সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সুষ্মিতা রায়চৌধুরী ( পর্ব – ১)

পুনশ্চ হলিডে ককটেল

প্রথম পর্ব

কতোটা আলোর পথ হাঁটলে,তুচ্ছ হয় অন্ধকার?কতোটা আলোর ছটায় চোখ কচলে জেগে উঠতে পারে ন’মাস ঘুমের তোরণে মুখলোকানো এককালিন চিরবিনিদ্র নগরী?কিভাবে চোখের নিমেষেই শেষ হয়ে যায় প্রায় এক বছর?কথিত আছে “দেয়ার ইস অলওয়েজ এ লাইট এট দি এন্ড ওফ দি টানেল”।তাই হয়তো এই দুর্বিসহ বছরের সমাপ্তিতে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরটায় আবার জ্বলে ওঠে হাজার আলো।ভালো না থাকার হতাশাগুলোতে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় মানুষের,তখন আবার জংধরা বর্মগুলোতে,আসমানী রং লাগে।ফলকালারের পাতার রংয়ের সাথেই এবার এই দেশটায় রং বদলেছিলো সিংহাসন।মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের হীমশীতল সফেদ ক্যানভাসে যেনো একঝলক আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিলো কমলা।তখন থেকেই আতসবাজির আড়ালে আবারো জন্ম নেয় প্রত্যাবর্তনের আশা।হ্যারি,পিটার,কেটের সাথে ফারহাদ,অগ্নিরাও অংশ নেয় রংবদলের আয়োজনে।বিভেদ ঘুচিয়ে আলোর দ্যুতিতে একসাথে আসার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় রাজসিংহাসন।


কিন্তু যে বছরটা কেড়ে নিয়েছে অনেককিছু,সেখানে কি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে নিউইয়র্ক?হাডসনের এদিকে দাঁড়িয়ে,নিউজার্সি থেকে যতোবার দেখেছি শহরটাকে,বুকটা মুঁচড়ে উঠেছে মরিয়া আবেদনে,”জেগে ওঠো নিউইয়র্ক”।কিন্তু বারবার পরাস্ত হয়েছি সংক্রমণের ঊর্ধ্বগামী গ্রাফের কাছে।যেনো সাদা চাদরে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে কেউ শহরটাকে,আফিমের নেশায় চোখ বুজেছে প্রাণ।দেখে মনে হয়েছে প্রাণহীন শহুরে রাস্তার সোডিয়াম লাইটে যেনো দুর্ধর্ষ বাস্তবতায় এক চিলতে আলো দিয়ে মিটমিট করে জ্বলছে জোনাকির শরীর।
পেরিয়ে গেছে ন’টা মাস।জানা হয়নি কতোটা ফুল ফুটেছিলো এবার সেন্ট্রাল পার্কে,কতোটা রং এঁকেছিলো ব্রুকলিন ব্রিজের পাশে সবুজ পাতাগুলো।কিন্তু “থ্যাংক্স গিভিংয়ের” উপাসনায় আবারো যেনো সেজে ওঠে গোটা শহরটা।ফুল ফুটুক না ফুটুক বসন্ত আসে চাদরমুড়ি দেওয়া ঊষ্ণতার আবেশ জড়িয়ে।নিউইয়র্কের ঘরের কাচের জানলার বাইরে চোখ রাখে জুলিয়ন আর ক্যাথি।সদ্য ফায়ারপ্লেস পরিস্কার করে তাতে সুগন্ধি কাঠ সাজাচ্ছিলো তারা।হঠাৎ আলোর ছটায় চোখ ধাধিয়ে উঠতেই জানলা দিয়ে তারা দেখতে পায় হাজারবাতির ফানুস ওড়ে হাডসন ইয়ার্ডের “ভেসেল”-এ।তাহলে কি এবারও উপহার আসবে সুদূর উত্তর মেরুতে অবস্থিত এক চিরতুষারাবৃত দেশ থেকে?আলোরমালায় সাজানো এবার নিউইয়র্কের এই শপিং সেন্টার,ভেসেল।ঝলমলে দ্যুতিতে আরেকবার শহরটা যেনো চেষ্টা করছে শিরদাড়া খাঁড়া করে দাঁড়ানোর।এই রাস্তায়,রাত একটায়,পথ হেঁটেছি অনেকবার কিন্তু এতো শুনশান দেখিনি শহরটাকে আগে কখনও।ভেসেলের সামনে আসতেই যেনো অতীত খুঁড়ে বেরিয়ে আসে নিউইয়র্ক।

আলোর সামনে সোশ্যাল ডিসটেনসিং মেনে জড়ো হয়েছে গুটিকয়েক হাইস্কুল বা কলেজ পড়ুয়ার দল।পোশাকে,অলংকারে সেই নিউইয়র্কের গ্ল্যাম এন্ড গিটার কিন্তু এখন তার সাথে যোগ হয়েছে “গ্লিটার মাস্ক”।ছবি তুলে “লাইভ” চলে যাচ্ছে তারা গোটা পৃথিবীর সামনে।কিন্তু “লাইফ” সুরক্ষিত তো এভাবে?হাওয়ায় উড়িয়ে দিতেই হয় মনখারাপগুলো কিন্তু বাস্তব উপেক্ষা করে নয়।এই নক্ষত্রখচিত আলোর ব্যোমযান যেনো টেনে সরিয়ে দিতে চাইছে নিদ্রার সাদা চাদরটাকে।আরেকবার মনে করাচ্ছে “দি সিটি হুইচ নেভার স্লিপ”-এর লোককাহিনী।
ঘড়িতে তখন রাত দুটো আলোকসজ্জিত হাডসন ইয়ার্ডের রাস্তা পেরিয়ে গাড়ী গিয়ে দাঁড়ালো “রেড স্টেয়ার্স”-এর সামনে।সময়টা যেনো থমকে গেছে টাইমস্কয়ারে।এই দেশটা যখন তাদের সবথেকে বড়ো উৎসব পালন করতে হাত মেলায় একে ওপরের সাথে,সেই ডিসেম্বরে, যেনো খাখা করছে শহরের প্রাণকেন্দ্র।অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে তখনও মেঘ সরে আলোর প্রতীক্ষা করছে আকাশচুম্বী স্কাইলাইনার।

