গল্পেরা জোনাকি তে মাসের ধারাবাহিক গল্পে সবিতা রায় বিশ্বাস

জোড়া ‘S’ এর কৌশলে বন্দী প্রভঞ্জন

(১)

বেশ কিছুদিন ধরে পেপার খুললেই চোখে পড়ছে মৃত্যুর খবর| হয় মধ্যরাতে ইয়ং ছেলেরা ড্রিংক করে মোটরসাইকেল রেস করতে গিয়ে যে কোনো সেতুতে অন্য গাড়ির সাথে ধাক্কা মারছে অথবা সেতুর পোস্টের সাথে ধাক্কা মেরে স্পট ডেড হচ্ছে| আর মোবাইল চোর হিসেবে কাউকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে পাবলিক মেরে ফেলছে| সম্পত্তি নিয়ে বিবাদে নিজের ভাইয়ের বাচ্চাকে গলা টিপে মেরে সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দিচ্ছে| খুন তো হামেশাই ঘটছে, কিছু বয়স্ক মানুষ আছেন যাদের নিজের বাড়ি আছে, তাদের তো বিশাল বিপদ| শেষ জীবনে নিজের ঘাম-রক্ত জল করা গাছপালায় সাজানো বাড়ি তুলে দিতে হবে প্রমোটরের হাতে, নাহলে পচা গন্ধ বেরোনোর আগে পর্যন্ত কেউ জানতেই পারবেনা অতি সজ্জন ভালো মানুষটা খুন হয়ে গিয়েছেন| আর মেয়েদের তো কোনো নিরাপত্তাই নেই, ওসব কথা মনে আনতেও গা ঘিনঘিন করে| কিন্তু বাচ্চা মেয়েগুলোকেও ছাড়ছে না এরা, এমনকি প্রাণটাও কেড়ে নিচ্ছে| সীমাহীন নিষ্ঠুরতা পুরো সমাজটাকেই পিশাচে পরিণত করছে|

সপ্তর্ষির বাবা বিভাসবাবু তো ওকেই দোষ দেন, “পুলিস ডিপার্টমেন্টে ঘুণ ধরে গিয়েছে, নাহলে দিনে-দুপুরে এইভাবে মানুষগুলো খুন করে চলে যাচ্ছে আর তোরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিস! আজকের খবরটা পড়ে আমি তাজ্জব বনে গিয়েছি, হুমায়ুন ইসলাম ভদ্রলোক অতি সুনামের সঙ্গে ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট থেকে তিন মাস আগে অবসর নিয়েছিলেন! ছেলের সাথে এই বাড়ি-বাগান নিয়ে মতবিরোধ হওয়ায় ছেলে রাগ করে কাতার চলে যায়| কিন্তু পুত্রবধূ বাউন্ডুলে ছেলের সাথে যায়নি, তার ছোট্ট কন্যাকে নিয়ে এখানেই আছে| আসলে হুমায়ূন সাহেব বাইরে নজর দিতে গিয়ে ছেলের দিকে নজর দেননি, তার ফল ভুগতে হচ্ছে এখন| এই ছেলের অত্যাচারেই ওনার স্ত্রী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান”|

এই সময় সপ্তর্ষির মা নিবেদিতা ঠক্ করে চায়ের কাপ টেবলে রেখে বললেন, “তোমার চাকরি ছিল, আমরা শান্তিতে ছিলাম| এখন সারাদিন বাড়িতে থেকে সবার পিছনে লাগাই তোমার কাজ| সপুর কত কাজের স্ট্রেস সেসব বুঝতেও চাওনা| তোমার কথা শুনে মনে হয় পুরো ডিপার্টমেন্ট ও দত্তক নিয়েছে, তাই যেখানে যত ক্রাইম হবে সব দেখভাল ওই করবে আর গুন্ডা-বদমাস-খুনীদের ধরে ধরে থলেয় পূরবে| জ্বালিয়ে খেলেন প্রফেসর সাহেব!” গজগজ করতে করতে নিবেদিতা রান্নার মাসিকে নির্দেশ দিতে চলে গেলেন|

