ক্যাফে গদ্যে সুস্মিতা রায়চৌধুরী (নিউজার্সি)

নারীতে কালী

~চোখদুটি রক্তপিঙ্গল বর্ণের। চুলগুলি আলুলায়িত, দেহটি শুকনো ও ভয়ংকর, বাঁ-হাতে মদ ও মাংসে ভরা পানপাত্র, ডান হাতে সদ্য কাটা মানুষের মাথা। দেবী হাস্যমুখে আমমাংস খাচ্ছেন। তাঁর গায়ে নানারকম অলংকার থাকলেও, তিনি উলঙ্গ এবং মদ্যপান করে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন।~
ছি ছি,এ কেমন নারী!!
কয়েকদিন আগেই লক্ষীমন্ত হয়ে মুখে রা না কাটা মেয়েটার আজ হলো কি…!!
নিশ্চুপ পদচারণায় ভাড়ার পূর্ণ করা শ্রীময়ীর আজ একি রুদ্র রূপ!
“জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোঽস্তুতে”..আজ দ্বীপান্বিতা কালির আবির্ভাব ধরাধামে।
তাই পৃথিবী সেজেছে আলোর ঝংকারে,নারী সেজেছে রণচন্ডী রুপে ।
স্বামীর বুকের ওপর পা রেখে উলঙ্গ তান্ডবে জীভ কাটলেও,লজ্জাবস্ত্রকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন যে নারী থুরি দেবী তার “কালী” হওয়াই সাজে।আহা কালো মেয়ে না হলে কি এলোকেশী রূপের ছটায় ভুবন আলো করা যায়,চিতা ভস্ম মেখে কি তোলপাড় করা যায় ভুবন….”কালো,তা সে যতই কালো হোক,দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ”।
কালীমূর্তি বর্ণনায় মনে ভেসে ওঠে শ্বশুর কালীকিঙ্করের অপ্রকৃতিস্থ’ দয়াময়ীর “প্রতিস্থাপন”অর্থাৎ নববধূর মধ্যে দেবীসত্তার নির্মাণ।সত্যজিৎ এর দেবী ব্যাখ্যা..
চেতনায় দামিনী, পটের শ্যামা, বিপ্লবী বাংলার মুখ যেন জাহ্নবীর তীরে।আমাদের স্মৃতিতে,ঐতিহ্যে,পুরাণে,যা কিছু ঘন যামিনী,তা আধুনিকতার আলোতে নিজেকে পুনর্বিবেচনা করায় শ্যামা মা।
একে তবে কী বলব?দেখার রকমফের নাকি দেখার আশ্চর্য সমাপতন যেখানে বঙ্গীয় যুক্তিবাদ ও আলোকপ্রাপ্তি বিষয়ে আমাদের নানা দ্বিধা, অস্বস্তি ও সংশয় এক নিমেষে নেয় এক নতুন মোড়।পুজিত হয় “কালো”।পুজিত হয় রুদ্রাণী মত্ত অনাবৃতা এক নারী..।।
তাহলে কি শেষ হতে পারে না “লক্ষীশ্রী”র খোঁজ?দ্বীপান্বিতায় তো স্বয়ং মা লক্ষীর সামনে জ্বলে ওঠে আতশবাজি।
বন্ধ হবে কি ফর্সা মুখশ্রীর বিজ্ঞাপন?
শেষ হতে পারে কি সুন্দরী হওয়ার “নিপুণ” সংজ্ঞা?
“ভালো” হওয়ার তকমায় কি জায়গা করে নিতে পারে “অন্যরকম আনকনভেনশনাল”?
সংসার সুখের হয় দম্পতির গুণে..জন্ম নিতে পারে কি এই নতুন গল্প?
ধ্বংস খন্ডিত হতে পারে কি কন্যা-ভ্রুণ হত্যা,শরীর ভোগের স্বাধীনতা,এ্যাসিড-কিলিং,পণ-প্রথা,সামাজিক বলপুর্বক মাতৃত্ব?
জন্ম নিতে পারে কি দ্রব্যের ঊর্ধে নারীকে সুশীল সাজিয়ে না রেখে সাধারণ মানুষ ভাবা?
প্রশ্ন ফানুসের মতন উড়ছে আকাশে।
কিন্ত প্রদীপের নীচে অবস্থান করে কুসংস্কারজনিত অন্ধকার আজও,
“নারীবলি” হয় দেবীর….!!
কিন্ত না,গর্জে তো উঠতেই হবে বারবার,প্রতিবার….আমাকে,আপনাকে।
আমার কালী,এক প্রলয়রূপী বোধ-বুদ্ধি-বিশ্বাস।
খড়্গ হাতে মৃত্তিকা প্রাণ পায় নারী দেহে,অশুভের নাশ করে।
আমার ভদ্রকালী বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে পাড়ায় দাড়িয়ে গল্প করে।
আমার ধণকালিকা ওফিসের কাজে লেট হয়ে রাতে বাড়ি ফেরে।
আমার সিদ্ধিকালী হঠাৎ ফস্ করে সিগারেট জ্বালিয়েও,নিভিয়ে দেয় তাচ্ছিল্যে।
আমার যমকালী অমাবশ্যার তৃতীয় চাঁদ।
আমার রক্তকালী অবলা নয়,নির্ভয়া।
আমার কালাগ্নিরুদ্রকালী ইচ্ছেপুরণের চাবিকাঠী……..
চোদ্দ প্রদীপে দূর হোক অসৎ উদ্দেশ্য,অবক্ষয়ী,সংস্কারপন্থী রক্ষণশীল ভূত!!
আনন্দময়ী মা শ্যামাকে বরণ করি পুষ্পসজ্জায়…
শুধু শব্দটা খানিক নিয়ন্ত্রণে রাখলেই কাজটা বেশী হবে,সে আতশবাজি হোক বা ঢপবাজি!
“আগে যায় বীর্য-পরিচয় পতাকা-নিচয়, দণ্ডে ঝরে রক্তধারা।
সঙ্গে সঙ্গে পদাতিকদল, বন্দুক প্রবল, বীরমদে মাতোয়ারা॥
ঐ পড়ে বীর ধ্বজাধারী, অন্য বীর তারি ধ্বজা লয়ে আগে চলে।
তলে তার ঢের হয়ে যায় মৃত বীরকায়, তবু পিছে নাহি টলে॥
পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার, সদা পরাজয় তাহা না ডরাক তোমা।
চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান, হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা॥”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।