পরেরদিন যেনো হাল্কা আলোর রশ্মি দেখা যায় মেঘের আড়াল থেকে।নিউজার্সির বাড়িতে সেজে উঠছে ক্রিসমাস ট্রি।দরজার কাঁচে লাল-সবুজ ক্রিসমাস “ঋথ” লাগাতে গিয়ে চমকে ওঠে বয়স্ক থমাস দম্পতি।
এলফ ও তার স্লেজগাড়ির বাহক বলগাহরিণগুলো চকিতে কি সরে গেলো তাদের পাশ কাটিয়ে।মিসেস থমাস বলে ওঠেন,”ও তোমার চোখের ভুল,পেছনের জঙ্গল থেকে আবার বোধহয় এসছে হরিণছানার দল”।
ফোন বাজে তখুনি।ওপারে নিউইয়র্কের ডরমেটরি থেকে উৎসাহিত ছেলের গলা,”ক্রিসমাস ট্রি ইস আপ ইন রকাফেলার”!
বিশ্বের সবথেকে আলোচ্য এবং বিখ্যাত ক্রিসমাস ট্রি এবারো সেজেছে আলোর দ্যুতিতে।কিন্তু সারারাত না,সন্ধ্যে ছটা থেকে ঘড়ির কাটা বারোটায় পৌঁছনোর আগেই নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার আলো। “সেফটি প্রোটোকল” মেনে বারণ এবার মানুষের প্রবেশাধিকার।ক্রিসমাস ট্রিক  পাতার আড়ালে হুতোমপেঁচা নজর রাখছে যাতে এবার মানুষের ঢল না নামে এখানে।প্রত্যেকবারের ঐতিহ্য মেনে এবারও,অস্টআশিতম বছরেও,পঁচাত্তর ফুট এই ক্রিসমাস ট্রিতে লাগানো হয়েছে পঞ্চাশহাজার এল.ই.ডি লাইট।রকাফেলার,নিউইয়র্কের বড়দিনের জনসমুদ্র বোধহয় হার মানায় কলকাতার পুজোর ভিড়কেও  কিন্তু এবার পুরোটাই ভার্চুয়াল।লাইভ “এন.বি.সি” চানেলে সরাসরি সম্প্রচার হবে “বড়োদিনের উৎসব” যেখানে নিজেদের সুরের দক্ষতায়,কথার জাদুতে উৎসবের আমেজ এনে দেবেন “রেডিও সিটি রকেটিস”,ডলি পার্টন,জয়েন স্টেফানি এবং আরো অনেক তাবড় নক্ষত্রেরা।কে বলে নিউইয়র্ক পারে না?আলবাৎ পারে কারণ এই শহরটাতেই যে তৈরি হয় প্রথম মন্দ-ভালোর উপাখ্যান,এই শহরটাই শেখায় পথ চলা। “দি রিংক এট রকাফেলার” খোলা থাকলেও মানুষ এখনও শহরটার বাতাসে নিশ্বাস নিতে ভয় পাচ্ছে।সংক্রমণের গ্রাফ আবারও ঊর্ধ্বগামী ।কিন্তু তবুও গাড়ীর চার দেওয়ালে নিজেকে বদ্ধ রেখে অনেকেই যাচ্ছে ডিসেম্বরের নিউইয়র্ক দেখতে।খাখা উদ্যানে হয়তো কোথাও দেখা মিলছে আশার আলোর। “হলিডে স্পিরিটে” এবার হয়তো বন্ধু-পরিবার সমন্বয়ে পার্টি নেই কোথাও,কিন্তু “হলিডে লাইটসে” অবশ্যই আশ্বাস আছে উজ্জ্বল ভবিষ্যত্বের,হার না মানার আর সুরক্ষিত থাকার।ছোটদের জন্য শুধু না, এবার লাল আলখাল্লায় সান্তাক্লজ আসছে বিশের বিষ দূর করতে।এটাই চাই “সিক্রেট সান্টা গিফ্ট” এবছর।
নিউইয়র্কের হলিডে লাইটসে একটাই বার্তা “আমি উঠব আবার জ্বলে,আমার আপন শক্তি বলে।আধারকে হার মানিয়ে,আমি আলোর পাহাড় নিয়ে ফিরব,এই শহরের বুকে।”

কিন্তু কেমন আছে শহরতলি?ঘরবন্দি জীবন থেকে দৈনন্দিন জীবনে কি সেজে উঠছে কিথ আর ক্যারোলের সংসার?শহরতলির খবর তো লাইমলাইট পায়না সবসময়।অথচ সেখানেই গল্প তৈরি হয় আমার-আপনার।হলিডে লাইটসে কি ধরা পড়ে কলকাতার পার্কস্ট্রীট?হলিডে স্পিরিট কি শুধুই একদিন না পাইন বা ফিরের মৃদুতাপ, হোয়াইট ক্রিসমাসের হীমশীতল গহ্বর থেকে ঊষ্ণতা এনে দিতে পারে সাধারণের লিভিংরুমে?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।