বাবার মুখের উপর কোনো কথা বলার স্বভাব কোনোদিনই ছিলনা সপ্তর্ষির, আর এখন তো এসব ওর ভাবনার বাইরে| অফিসের গাড়ি আসতেই মা-বাবাকে বলে বেরিয়ে গেল, ‘মেরিডিয়ান স্প্লেনডোরা’ হাউজিং কমপ্লেক্স থেকে সৌমিলিকে তুলবে| মাস দুই হল এখানে শিফ্ট করেছে সৌমিলিরা| দমদম স্টেশনের কাছের এই এলাকা বছর কয়েকের মধ্যে প্রমোটরের কব্জায় এসে হাইফাই কমপ্লেক্স হয়েছে, হচ্ছে| যার ফলে এই ধরণের মার্ডার কেস ঘটছে, এই কেসটাও বীরপাড়া এলাকাতেই| স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশের নামে বদনাম রটবেই| আর যেখানে নিহত ব্যক্তি একজন সৎ পুলিস অফিসার ছিলেন| তার খুনীকে ধরতে না পারলে বদনাম রটবেই, ওনাদের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? সত্যি কথাটা সকলেই জানে, এক শ্রেণীর পুলিস-প্রশাসনের উচ্চপদের লোকজন যুক্ত আছে বলেই মাফিয়া, প্রমোটর যা খুশি করতে পারছে| তবে এই কেসটায় এবার জোড়া ‘s’ এর ফলা থেকে মাফিয়াদের নিস্তার পাওয়া কঠিন হবে|

যদিও এই কেসটা সপ্তর্ষি আর সৌমিলির হাতে আসার কোনো চান্সই ছিলনা, কিন্তু বস মিস্টার বর্মণ অনেকদিন ধরেই লোকাল থানার ও. সি প্রভঞ্জন মাইতির কার্যকলাপে বিরক্ত| এবারও এই কেসে খুন হতে না হতেই এক্স অফিসার হুমায়ুন ইসলামের খুনিকে হাতেনাতে ধরে লক আপে পুরে ফেলেছেন মিস্টার প্রভঞ্জন| শুধু তাই নয় সৌমিলিরা গিয়ে দেখলো যেখানে খুন হয়েছিল সেই ঘর একেবারে সাফ-সুতরো করে লোকাল থানার ও সি র নির্দেশে তালাবন্ধ, এমনকি ওই বাড়ির পাশের কবরস্থানে বডি রাতেই দাফন করাও হয়ে গিয়েছে|

সৌমিলি হুমায়ূন সাহেবের বৌমা পরভীনকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি তো বলছেন, বাড়িতেই ছিলেন তাহলে খুন হতে নিশ্চয় দেখেছেন| আপনি বাধা দিলেন না কেন?”

“আমি রান্নাঘরে আমার মেয়ে শবনমকে গল্প বলে খাওয়াচ্ছিলাম, তার আগে দেখে গিয়েছিলাম আমার শ্বশুর তার ভাতিজা মনিরুলের সাথে জমিজমা সংক্রান্ত কথা বলছিলেন| সকলেই জানত মনিরুল খুবই ভালো ছেলে, ও যে এই কাজ করবে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি|”

সপ্তর্ষি জানতে চাইল, “আপনি কি কোনো শব্দ শুনে এসেছিলেন? এসে কি দেখলেন?”

“হ্যাঁ, মানে মরিয়ম আমার কাজের মেয়েটা চা দিতে এসে দেখে মনিরুল শ্বশুরকে জবাই করছে| ওর চীত্কার শুনে আমি ছুটে এসে ওই দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম, মরিয়ম আমাকে বলল, থানার ও সি মিস্টার মাইতিকে ফোন করতে| সেই মত আমি ফোন করে ওনাকে ডাকি”|

আচ্ছা আপনার কাজের মেয়েটা তো খুব বুদ্ধিমতী| মরিয়মকে একটু ডাকুন, ওর সঙ্গে কথা বলি”|

“সরি, আজ সকালেই মরিয়ম ওর বাড়ি মোল্লাখালী চলে গিয়েছ্রে|

ও সি স্যার ওকে পারমিশন দিয়েছেন”|

“ও সি প্রভঞ্জন মাইতি কি এই বাড়িতে আসতেন? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওনার সঙ্গে আপনাদের পরিবারের খুব ভালো সম্পর্ক!”

