কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) শম্পা রায় বোস

প্রথমেই বলেছিলুম এবারের পুরী ভ্রমণ,, জগন্নাথ দর্শন একেবারে অন্যরকম। আজ তৃতীয় পর্বে আমি কিভাবে তাঁকে অনুভব করি,, সেটাই বলার চেষ্টা করেছি। জয় জগন্নাথ ❤️

এবারের পুরী ভ্রমণ ৩:

ভগবান দর্শনের জন্য টিকিট বা হোটেল বুকিং করা থাকলে আমার মনটা খুব ভালো থাকে দিনগুলো সুন্দর ভাবে কাটিয়ে দিই। আগে সবসময় বাবা মা ভাই এর জন্য এত মন খারাপ থাকতো যে বড্ডো ডিপ্রেশনে কাটত আমার সেই সময়ের জীবন। শুধু দিন রাত ঘন্টার হিসেব করতাম।
একদিন দুপুরে আমি একা ঘরে খুব কান্নাকাটি করছি। মেয়েরা স্কুলে, সিংহ অফিসে। এত কাঁদছি এত কাঁদছি,,, কাঁদতে কাঁদতে খুব হাঁপিয়ে উঠেছি খুব ক্লান্ত লাগছে মনে হচ্ছে কত যেন পরিশ্রম করেছি।
ঠিক সেই সময় আমি আমার জগুদাদাকে বললুম আর তো পারছি না ঠাকুর এভাবে কি বাঁচা যায়? ওদেরকে হারানোর কষ্টে আমার বর্তমান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাকে তো মেয়েদের জন্য বাঁচতে হবে কিন্তু এভাবে তো বাঁচা যাচ্ছে না আর। কি করব? কিভাবে কাটিয়ে উঠব এই শোক?

ভগবান পথ দেখিয়ে ছিলেন। কিভাবে যেন সে বছর ঠিক হল পুরী যাওয়া হবে মাত্র এক দিনের জন্য। দীর্ঘ বারো বছর পর পুরী যাব সে যে কী আনন্দ কী আনন্দ বলে বোঝাতে পারব না। এই বারো বছর আমি অনেক চেষ্টা করেও পুরী যেতে পারি নি। সব জায়গায় যাওয়া হচ্ছে কিন্তু পুরী যাওয়া আর হচ্ছে না। তো যাইহোক ২০০৯ সালের মে জুন, ডেট টা ঠিক মনে পড়ছে না গেলাম পুরী।
সেই যে দর্শন হলো আমার। জীবনের যত কষ্ট যত যন্ত্রণা যত দুঃখ সব তাঁকে বলে তাঁকে দিয়ে আমি যে কী হালকা হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না।

