ভ্রমণ সিরিজে শতদ্রু ঋক সেন – ৪০

ফেরা

জয় মা গঙ্গা।
গোমুখ যাত্রার দিন, ভোর বেলাতেই বেরিয়ে পরা হলো। সেদিন চৌদ্দ কিলোমিটার গিয়ে ভূজ বাসা তে থাকা হবে। ঘোড়া ওয়ালা সুন্দর ও তার ঘোড়া আমাদের জন্য প্রস্তুত ছিলো।ঘোড়ার পিঠে কিছু মালপত্র ও মাঝে মাঝে ক্লান্ত হলে আমরা চড়বো। মা গঙ্গার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে যাত্রা শুরু হলো।মনোরম দৃশ্য চারিদিকে, পাশ দিয়ে সগর্জন সহ বয়ে চলেছেন মা গঙ্গা। নদীর ওপর মাঝে মাঝে ভাঙা বরফের চাঙর,ও তার উপর ধুলোর আল্পনা। মাঝে মাঝে পাখির ডাক। সাথী হচ্ছিলো হিমালয়ের কাক চৌ।অনেক দেশী বিদেশী মানুষের সাথে আলাপ হলো সারা রাস্তা জুড়ে। ওখানে কোনো রাগ নেই, সবাই সবাইকে সাহায্য করার জন্য উদগ্রীব। মনে হচ্ছিল যেন রূপকথার রাজ্য। এছাড়াও ছিলো মাঝে মাঝে সাথে আনা গ্লুকোন ডি তে গলা ভেজানো, আর কয়েক মাইল অন্তর পথ পাশের ঝুপড়ি তে গরম গরম চা। পাহাড়ি পথে চা বাড়তি এনার্জি দিতে বরাবরই সক্ষম হচ্ছিলো। অনভ্যাসের ফলে একটু হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিলো ঠিক ই, কিন্তু দারুণ লাগছিল।আমি আর বাবা বাকিদের থেকে বেশ কিছু টা এগিয়ে গিয়েছি একসময়। এক জায়গায় দেখি অনেকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঐ জায়গাটি এই পথের সবচেয়ে বিপজ্জনক অন্চল। খুব বেশী হলে ৫০০ মিটার ও নয়। কিন্তু পায়ের তলায় পাথর ঝুরঝুরে।আর ওপর থেকে মাঝে মধ্যেই পাথর গড়িয়ে আসে। গাইড বললেন এই জায়গায় কে জানে কেন পাথরের মধ্যে নুনের পরিমাণ বেশী। বুনো পাহাড়ি ছাগলরা ঐ নুন চাটে। একসময় তাদের ধাক্কায় পাথর গড়িয়ে পড়ে। তাই খুব সাবধানে এই জায়গা পেরোতে হয়। সবার সাথে আমরা পেরিয়ে গেলাম ঠিক ই, কিন্তু এর মধ্যেই আমাদের কানের পাশ দিয়ে দুখানা পাথর ছিটকে বেরিয়েছে। মাথায় লাগলে আর দেখতে হতো না।
বেলা পাঁচটা নাগাদ, ভুজবাসাতে লাল বাবা আশ্রমে পৌঁছে, জিরোনো, সাথে সন্ন্যাসী দের উপহার সরূপ আদা, এলাচ দেওয়া চা, ক্লান্তি কেটে গেছিলো এক নিমেষে। রাতে দেশী বিদেশী সবার সাথে গোল হয়ে রান্নাঘরে বসে বাংলা, হিন্দী ও ইংরেজি তিন ভাষায় প্রার্থনা, তারপর গরম রূটি তরকারি। আর নানা প্রদেশ, নানা বিদেশ থেকে লোকেদের সাথে আড্ডা, আশ্রমে সবাই এক, কারো সাথে কারো ভেদাভেদ নেই। খুব ভালো কেটেছিল সেই রাত। এই প্রসঙ্গে বলি, আমি মনে মনে চেয়েছিলাম জিএমভিএনের অতিথিবাসে রাত কাটাতে কিন্তু জায়গা পাইনি। পরে ভেবেছিলাম, ভাগ্যিস পাইনি, তাই একে অপরের এই মেলবন্ধন দেখা থেকে আমাদের বঞ্চিত হতে হতো। এ যেন মা গঙ্গার আশীর্বাদ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।