“একদম ঠিক ধরেছেন, মিস্টার মাইতি আমার শ্বশুর মশাইকে খুব শ্রদ্ধা করতেন| অনেক পরামর্শ নিতেন ওনার কাছ থেকে| আমাদের পরিবারের শুভাকাঙ্খী, উনি খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে না এলে ভিকটিম পালিয়ে যেত, তখন আমার ঘাড়েই সব দোষ পড়ত| উনি সাক্ষাত ফেরেশতা|”

“একটা কথা, হুমায়ুন সাহেবের কি অনেক সম্পত্তি?”

“হ্যাঁ, এই বাড়িটার জমি তো তিন বিঘার বেশি হবে, তাছাড়া অন্য আরো কয়েকটি জায়গায় জমি-বাড়ি আছে, সবকিছুই ওনার ভাতিজা দেখাশোনা করে| আগে এই বাড়িতেই থাকতো, আমি আপত্তি করায় এখন অন্য জায়গায় থাকে”|

“আপনি কি নিশ্চিত ওই খুন করেছে?”

“এটা কি ধরণের প্রশ্ন? নিজের চোখে আমরা দেখেছি, ওর তো এই সম্পত্তির উপর লোভ ছিল| আরো একটা কথা, নিজের মুখে বলতে খারাপ লাগছে-আমার উপরেও কু-দৃষ্টি ছিল| সেকারণে মিস্টার মাইতি শ্বশুরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ওকে এখান থেকে সরিয়ে দিতে, এখনো পাশের ঘরে ওর জিনিসপত্র রয়ে গেছে| মাঝে মাঝে রাত্রে থেকে যায়, আসলে বাজার-টাজার করে| রাত্রে চিকেন রেজালা বা বিশেষ কোনো পদ রান্না করলে শ্বশুর বলেন খাওয়া-দাওয়া করে থেকে যেতে| কিন্তু সে যে এমন করবে ভাবতেই পারিনি|” (ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছলেন পরভীন)

সৌমিলি, সপ্তর্ষি ভেবেছিল যে ঘরে হুমায়ুন সাহেব খুন হয়েছেন সেটা একটু খুঁটিয়ে দেখবে কিন্তু এই মহিলা তো এমন নজরে রেখেছে এদিক-ওদিক তাকাতেও পারছে না| বারবার বলছে ছোট মেয়ে আছে কিন্তু তাকেও তো দেখা যাচ্ছেনা| শুধু বাইরের গেটে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে|

একটা ফোন কল আসায় পরভীন ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ভেতর দিকে উঠে যেতেই সপ্তর্ষিও ধাঁ করে উঠে অন্য একটা ঘরে ঢুকে পড়ল| আরে! এটা তাহলে বেডরুম! বেডের পাশে সাইড টেবিলে অ্যাশট্রে তো রয়েছেই, সেই সাথে মেয়েদের মাথার ক্লিপ| ঘরে ঢুকতেই স্মেল পেয়েছিল সপ্তর্ষি| গ্লাভস পরে টুক করে ‘ট্রেজারার’ এর খালি প্যাকেটটা পুরে নিল প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে|

এই সময়ই কথা বলতে বলতে পরভীন ঢুকলো এই ঘরে, সর্বনাশ! বাইরে থেকে লক করে দিলে ভেতর থেকে লোক খুলে বের হতে পারবে কিন্তু এই আলমারির পিছন ছাড়া এই ঘরে আর কোনো আড়াল নেই| সপ্তর্ষি খুব কষ্ট করে নিজেকে আড়াল করতে পারলেও বেশ কিছু ক্লু সপ্তর্ষির ‘দূরবীন আই’ থেকে আড়ালে থাকলোনা| আরো একটি কাজ খুব দ্রুত আর সন্তর্পণে করল|

পরভীন চলে যেতেই দ্রুততার সঙ্গে ছবি নিয়ে টুক করে বেরিয়ে সৌমিলির পাশে বসে পড়ল| প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকল হুমায়ূন সাহেবের বৌমা| একদম কাটছাঁট ভাবে বলল, আমি ভেবেছিলাম আপনারা নিজে থেকেই চলে যাবেন কিন্তু তার কোনো লক্ষণ দেখছিনা, তাই বাধ্য হয়ে হাতজোড় করে বলছি আপনারা আসুন|

