সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ২৪)

আমার মেয়েবেলা
জীবন মানেই আমার কাছে ফেলা আসা আমার সেই
সুন্দর মেয়েবেলা।
আর মেয়েবেলা মানেই সেই ছোট্ট জায়গা যেখানে আমি আমার জীবনটাকে পরিপূর্ণ রূপে উপভোগ করেছিলাম।
জীবনের সব আনন্দটুকু নিংড়ে নিয়েছিলাম সেই কয়েক বছরে।
তাই কিছুতেই যেন ভুলতেই পারিনা আমার মেয়েবেলা কাটানোর সেই ছোট্ট শহরটাকে।
ফরাক্কা মানেই
চারিদিক কুয়াশায় ঢাকা, কিছুটা অস্পষ্ট,, মায়াবী রূপকথার দেশ।
ওখানেই আমার মেয়েবেলার স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছিল। ওখানেই প্রথম আমার স্কুলে যাওয়া।
আমাদের ফরাক্কায় তখন একটাই স্কুল। আমরা ব্যারেজের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গেই পড়েছি ফরাক্কা ব্যারেজ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে। আমরা মানে ব্যারেজের সব ছেলেমেয়েরাই তখন হেঁটেই স্কুলে যেতাম ।
আমরা তখন দশ নম্বর রাস্তায় থাকতাম। স্কুলটা সেই সময় বেশ দূরেই মনে হত আমার। যেতে প্রায় কুড়ি মিনিট/আধঘন্টা তো লাগতই। বেশ কষ্ট হত আমার,,, অতটা রাস্তা!
গরম কালেতো আরও কষ্ট। একটা শুকনো গরম। লু বইত। শোঁ শোঁ আওয়াজ হত। সকাল সোয়া দশটায় বেড়োতাম। ছাতাটা জলে ভিজিয়ে নিতাম। আমার গরম কালে খুব ঘামাচি বেড়োত, বাবারও। ফোস্কা পড়ে যেত। উফ্ কী যে অসহ্য ছিল এই গরমকালটা! আবার ঠান্ডাও পড়ত তেমনই।
গরমের সময় বাবা ঘরের মেঝেতে জল জমিয়ে রেখে ঘর ঠাণ্ডা করত। তখন তো এসির কথা জানতামই না। ছোট্ট শহর। কোনও টেলিফোনও নেই। যা যোগাযোগ সব চিঠির মাধ্যমেই। সন্ধ্যে হলেই লোডশেডিং। হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা গান বাজনা সবকিছু।
তখন কিন্তু অনেক কিছুই ছিলনা। তবুও কত আনন্দ ছিল!
খুবই সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবন। ডালভাতের সংসার। সর্ব সাকুল্যে একটা কি দুটো ভাল জামা। বাড়ীতে পরার জন্য বরাদ্দ ছিল হাঁস মুরগি পাখি আঁকা দুটো সাদা টেপজামা আর দুটো পকেটওয়ালা লাল ঘটি প্যান্ট। বড়ো হতে বুকের কাছে কুঁচি দেওয়া দুটো ছিটের ফ্রক। আর কোনও ডিজাইন নেই। মা,,আইনুদ্দিন কাকু যা বানিয়ে দিত ওটাই পরতাম।
বাবার হাত ধরে পি সি ধর কাকুর দোকানে যেতাম। কাকু একটা কি দুটো কাপড়ের থান বের করত। নিজেই পছন্দ করে বলত, এটা নে মামনি এটা তোকে খুব মানাবে। বাবাও অত দেখত না, কাকু যখন বলেছে ওটাই নেবে। আসলে বাবা সব সময়ই তাঁর সামনের মানুষটিকে বড্ড বেশি প্রাধান্য দিত। বরাবরই দেখেছি। হয়তো অনেক ঠকেছে কিন্তু আমৃত্যু মানুষটা কিছুতেই কাউকেই বিশ্বাস করতে ছাড়েনি। ভালোবেসে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া এটা আমি বাবার কাছে শিখেছিলাম। এই এক তরফা ভালোবাসা, সব জেনেও ঠকে যাওয়ার মধ্যে যে একটা তির তিরে সুখ আছে। আছে একটা নিজস্ব গোপন ভালোলাগা। সেটা তখন বুঝতে পারিনি। যত বয়স বেড়েছে ততই যেন ঐ বোকা জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া মানুষটাকে বুঝতে পেরেছি। অনুভব করতে পেরেছি বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়ার সুখটা কতটা যে অসাধারণ।
পি সি ধর কাকুর দোকান থেকে সেই ছিট কাপড় হাতে হাতে চলে যেত আইনুদ্দিন কাকুর কাছে। কাকু কোন সময় মাপ নিত কোন সময় নিত না। হাত নেড়ে বাবাকে বলত ঠিক আছে তাতুদা। পরশু দিন চলে আসবেন।