ভগবান বলছেন ‘আমাকে বিশ্বাস করো ভক্তি করো। অবিশ্বাস করেও বিশ্বাস করো।’
কিন্তু ভগবান কে বিশ্বাস করো বললেই কী বিশ্বাস করা যায় অত সহজেই? সংসারি মানুষ ছেলেপুলে স্বামী শ্বশুর বাড়ি বাপের বাড়ি এসব নিয়েই তো জীবন। এইসব নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় থাকব না? সবসময় তো তাদের নিয়েই আমাদের চিন্তা ভাবনা তাদের নিয়েই তো বেঁচে থাকা। কিন্তু সেসব চিন্তা সব তাঁর কাছে সমর্পণ করলে আমি তাহলে কী করব,, কী চিন্তা করব কী ই বা ভাবব। কি নিয়ে থাকব!
আমি তো সংসারি মানুষ সংসার করতেই তো আসা এই পৃথিবীতে। কত প্রশ্ন আমার! ভগবান বলেন কী! চিন্তা করব না? আমি কি তবে সন্ন্যাসী হব?
###
পড়তে শুরু করলাম ভগবৎ গীতা। সব প্রশ্নের উত্তর সেখানে। তাই পড়তে শুরু করলাম একটু একটু করে।
একদিন দেখি শাশুড়ির ঘরে রেডিও তে নাটক হচ্ছে কানে এলো কথাটা যেখানে বিলে মানে স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন মা ভক্তি দাও জ্ঞান দাও। মাথার মধ্যে যেন কারেন্ট পাস করল ,,,তাইতো স্বামী বিবেকানন্দ তো ঠাকুরের কাছে ভক্তি চেয়েছেন বিশ্বাস চেয়েছেন,,,পেয়েওছেন। তাহলে আমি চাইলেও পাব। কেন পাব না তিনি যদি পান আমিও পাব। নিশ্চয়ই পাব।
তবে হ্যাঁ চাওয়ার মতো করে চাইতে হবে। সে চাওয়ায় জোর থাকবে ভালোবাসা থাকবে থাকবে বিশ্বাস থাকবে বায়না চোখের জল। ছোটবেলায় একটা খেলনার জন্য মায়ের কাছে যেমন করে বায়না করতাম। মেয়ে পুতুলের বিয়ে দিয়ে কান্নাকাটি করে আর একটা মেয়ে পুতুল বায়না করে বানিয়ে নিতাম মাকে দিয়ে সেরকম চাওয়া।
আজ মহাপ্রভুর কাছে সমস্ত কিছু দিয়ে এই যে আমি পরমানন্দে হেসে খেলে ঘুরছি বেড়াচ্ছি। এ এক দিনে হয় নি । দিনের পর দিন তাঁর কাছে বিশ্বাস চেয়েছি ভক্তি চেয়েছি।
আমি তো অতি তুচ্ছ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম এক জীব। আমার কী আছে? কিচ্ছু নেই। তাঁকে বিশ্বাস করতে হলে সেই বিশ্বাস টাও তো চাইতে হবে আমায়। তাঁর দয়া হলে তবেই তিনি সেই বিশ্বাস দেবেন ভক্তি দেবেন।
সবাই কী মহাপ্রভুকে বিশ্বাস করেন,, ভগবান বলে মানেন? না করেন না। আমার নিজের চোখে দেখা।
২০১৫ সালে আমরা অনেকজন পুরী গিয়েছিলাম সেখানে এক বান্ধবীর শাশুড়ি মাকে বললাম মাসিমা জগন্নাথ দর্শনে কখন যাবেন? উত্তরে উনি বলেছিলেন আমি তো জগন্নাথ দর্শনে আসি নি আমি তো সমুদ্র এনজয় করতে এসেছি। উনি পুরীতে বসে একথা বলেছিলেন ভাবা যায়? সবচেয়ে বড়ো কথা উনি দর্শন না করেই ফিরে গিয়েছিলেন।

ঐ ঘটনার পর আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল ভক্তিটা আসলে তিনিই দেন। বিশ্বাস নির্ভরতা সেটাও উনিই দেন । এই যে তাঁর প্রতি এমন টান , তাঁর চোখের দিকে তাকালে জলে ভরে ওঠে আমার দুচোখ,এই যে তাঁর কথা লিখতে লিখতে তাঁর জন্য কষ্ট হচ্ছে মনে হচ্ছে ও বাবা একটা সপ্তাহ হয়ে গেল দেখা হয় নি ওনার সঙ্গে!,,,এই যে তাঁর প্রতি একটা অসম্ভব রকমের মায়া,, তাঁকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট তাকে দেখার উন্মাদনা দেখতে দেখতে সব ভুলে শুধু কেঁদেই যাওয়া কেঁদেই যাওয়া,জগৎ সংসার ভুলে কেমন একটা পাগল পাগল অবস্থা হওয়া এও তাঁরই দেওয়া তাঁরই দয়ায়।
তিনিই টানছেন তাঁর কাছে,,, তাঁর দিকে,,আবার আমিও যে টানছি আমার দিকে সেই টানটাও তিনিই দিচ্ছেন তাই তো টানতে পারছি। আবার তাঁর টানে এই যে হুড়মুড়িয়ে চলে যাওয়া সব ছেড়েছুঁড়ে এটাও তাঁরই দয়ায় তাঁরই টানে।
যেমন রাখছেন তেমনি থাকছি যেমন নাচাচ্ছেন তেমন ভাবেই নাচছি। দুমাস তিনমাস অন্তর তাঁর কাছে ছুটে ছুটে যাওয়া,, অন্য কত জায়গায় তো যাওয়া যেত। নতুন নতুন দেশ দেখা হত কিন্তু কিছুতেই মন মানে না, কোথাও যেতেই ইচ্ছে করে না। শুধু মনে হয় এই তো ছোট্ট জীবন রোগ ভোগ বাদ দিয়ে কতদিনই বা আর হাতে আছে যেটুকু দিন আছে যেটুকু দিন পাচ্ছি লুটে পুটে চেটেপুটে তাঁর সঙ্গ উপভোগ করি। এই যে দেখার জন্য আঁকুপাঁকু অবস্থা ,,, এ সবই তাঁরই দয়ায়। তিনিই করেন সব,, তিনিই করাচ্ছেন তাই করছি,, তাই করতে পারছি,,এ বিশ্বাস তিনিই দিয়েছেন আমাকে। দিনের পর দিন আমি চেয়েছি তাঁর কাছে এমন বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস এই টান এই অনুভূতি দেওয়ার মতো তিনি আমাকে যোগ্য মনে করেছেন বলে আমি তাঁর কাছে কৃতার্থ আমি কৃতজ্ঞ আমি ধন্য।