সৌমিলি বলল, “আমরা তো ডিউটি করতেই এসেছি, নিশ্চয় আপনার সাথে গল্পগাছা করতে আসিনি| আপনার এলাকার ও সি মিস্টার মাইতির সাথে কথা বলে দেখতে পারেন| আপনি শোকাতুরা, এই সময়ে এত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল, ঠিক আছে আপনি রেস্ট করুন| জাস্ট একটা রিকোয়েস্ট করবো, কলকাতা শহরের মাঝে এতবড় বাগানবাড়ি আগে দেখিনি, ঐদিকে মনে হচ্ছে থাকবার ঘর আছে| আম-কাঁঠাল-লিচু প্রচুর ফলে বাগান আলো হয়ে আছে, যদি একটু যাবার অনুমতি দিতেন ম্যাডাম!”

সপ্তর্ষি বলল, “আপনার কাছে কেস হিস্ট্রি যা শুনলাম তা জলের মত পরিষ্কার, সেটা সলভ করে ফেলেছেন মিস্টার প্রভঞ্জন মাইতি| আমাদের হয়তো আর আসা হবেনা এখানে, অবশ্য কেস যখন পদ্মার পানির মত পরিষ্কার তখন তো আসার প্রশ্নই ওঠেনা| প্লিজ ম্যাডাম, না বলবেন না|”

পরভীন বলল, “আপনারা এত করে বলছেন! দাঁড়ান মিস্টার মাইতিকে একবার কল করি| উনি কেসটা দেখছেন, ওনার বিনা অনুমতিতে কিছু করা উচিত হবেনা|”

ভেতর থেকে ফোনে কথা সেরে এসে বলল, “বেশ যান, তবে একদম দেরী করবেন না| আমার শ্বশুর সকলকেই বাগানের ফল খাওয়াতেন কিন্তু এই শোকের মধ্যে কোনো আপ্যায়নই করতে পারলাম না আপনাদের| কাজের মেয়েটাও ভয় পেয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে, নাহলে!”

“না, না এই নিয়ে একদম হেজিটেট করবেন না| একটা কথা, আপনার মেয়েকেও তো দেখলাম না! ওকেও কি অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছেন? ভালোই করেছেন, ছোট বাচ্চা! চোখের সামনে মুরগী জবাই হতে দেখলে এখনো অস্বস্তি হয়, আর এ তো একটা আস্ত মানুষ! নিশ্চয় দাদাজানকে খুব ভালোবাসতো আপনার মেয়ে”|

আবারও ওড়না দিয়ে চোখ মুছে পরভীন বলল, “ওর দাদাজান ওকে ডাকতো পরী বলে| ওকে আমার এক খালার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি| যদিও মাইতি সাহেব বলেছেন, কেস জলের মত পরিষ্কার, চার্জশিট তৈরী হয়ে যাবে| উনি বলেছেন অন্য সাক্ষীর প্রয়োজন নেই, উনি নিজে আই উইটনেস| বিচারে ফাঁসি তো হবেই| তবুও চিন্তাতেই আছি, শত্রুর তো অভাব নেই| আমার নিজের স্বামী এই খবর পেলে এসে কি বলবে কে জানে! যাকগে আপনারা দশ মিনিটের মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে যান| মাইতি সাহেব বিশেষ কাজে এখানে আসছেন, উনি এসে আপনাদের দেখলে রেগে যেতে পারেন| যদিও আপনারা ভবানী ভবন থেকে পারমিসন নিয়ে এসেছেন, তবুও”-

“সপ্তর্ষি হঠাত্ একটা প্রশ্ন করল, আপনাদের বাড়িতে তো সিসিটিভি বসানো আছে দেখছি| ফুটেজটা দেখতে পেলে খুব ভালো হত”|

“সরি, বেশ কয়েকদিন ক্যামেরা খারাপ হয়ে আছে| এসব কাজগুলো মণিরুল করত, বলেছিল খবর দিয়েছে| এখন তো মনে হচ্ছে এইরকম একটা কাজ করবে বলেই নিজেই হয়তো সিস্টেম খারাপ করে রেখেছিল|

 

(ক্রমশ…)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।