গদ্যের পোডিয়ামে (ধারাবাহিক) – সুদীপ্তা রায় চৌধুরী মুখার্জী – পর্ব- ১

গবলেটে মেঘ ছিল কিন্তু !

।। পর্ব – ১ ।।

বড় বড় জলের ধারা নেমে ভেসে যায় ছাদ বাগান, বাতাসে তাও রয়ে গেছে গ্রীষ্মের ‘তাপস নিশ্বাস’ এই নিয়েই জৈষ্ঠ্য মাস আর তার একমাত্র সামাজিক উৎসব ‘জামাইষষ্ঠী’ মতান্তরে সন্তানষষ্ঠী। শুক্লা ষষ্টি তে বাংলার ঘরে ঘরে পূজিতা হন দ্বিভূজা গৌরবর্ণা মাতা ষষ্ঠী । সন্তানের মঙ্গল কামনায় প্রতি ঘরে পঞ্চপত্র তালপাতার পাখায় সাজিয়ে বাতাস দিয়ে ছেলে মেয়ে জামাই পুত্রবধুদের ‘ষেটের নজর’ থেকে বাঁচিয়ে রাখে কপালে বড় সিঁদুরের টিপ পরা ঠাকুমা । এ ছিল প্রতি ঘরের ছবি। আমার স্মৃতিতেও উজ্জ্বল হয়ে আছে এমন কিছু খন্ডচিত্র। রান্নাঘরে সকাল থেকেই ব্যস্ত থাকত ঠাকুমা-দিদিমারা যাদের লাল পাড় সাদা শাড়ির আঁচল থেকে ঝরে পড়ত আশীর্বাদ ও প্রশ্রয় । বর্ষা আসলে মায়া জমে। সে মায়াই ভালোবাসা আদর আশ্রয় হয়ে জমে থাকে ষষ্ঠীতলার বুকে। সকল আয়তির জলচুড়ি শাড়ির পাড়ে জেগে থাকে গর্বের কারুসাজ। তিমিরবিদারী মায়ার আভা ।

একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তির আশ্বাস উৎসব, আম-কাঁঠালের গন্ধে ভারী বাতাস ও নির্বিবাদী মেঘ। ছোটবেলায় বড় আনন্দের দিন ছিল এই উৎসব। গ্লানিই যখন সর্বত্র শিরোনাম তখন নিয়মতন্ত্রের পৌণপূনিকতা ভেঙে উৎসব যাপন করাই স্থায়ী অবসর বিনোদন । মনে পড়ে সকাল থেকেই তোড়জোড় চলত দিদার বাড়ি যাওয়ার । এদিকে বাড়িতেও বিপুল আয়োজন। পিসিদের আগমনে বাড়ি গমগম, দোলাচলে ভুগতাম বাড়ি থাকব কি দিদার বাড়ি যাব। শেষমেষ নতুন কাপড়ের অমোঘ আকর্ষণে বাঁধা পড়তাম। এভাবেই শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে দিদিভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। আমাদের যৌথ পরিবারের একমাত্র জামাই এলো “আনন্দ বসন্তের সমাগম” হয়ে। আমাদের বাড়িটা গড়া ঢালাও উঠোন আর বিরাট বারান্দার সমাহারে। শত উৎসবের সাক্ষী তারা। এভাবেই আরও অনেক ছায়াময় বর্ষা পেরিয়ে আমিও বাঁধা পড়ি যুগল চলনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে। এদিকে জামাই অপরিচিত নয়। তুই না তুমি কী ভাবে সম্বোধিত হবে সে এই গুরু গম্ভীর আলাপ আলোচনার মাঝেই টুক এসে পড়ল জামাইষষ্ঠী। আবারও উৎসব । বড়জ্যেঠির হাতের ঘি সিক্ত পোলাও সহ মাছ মাংসের রকমারি ক্যুইজিন। বাড়ির কর্তা আর ছেলেদের টানা বারান্দায় খাওয়ার আয়োজন হল আর জামাইযুগলের সদ্য আমদানিকৃত সেগুন কাঠের ডাইনিং টেবলে । তখনই এক দাদা বলে উঠল “জামাই কূলের একাধীপত্য মানছি না মানব না”। এভাবেই রঙ্গরসিকতায় দিনাতিপাত হত। সকল কে ষেটের কোলে রেখে একে একে ছায়াপথ পেরিয়ে গেল দাদু- দিদার দল । নিরুদ্দেশের টাইমটেবলে লেখা হল ছোট ভাইয়ের নাম। অসময়ে মুগ্ধস্নান সেরে একে একে বিদায় নিল জ্যেঠি-কাকির দল। জামাইবাবুও বুকের বাঁদিকে ক্যান্সার পুষে আজ এক মুদ্রিত ডেথ সার্টিফিকেট। স্মৃতি ধুলো মেখে বৃদ্ধাশ্রম হয়ে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে আমাদের আমোদবিলাসি প্রিয় বাস বাড়িখানি।