আমি যতবার মহাপ্রভুর কাছে যাই ততবারই তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। তাঁর কুশল জানতে চেষ্টা করি, ভালো করে অনুভব করতে চেষ্টা করি,,, ভালো করে দেখে ভাবি একটু কি রোগা রোগা লাগছে? জিজ্ঞেস করি ভোগ ঠিকঠাক হচ্ছে তো ঠাকুর ,, তাঁকে রাখা হচ্ছে তো রাজার মতো, তিনি ভালো আছেন তো,, তাঁর মন ভালো আছে? জগৎ সংসারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে হাঁপিয়ে উঠছেন না তো,, সারাক্ষণ তাকিয়ে আছেন চোখ ব্যথা করছে না? চোখে কর্পূর দেওয়া হচ্ছে ঠিক করে? সব শেষে বলি ভালো থেকো তুমি সুস্থ থেকো। সবাইকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিয়েছো শরীরের যত্ন নিও।
কত প্রশ্ন থাকে আমার!

ঐ ঠেলাঠেলি ভীড়ের মধ্যে এত কথা এত ভাব বিনিময় সারতে হয় আমায়। ঐ দশ মিনিটের মধ্যে তাঁর সাজগোজ তাঁর পরিপাটি তাঁর পরিপূর্ণতায় আমি অনুভব করি সেদিন ঠাকুরে মুড কেমন।

এতটুকু বানিয়ে বলছি না। যা অনুভব করি তাইই বলছি। মাথার টিকলি, নাকের ব্যাসর, ফুলের মুকুট গলায় রঙ বেরঙের ফুলের মালা তাঁর বিভিন্ন রঙের ধুতি চাদর সবকিছুই দেখি। কারণ আমার মনে হয় তিনি আমাদের জন্যই এত পরিপাটি সাজগোজ করেন। বাড়িতে কোন গেস্ট আসলে আমরা যেমন পরিপাটি থাকি, ঠিক তেমন। আমি সব দেখি দুচোখ ভরে দেখি। এত ভালো লাগে আমার ,,,,

নিজেকে মহান প্রমাণ করতে আমি এসব বলছি তা নয়। আমার মহাপ্রভুর কথা বলতে ভালো লাগে ভাবতে ভালো লাগে লিখতে ভালো লাগে তাই বলছি। কে আমার লেখা পড়ল কে পড়ল না আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। এই যে আমি তাঁর কথা এতক্ষণ ধরে বলতে পারলাম এতে যে কী শান্তি হল,, মনটা যে কী ভালো হয়ে গেল তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। মহাপ্রভুকে নিয়ে আমার অনুভূতি তাই রয়ে যাক আমার দেওয়ালে। আমি থাকব না কিন্তু এ অনুভূতি ,,,এ লেখা তো থেকে যাবে। এইই অনেক আমার কাছে।

তো যা বলছিলাম,,,ডাক্তার বাবুকে টাটা করে বাড়ি এসে ভাবলাম অনেক্ষণ। টিকিট ক্যানসেল না করে পুরী যাওয়ার সিদ্ধান্তটা ঠিক নিচ্ছি তো? তারপর মহাপ্রভুর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম যেমন ভাবাচ্ছ তেমনই ভাবছি ঠাকুর,,,, জয় জগন্নাথ ❤️

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *