সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ২)

কেল্লা নিজামতের পথে

রাত বাড়ছে। ধীরে ধীরে নেমে আসছে আরও অচেনা অন্ধকার। শহরটাও অচেনা হচ্ছে। থাকতে হবে কোথাও৷ মাথা গোঁজার ঠাঁই বড় জরুরী। হোটেল খুঁজছি আর ভাবছি, এই ঠাঁইটাই জরুরী ছিল মনসুর উল্ মুল্ক সিরাজউদ্দৌলা জং বাহাদুরেরও। দাদুর প্রাসাদ চেহেল সেতুনে আর মন টিকছে না৷ চাই নতুন বাড়ি৷ একেবারে নিজের বাড়ি৷ নিজের মনের মত করে সাজানো। দরজার সামনে রোশনিবাগ, দুপাশে ঝিল, মেহফিলখানায় চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। চারদিকে বাঁদী। লোকে সাধ করে বলবে নবাবের হীরাঝিল। লোকে বলে সে ঝিলের পাড়ে নাকি পাওয়া যায় হীরের গুঁড়ো। তাই হীরাঝিল। আর তারই পাশে নিজের, একমাত্র নিজের বাসা চাই নবাবজাদার। হলও তাই। দাদুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শেষে তৈরি হল হীরাঝিল প্যালেস। দাদুও তো আর সাধারণ মানুষ নন৷ তিনি তামাম বাংলা বিহার উড়িষ্যার একচ্ছত্র নবাব নাজিম আলিবর্দি খাঁ। দিল্লীর বাদশার কাছেও তাঁর স্থান সম্ভ্রমের। বাংলা থেকে নিয়ম করে নজরানা পৌঁছে যায় দিল্লীতে। আর বাংলা উর্বর জমি। শস্যের দেশ। এ দেশের দিকে নজর সকলেরই। কে নেই সেই তালিকায়। মারাঠা থেকে শুরু করে মুঘল বাদশা, আবার ইউরোপের বিদেশী বেনিয়ার দলও এক নজরে তাকিয়ে থাকে বাংলায়। যাই হোক, এভাবেই গড়ে উঠলো নানা আলিবর্দির প্রিয় নাতি ও নবাবজাদা সিরাজের একান্ত নিজের সাধের বাড়ি। হীরাঝিল প্যালেস। নিজের মত বিলাস-ব্যসনের জীবন। গোলকধাঁধার মত জেনানামহল, ইবাদতখানা, বাঁদীমহল্লা। একটার পর একটা চমক। সে এক মস্ত দেউড়ি। সঙ্গে তাঁর নিজস্ব প্রশিক্ষিত সেনাদল ও দেহরক্ষী।
রাতটা কাটানোর জন্য একটা হোটেল পাওয়া গেল। মাথায় কড়িবরগা। কাঠের ছোট জানলায় উঁকি দিলে একটা তস্য গলি৷ সারাদিন পরে সবে একটু কাঠের বিছানাটায় গা এলিয়েছি, দরজায় টোকা। রাত যে অনেক হয়েছে তা একেবারেই নয়৷ কিন্তু সময়ের চেয়ে অনেকটা বেশি অন্ধকার যেন ঘিরে রেখেছে অলিগলির আশপাশটা। দরজা খুলে মুখ দেখা যাবে এমন প্রয়োজনীয় আলোটুকুও নেই। কিন্তু এমনটি কি ছিল? জাঁকজমকপূর্ণ মুর্শিদাবাদ থেকে আজকের মৃত্যুপুরী। এই যাত্রাপথ বড় বিচিত্র। কত মানুষ জড়িয়ে আছে সেই পথে। আলো আঁধারে ইতিহাস। একটু একটু করে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া একটা আস্ত নগরী। ঝলমলে এক আনন্দ নগরী থেকে আপাদমস্তক অন্ধকারে ডুবে যাওয়া এক সাধারণ মফস্বল। অথচ দিকে দিকে যেন তারই জীবন্ত জীবাশ্ম। শুধু খুঁজে নেবার অপেক্ষা। দরজা খুলে পেলাম এক অপরিচিত চেহারা। গালে হালকা চাপ দাড়ি। উজ্জ্বল অনুসন্ধিৎসু চোখ। হালকা বাদামী চুল। গায়ের রং বুঝবো তেমন আলোও নেই৷ তাই মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে দেখবার চেষ্টা করলাম। তাঁর