।। পর্ব – ২।।
ডাকপিয়ন তেপান্তরি হলেও তার ব্যাগ থেকে খসে পড়া মায়া ।আলগোছে ছড়িয়ে থাকে ইতিউতি । আজীবনের হাসি তামাশায় স্থায়ী বিষাদরেখা সময় টানতে দেয় না । সে বয়ে যায় নতুন নদীখাতে, এগিয়ে চলে জীবন, নতুন প্রজন্ম রচনা করে নতুন অধ্যায় । এক আলো মাখা রাতে প্রজাপতির নির্বন্ধে চার হাত এক হয় চতুর্থ প্রজন্মের ঠাকুমার মেঘার, সবার বুরুর । প্রেমের সংজ্ঞা হেয়ার কাটের মতো যুগে যুগে পাল্টায়, তবুও যে কোনো মেলাঙ্কলি কে জীবনের ডিসকোর্সে ব্যস্ত রাখতে সেই একমাত্র তুরুপের তাস । প্রতিটি মৃত্যু থেকে মাথা তোলে আর একটি জীবনের গল্প । লেখা হয় নিষিক্ত হিম থেকে নিষিদ্ধ ওমে উত্তরণের নবান্ন আখ্যান । তখন তমিস্রা কে অস্বীকার করে সাজাতেই হয় নতুন দাবার বোর্ড । সংশয় স্বরবে বলে, ফেলে এসেছ তো কত কিছুই, নিকোনো উঠোনের তুলসীমঞ্চ, কাশবনের বুক চিরে এগিয়ে চলা ন্যারো গেজের ট্রেন, হাই এক্সটেনশন তারে কাটা ঘুড়ির দোল খাওয়া, জীবনের টানে জীবনের সামনে নতজানু হতেই হয় । বারবার বিনির্মাণ আর পুনর্নির্মাণের সাক্ষী হয়ে চলতে চলতেই আবার সেজে ওঠে ডাইনিং টেবিল, ডাবচিংড়ি, ইলিশ যখন পরস্পর কে টক্কর দিতে ব্যস্ত তখনই মাঠ কাঁপাতে বাটি ভরা মাংস হাজির । অন্তরীক্ষে স্নেহপ্রদীপ জ্বালে ছোটকাকি, যার আলো শুধু অনুভবে জ্বলে, ট্যাম্পা থেকে ভেসে আসে উলুধ্বনি, আদরে আশীর্বাদে পূর্ণ হয় সৌনকের ষষ্ঠী যাপন ।

মে শোকের মাস । এর পরতে পরতে গাঁথা আছে এক অকালমৃত্যুর কথা । চিরুনীর আগায় লেগে থাকা সিঁদুর দিদিভাইয়ের কানে কানে বলে যায় ২৯, আগেও জীবন পরেও জীবন…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *