গদ্যের পোডিয়ামে (ধারাবাহিক) – সুদীপ্তা রায় চৌধুরী মুখার্জী – পর্ব- ৫

গবলেটে মেঘ ছিল কিন্তু !
“এতো ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা” বাঙালির সব গেছে। দ্যাশ গেছে, ভিটে গেছে, কুমির ডাঙার মাঠ গেছে তবু পড়ে আছে উৎসব যা দিনগত পাপক্ষয়ের থেকে এক ঝলক মুক্তির আশ্বাস। সুনীল-শক্তি নেই, উত্তম-সৌমিত্র নেই, বিধানসভায় বামফ্রন্ট নেই, লাল লেটার বক্স নেই, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের উন্মাদনা নেই তবুও রয়ে গেছে “আসছে বছর আবার হবে”র উত্তাপ । ইএমআই ধ্বস্ত বাঙালি এখান থেকেই খুঁজে নেয় মুঠো ভরা অবসর । গ্ল্যামারাস আলস্য ।
পরাবাস্তবের ছায়ায় মাখা পুজোর জন্য তিথির আবশ্যকJতা থাকলেও বাঙালির উৎসব প্রবণতা সব ক্ষেত্রে তিথির মুখাপেক্ষী কি? তাই তো জাতিয় উৎসব, পারিবারিক উৎসব, ধর্মীয় উৎসবের সাথে দিব্যি জায়গা করে নিয়েছে বইমেলা, চলচ্চিত্র উৎসব ও কবিতা উৎসব । আর এভাবেই উৎসবের বহর দামোদর শেঠের মতো বেড়ে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণে’র মান রক্ষা করেছে ।
ঘুমের ওষুধ সহযোগে রাত্রি যাপন আর ইনকাম ট্যাক্সের মাঝের নো ম্যান্স ল্যাণ্ডে বসত করে উৎসব, সম্বতসরের বেঁচে থাকার নীল সুগন্ধী খামের স্মৃতি । জীর্ন সময় ও জীর্নতর যাপনের মাঝেও উৎসব জোনাকি হয়ে জ্বলতে থাকে।
নিজস্ব গন্ডি থেকে বেরিয়ে সর্ব্বজনীন হয়ে ওঠার প্রয়াস সাধিত হয় উৎসবের অবকাশে। চন্ডিমন্ডপ থেকে উচ্ছেদ হওয়া বাঙালি সিসিডি তে ঠাঁই পেলেও মনের কোনো গহীন কোণে আলো চিঠির মতো ভাস্বর পুজামন্ডপ।
“মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি” যখন আক্ষরিক অর্থেই সত্য তখনও “মুক্তবেণীর তীরে” বাস করা বাঙালি উৎসবের আলো জাগিয়ে রেখেছে অন্তর্জালের আন্তরিকতায় । উৎসব বোমা ও বিবেক কে মেলায় ধ্বনিভোটের নীরব সমর্থনে ।উৎসবের চোখ ঝলসানো প্রাতিষ্ঠানিকতা ভেঙে দেয় শ্রেণী বিভাজন । সংহতির ভিত্তি দৃঢ় হয় । দ্বেষ ভোলে দেশ ।
“পরশু তো ষষ্ঠী” মনে পড়লেই ট্যাম্পার চোখের টলির মায়া । প্রবাসীর হোয়্যাটস অ্যাপ লালিত দীর্ঘ শ্বাস ঘন হয় । ক্রেডিট কার্ডের স্টেটমেন্টে ভেসে ওঠে না খোলা চিঠির সম্ভার । জড় হয় প্রিয় মুখের মিছিল । মনে পড়ে ঠাকুমার তিন আয়নার কাচ সম্বলিত ড্রেসিং টেবিল আর তার মায়া মেদুরতা । ঋতুপরবের দিন আর ফসলের গান ফসিল হয়েছে কবেই, তবুও রয়ে গেছে উৎসবের হিয়ন্ময়তা, আজও তা ক্যাটালিস্ট হয়ে মিলিয়ে দেয় ইটালির সঙ্গে ইছামতী কে । মাইক্রোসফটের হাজার বিবর্তনের পরেও হ্যালোউইন কে ভূত চতুর্দশীর রাতের পুনর্জন্ম বলে ভাবা গেল কই? প্রবাসীর প্রগ্রেসিভে বাষ্প ঘনায়, স্মৃতির ফিনফিনে আলোয় তিরতির করে কাঁপতে থাকে আকাশপ্রদীপ ।
