গল্পেরা জোনাকি তে রীতা চক্রবর্তী (পর্ব – ৫)

নীল সবুজের লুকোচুরি

মিঠি কলকাতায় চলে আসার পর ডাঃ সুমিতা নিজেও হোম ট্রান্সফার নিয়ে কলকাতায় এসেছেন। মেয়ের কাছে ডাঃ আনসারির কথা শুনতে শুনতে সুমিতা হারিয়ে যায় নিজের অতীতে। ফেলে আসা দিনগুলির স্মৃতি ভিড় করে আসে। মনে পড়ে যায় আয়ানের সাথে কাটানো দিনগুলির কথা।……..

নিজের নামের সাথে বিদেশের স্পেশালিস্ট ডিগ্রি জুড়ে নিয়ে আয়ান লন্ডন থেকে ফিরেছে কলকাতায়। হাসপাতালের ফর্মালিটিস কমপ্লিট করে বাবা-মা’র সাথে দেখা করতে জন্মভূমিতে ফিরতেই হবে ওকে।
সুমিতা পাঁচটা বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে আয়ানের জন্য।
সেদিনের সেই অন্তরের ছোঁয়াটুকু সম্বল করে এতগুলো বছর সবরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে নিজেই সামলে নিয়েছে। ভালোলাগা থেকে ভালবাসার গল্পকথার রঙিন জোয়ারে ভেসে যে নতুন অতিথি ওর শরীরে নতুন গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে, দিয়েছে বেঁচে থাকার অবলম্বন তার কথা আয়ানকে বলতে পারেনি আজও। হয়ত দুজনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের দিক থেকে কোনো বিষয়ে কোনও অসুবিধে সৃষ্টি করার মতো কথা আয়ানকে জানায়নি সুমিতা। শুধু আয়ানের চোখে নিজের জন্য এক সমুদ্র ভালোবাসা দেখতে চেয়েছে সুমিতা। তাইতো ডাঃ আনসারিকে ‘একান্তআপন’ করে রিসিভ করতে ডাঃ সুমিতা দেশের বাড়িতে পৌঁছে যায় দুদিন আগেই। তারপর নির্দিষ্ট দিনে স্টেশনে এসে বসে থাকে।

মনের ভেতর একরাশ অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষা করছে ট্রেনের। পাঁচবছর পর আজ আবার দেখবে আয়ানকে। আনন্দে উত্তেজনায় নিজেকে সংযত রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। একটা চাপা অস্থিরতা এলোমেলো করে দিচ্ছে নিজের চিন্তাগুলোকে। দীর্ঘ পাঁচবছর ধরে একে অপরের থেকে দুরে থেকেছে বলে মনের মধ্যে আশঙ্কার একটা কালো মেঘ উঁকি মারছে।
–আয়ান এখনো ওর অপেক্ষায় আছে তো!
—ভুলে যায়নি তো ওর ভালবাসার পরশ!
—এতদিন কি একলাই আছে?
—যদি অন্য কারোর প্রেমে পরে থাকে তবে ও কি করবে ? – —-যদি বিয়ে করে সংসারী হয়ে থাকে তাহলে কি হবে?
কি করে বলবে ওর একরত্তি সুন্দর প্রজাপতি, আয়ানের ছোঁয়ায় ফুটেওঠা আধফোটা পদ্মকলি ছোট্ট মেয়েটার কথা ?
এলোমেলো চিন্তাগুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে সুমিতাকে।
সময় কাটছে না। হাতের ম্যাগাজিনটা আনমনে একবার খুলছে আবার বন্ধ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকছে। বাইরের কতকিছু চোখে পরছে। সব কিছুই তাকিয়ে দেখছে। কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না।

হঠাৎ স্টেশনের সাউন্ডসিস্টেমে ঘোষণা হল “আপ শান্তিপুর লোকাল কিছুক্ষণের মধ্যে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে।” ঘোষণা শুনে বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি পরার শব্দ শোনা যাচ্ছে। যেন সমুদ্রে হঠাৎ উথালিপাথালি ঢেউ উঠেছে। তবে বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে আপাতনির্লিপ্ত সাধারণ এক আধুনিকা।

আয়ানের বাড়ি মাটিগাড়ায়, সুমিতাদের পলাশগড়ের বাড়ি থেকে একটু দুরে। আয়ানের বাবা ওখানকার একজন গণ্যমান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মফস্বল শহরে সবাই চেনে ওদের।
সুমিতার বাবা কলকাতা রাইটার্সে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে স্থানীয় লোকজন তাঁকে অত্যন্ত সমীহ করে। উনি বর্তমানে অবসর নিয়েছেন। বড়দা’ নবান্নে কর্মরত। বড়দা’কেও সবাই খুব সম্মান করে। মিঠাগড় রাইস মিলের সমস্ত দায়িত্ব মেজদা’ একাই সামলে নিয়েছে। ছোটভাই এবার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। সুমিতা অনেক আগেই পাশকরে হাসপাতালে জয়েন করেছে গাইনোকোলজি ডিপার্টমেন্টে।

আয়ান তো সুমিতার থেকে সিনিয়র, মেজদা’র বন্ধু । গ্রামবাংলার সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপনের আনন্দ ভাগকরে একসাথেই বড় হয়েছে ওরা। সুমিতার মনেপরে ছোটবেলায় ওদের দুই বাড়ির ছেলেদের মধ্যে বেশ যাওয়া আসা ছিল। তারপর অবশ্য কৈশোরের চঞ্চলতা পার করে হঠাৎ করে কখন যেন বড় হয়ে যাবার কারণে একটু দুরত্ব তৈরি হয়েছিল। তবে সুমিতা জয়েন্টে কোয়ালিফাই করে ডাক্তারিতে ভর্তি হলে আবার এই দুই পরিবারের দূরত্ব কমে যায়। আয়ান নিজে থেকেই এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেছে। যে কোনও রকমভাবে ও সাহায্য করতে প্রস্তুত সুমিতাকে। তখন থেকেই সুমিতা আয়নের সাথেই যাতায়াত শুরু করে। সাবজেক্টও একই ছিল। তাই পড়াশোনার কারণে বাড়িতে বা কলেজে একে অপরের কাছে যখন তখন হাজির হওয়াটা ছিল খুবই স্বাভাবিক।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।