দিন দুপুরবেলায় সামশের ছিল না। কী একটা কাজে যেন কোথায় গিয়েছিল। সে সময় হুড়মুড় করে তার দলবল নিয়ে কারখানার মধ্যে ঢুকে, সোজা তার টেবিলের সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল মাছ স্বপন। না, একটাও খারাপ কথা বলেনি। চোখও রাঙায়নি। খুব শান্তশিষ্ট ছেলের মতো শুধু পকেট থেকে একটা ছ’ঘড়া বের করে তার টেবিলের ওপরে রেখেছিল। এমন ভান করেছিল, যেন ওটা পকেটে থাকলে বসতে অসুবিধে হবে তাই টেবিলে রাখল। তার পর ধীরেসুস্থে বলেছিল, এটা কী করছেন দাদা, আমরা কি আপনার শত্রু? ফালতু ফালতু লাফড়া করছেন। আপনি যদি এখান থেকে ব্যবসা তুলে নিয়ে যেতে চান, যান। আমরা আপনাকে আটকাব না। শুধু আমাদের টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে যাবেন, ব্যস। আর এখানে যদি আপনার ব্যবসা করতে কোনও অসুবিধা হয়, আমাদের বলুন। আমরা প্রটেকশন দেব। চাল স্বপন কিচ্ছু করতে পারবে না।
মাছ স্বপনের সব চেয়ে বড় শত্রু চাল স্বপন। দু’জনের নামই স্বপন। দু’জনেই ব্যবসা করত এই কালীবাবুর বাজারে। একজন মাছের। অন্য জন চালের। মদ খাওয়া, জুয়া খেলা থেকে সবই করত। খুব খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে গিয়েছিল ওরা। তাদের জন্যই মাঝেমধ্যে পুলিশ ওদের ধরে নিয়ে যেত। লকআপে রাখত। একবার সাত দিনের জেল কাস্টও হয়েছিল। আর জেলে থাকার সময়ই ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল স্থানীয় এক তোলাবাজের। বাইরে বেরিয়ে আসার পর আর ব্যবসা নয়, ওরা ভিড়ে যায় সেই তোলাবাজের দলে। দুই স্বপনকে আলাদা করে চিহ্নিত করতেই মাছওয়ালা স্বপনের নাম হয়ে যায় মাছ স্বপন। আর চাল বিক্রেতা স্বপনের নাম চাল স্বপন। কেউ কারও চেয়ে কম নয়। এ বলে আমাকে দ্যাখ, তো সে বলে আমাকে দ্যাখ। আগে ওদের মধ্যে খুব ভাল বন্ধুত্ব থাকলেও, বখরার টাকাপয়সা নিয়ে গন্ডগোলের জেরে ওদের সম্পর্কে চিড় ধরে। ভাগ হয়ে যায় দুটো দলে। একজন অন্য জনকে শেষ করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। সে সময় রোজই ওদের মধ্যে গোলাগুলি চলত। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দু’জনেই দফায় দফায় তোলা তুলত। এখন অবশ্য ওরা নিজেদের মতো করে এলাকা ভাগ করে নিয়েছে। তবুও মাছ স্বপনের সন্দেহ, চাল স্বপন তার এলাকায় ঢুকছে। আবার চাল স্বপনেরও ধারণা, মাছ স্বপন তার এলাকায় থাবা বসাচ্ছে।
ফের মাছ স্বপন বলল, কোনও চিন্তা করবেন না। আমরা তো আছি, নাকি? আপনি আমাদের দেখবেন, আমরা আপনাকে দেখব। দাদা-ভাইয়ের মতো থাকব। আপনি ফোনটা বন্ধ করে রেখেছেন। নাম্বার পাল্টেছেন নাকি? ফোনটা খুলুন।
কোনও কথা বলেনি দেবমাল্য। ড্রয়ার থেকে মোবাইলটা বের করে অন করে দিয়েছিল। যে চেয়ারে বসে মাছ স্বপন কথা বলছিল, তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল ওর সঙ্গে আসা আরও কয়েকটা ছেলে। তাদেরই একজন একটা মোবাইল নিয়ে কী সব খুটখাট করছিল। সে হঠাৎ বলে উঠল, আপনার ফোন তো সুইচ অফ।
— সুইচ অফ? এই তো অন করলাম।
— দেখুন দেখুন, ভাল করে দেখুন। মাছ স্বপন বলতেই দেবমাল্য টেবিল থেকে ফোন নিয়ে দেখে সত্যিই ফোনটা অফ হয়ে গেছে। ফের অন করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল সে। কয়েক মুহূর্তমাত্র। ঝপ করে স্ক্রিনটা কালো হয়ে গেল। ও বলল, চার্জ নেই মনে হয়!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।