সেক্টর ফাইভের কর্মব্যস্ত জীবনে অবসর যেন দেশভাগের মতোই কোনো অস্পষ্ট শব্দ, সেখানেও লাগে উৎসবের রং । উৎসবের মায়া টানে কেজো ব্লেজ়ার মজে ঢাকাইয়ের আবেদনে । উৎসবের রূপোর কাঠির ছোঁয়ায় শপিং মলের লাঞ্চটেবিলেই জমে ওঠে পারিবারিক হাসিতামাশার আসর । যদিও পাট শাকের বড়া, কচুর লতি ভাজা, বকফুলের বড়া, চাকা আলু ভাজা, ঘিয়ে ভাজা লুচি, কুমড়িরা বহুকাল বাঙালির প্লেট থেকে নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা করেছে, তারাই কিন্তু পুর্নোদ্যমে ফিরেছে পাঁচ তারা হেঁসেলের ব্যাকডোর দিয়ে, উৎসবের নিবিড় টানে । পায়েস, পিঠে, নাড়ু, তক্তি, মনোহরারা দশ গোল দেয় পাস্তা, পিৎজ়াদের উৎসবের অবকাশে ।
বাঙালি রক ভুলে যেদিন রক ভেঁজেছে, ভুলেছে ঐতিহ্য, ভেঙেছে পরম্পরা, সেদিনই আত্মনির্বাসনের কালনাগিনী কে চিনিয়েছিল সাধের বাসরঘর । গোলোকায়নের পথ ধরে ভাঙা রকের রাঙা ধুলায় মাথা তুলেছে মাল্টিস্টোরিড । খোয়া গেছে নাচঘরের আধিপত্য, হারিয়েছে কিনু গোয়ালার গলির সাবঅল্টার্ন সুখ ।
তবুও উৎসবের হাত ধরে যেন ফেরা যায় নির্বাসন থেকে উদযাপনে ।রবীন্দ্রনাথের ‘সুখের বসন্ত’ এভাবে মাঠে মারা যাবে বাঙালি জানত না, তাই কি উৎসবের টানেই বাঙালি বাঁচিয়ে রাখতে চায় বাকি বখেয়া ঐতিহ্যটুকু?
হালখাতা না দেখা বর্তমান প্রজন্ম কবির মধুমাস চিনেছে ফেসবুকের পলাশ বিলাসে । তারাও বর্ষশেষ ও বর্ষবরণের অবকাশে খুঁজে ফেরে হারানো চিলেকোঠা । মিডিয়াতন্ত্রের ব্রেকিং নিউজ়ও শিখেছে প্যান্ডেমিকের আতঙ্কেও মুনলাইট সোনাটা উদ্বৃত্ত হয় না । অর্থাৎ যখন জীবনের গর্ভজলে শ্বাস বিপন্ন হয় তখন উৎসব বয়ে আনে ছিলা ছেঁড়া উল্লাশের আশ্বাস । বাঙালি বোঝে যা গেছে তা ফিরবে বিকল্প ন্যারেটিভে, প্রতি মহালয়া ভোরে বেজে যায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আর বাঙালি তেল যুগিয়ে যায় সমর্পণের মঙ্গলদ্বীপে…
পথের বাঁকে বা শেষে পরিযায়ী সুখ আর বেদুইন হতাশা পেরস্পর কে ‘হাগ’ করে নগরভিড় এড়িয়ে, বাঙালির তা কি অজানা?
উৎসব রক্তে নেশা লাগায় আশ্লেষে, প্রদীপ শোভিত তুলসিমঞ্চ সুর মেলায় আধুনিক টুনিবাল্বের নীলাভ রশ্মির সঙ্গে । জেগে থাকে আলো, মেটে তমিস্রা । ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভাইরাস শাসিত বিনির্মাণ বা পুনর্নিমাণের সাক্ষী থেকেও বাঙালি বাতিহীন জলসাঘরে আগলে রাখে সুখ পিলসুজ । এভাবেই রাতের শরীর থেকে অভিশাপ মুছে ফেলে এগোতে থাকে সময় । প্রলয় থেকে জন্ম নয় অলৌকিক সুর । জীবন এগিয়ে চলে মৃত্যু কিনারার পথ ধরে । উৎসব এলে বোঝা যায় সব প্রত্যাশা ইতিহাস হয়ে যায়নি ।
দিন নিবে আসছে, ঘনাচ্ছে রাতের শরীরে নীলাভ আদর, ঐতিহ্যের বালুতটে নেমে আসছে ঐশ্বরিক জোছনা । রিক্ততার মধ্যে, ক্যাকোফোনির মধ্যেই বেঁচেথাকবে জীবন । বেঁচে থাকবে বাঙালি দর্শন । বেঁচে থাকবে উৎসব, মায়ার মনোপলি হয়ে…