দাবী হোটেলের পাশেই নাকি তাঁর বাসা৷ বাড়ির নাম ‘ওয়াজেদ মঞ্জিল’। ছোট বাড়ি। কিন্তু জাঁকজমকে ঠাসা। বলাই বাহুল্য আসবার সময়েই বাড়িটিকে আলাদা করে লক্ষ্য করেছিলাম। এখন বাড়ির মালিক আমার দোরে৷ কিন্তু উদ্দেশ্য? আমার মত এক ভিনদেশী চালচুলোহীন মানুষের কাছে তাঁর কী দরকার হতে পারে? কিছু পরে জানলাম স্পষ্ট জবানবন্দী৷ নবাবকে জনসমক্ষে আনতে হবে। আমার কাছে এই তাঁর দাবী। কিন্তু আমার ইতিহাসপ্রেম তাঁর চোখে ধরা পড়ে গেল কিভাবে। বিশেষ করে যেখানে ইতিপূর্বে কোনোদিনই তাঁর সাথে আমার আলাপচারিতার অবকাশই হয়নি৷ কিন্তু অবাক হয়ে ভেবে কীই বা লাভ। এই ভাবনাটাই অনেক ভাবলে কি নবাব সিরাজ বন্দুক আর কামান উঁচিয়ে ধেয়ে যেতে পারতেন কাশীমবাজার কুঠির দিকে? মনে তাঁর ইংরেজ বিরোধের বীজটা বসিয়ে দিয়ে গেছেন দাদু আলীবর্দীই৷ আজ নতুন শহর কলকাতায় তাদের অসহ্য দাপাদাপি তিনি সহ্য করবেন এ চিন্তা করাও অন্যায়৷ আর ওয়াটস সাহেব থেকে ড্রেক সাহেব, সবার আখড়া সেই কাশীমবাজার কুঠি৷ রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে কীই আর এমন দূর৷ নবাবের নাকের ডগায় বসে নবাবেরই দাড়ি ওপড়ানোর ষড়যন্ত্র বসে বসে কিকরে দেখা যায়৷ ইংরেজ সামনে যেমন প্রভুভক্ত, পিছনে তেমনই বিষাক্ত। একেবারে দুমুখো সাপ৷ দাদু বারবার বলতেন সিরাজকে, আর যাই হোক, ইংরেজ বেনিয়াদের থেকে সাবধান। তারা এদেশে ব্যবসা করতে আসেনি৷ এসেছে দখল করতে। আর ছোট সিরাজের সেই থেকেই ইংরেজ বিরোধিতার হাতেখড়ি। তাই কাশীমবাজার কুঠি আক্রমণ করে ধূলিসাৎ করে দিতে দুবার ভাবতে হয়নি তাঁকে। এরপর সময়ের সাথে সাথে ভবিতব্য কী হবে সেটা নিয়ে পর্যালোচনা করার অবকাশ কই? অত সময় নিলে কলকাতায় কাঁচা দুর্গের চূড়া যে পাকা হয়ে যাবে তা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন ২৩ বছরের কিশোর নবাব।
আমিও জবাব দিলাম ঘাড় নেড়ে৷ সম্মতিসূচক। অর্থাৎ নবাবকে তো জানতেই হবে। তিনি তো আর কেউ নন। স্বয়ং মনসুর উল্ মুল্ক সিরাজউদ্দৌলা জং বাহাদুর। তামাম বাংলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীন অধিপতি। করদ রাজা নন, দেওয়ান বা সুবেদার নন। এমনকি বাদশা নিয়োজিত রাজকর্মচারীও নন। তিনি স্বাধীনতাকে নিজের চোখে দেখেছেন। দেখেছেন শুধু বাংলাকে মারাঠাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দাদু আলিবর্দীর তুমুল লড়াই। তিনিও শিখেছেন নিজেকেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। একটা অন্ধকারকে কিভাবে আলো দেখাতে হয় তা তাঁর জানা, আবার আলোপথটা অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া যে একাহাতে প্রতিহত করবেন সেই শক্তিও তাঁর নেই। কেন নেই? সে অনেক কথা। মুর্শিদাবাদ ততদিনে আরো অন্ধকারে ডুবে যাবে না তো? সময়ই বলবে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।