আমি বাবার হাত ধরে সতু কাকুর দোকান থেকে সিঙাড়া জিলিপি নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি আসতাম। বাবা শক্ত করে হাতটা ধরে থাকত। আর আমি তিড়িং বিড়িং করে কখনও লাফাতাম, কখন আকাশে সারি সারি বক ওড়া দেখতাম, কখন গরু,ছোট্ট ছোট্ট বাছুরদের মাঠে ঘাস খাওয়া দেখতাম। কখনও বা বাচ্চা বাছুরদের মা গরুর কাছে যাওয়ার আকুলিবিকুলি দেখতাম। আর দেখতাম মাঠে ছেলেদের বল খেলা। বাবা হাত ধরে থাকলে তো পরম নিশ্চিন্তে এসব কাজ করাই যায়। বাবা টেনে টেনে নিয়ে যেত। কখন কখন বাবা সাইকেল করে নিয়ে আসত। সামনে রডের উপর একটা ছোট্ট সিট লাগিয়েছিল বাবা।
বাড়ি ফিরতেই মা বলত সব দেখে শুনে নিয়েছ তো? নাকি যা গছিয়ে দিল সেটাই নিয়ে নিলে। বাবা ঢোঁক গিলে কথা ঘোরাত। আমি পরিবেশ বুঝে বাবার সাইকেল নিয়ে ধাঁ,,,
দুদিন পরেই গলার কাছ থেকে বিরাট একটা কাপড় ঝোলা মানে বড়ো কুঁচি দেওয়া জামা আসত। যতটা সম্ভব আমার কিশোরী শরীরটাকে ঢাকা দেওয়ার ব্যবস্থা এই আরকি। আমি বুঝতে পারতাম। কিন্তু প্রকাশ করতাম না। এটাই আমার নেচার ছিল সব কিছু বুঝে ফেলতাম যেটা আমার বোঝা উচিত ছিল না। আর যেটা বোঝা উচিত সেটাই বুঝতে পারতাম না। এখনও আমার সেই সমস্যা।
তো যাইহোক মা জামা পরিয়ে যতটা সম্ভব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে,,,, একটা খুঁত বের করার চেষ্টা করত। তারপর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত আমিই তো বানিয়ে দিতে পারতাম।
বাবা একটা বিড়ি ধরিয়ে বলত গরীব মানুষ বছরে একটা জামাই না হয় বানাল। আসলে আমার মা খুব ভাল সেলাই জানত। সব কাজই মা পারত। ভাল ইলেকট্রিকশিয়ান ছিল। কীভাবে যে দেঢ় হাজার ভোল্টের হিটারের কয়েল সুইচ অন করে সারাত কে জানে!
নতুন সুতির জামা দুটো মা ভাঁজ করে তুলে রেখে বলত এখন নয়। পয়লা বৈশাখে পরবি। আমিও সেটাই শিখেছিলাম। নতুন জামা মানেই পয়লা বৈশাখ আর পুজো।
ডিজাইন নিয়ে আমার কোনও মাথা ব্যথা ছিল না। একটা জামা হলেই হলো। তবে বুকের কাছে অত বড়ো কুঁচিটা আমাকে খুব সমস্যায় ফেলত যখন আমি সাইকেল চালাতাম বা দৌড়াতাম। কুঁচি উড়ে এসে আমার মুখে পড়ত। এত বিরক্তি লাগত যে কী বলব। তবে কোন দিন প্রতিবাদ করিনি। মা আমার জন্য কিছু কিছু নিয়ম কানুন তৈরি করেছিল যা আমি এখনও মেনে চলার চেষ্টা করি।
সন্ধ্যে হলেই ঘরে চলে আসা। যতটা সম্ভব শরীর ঢেকে জামা কাপড় পরা। মা বলত মেয়েমানুষের শরীর হল বিরাট সম্পদ। ওকে স্বযত্নে ঢেকে, লুকিয়ে রাখতে হয়।
যত গরমই লাগুক শোয়ার সময় গায়ে একটা চাপা দিয়ে শুতে হয়। বুঝিয়েছিল আমাকে,, ঘরে বাবা আছে ভাই আছে এটাই করা উচিত আমার।
কত কিছু শিখেছিলাম মার কাছে! মাছ কাটাতো মা একরকম হাতে ধরেই শিখিয়েছিল। কাটিং, উল বোনা, ক্রুশের টেবিল ক্লথ, গোল জলের ঢাকা ,
মাটির শিব, পুতুল বানানো,, ছুঁচে সুতো পরানো। কতোও কিছু শিখেছিলাম!
বলত ছুঁচে সুতো পরানোর সময় একটা সাদা কাগজ বা সাদা কাপড়ের কাছে ছুঁচটাকে নিয়ে সুতো পরাবি দেখবি বুড়ো বয়সেও অসুবিধা হবে না।
আরও অনেককিছু শিখিয়েছিল,, কেউ খারাপ কথা বললে,,অপমান করলে কষ্টে বুকে যন্ত্রণা হলেও ঢোঁক গিলে কীভাবে সব গিলে নিতে হয়। বলত কান্না গিলতে শেখ, মেয়ে মানুষের চোখের জলের কোনও দাম নেই। সব যন্ত্রণা,, সব কষ্ট গিলে যেদিন তোর বুকে ব্যথা হবেনা, সেদিন বুঝবি তুই মানুষ হলি।
এখন কতকিছু মনে পড়ে যায়। সুতো পরাতে গেলেই মেয়েদের খাতার উপর ছুঁচটা ধরি, দিব্বিই খালি চোখে সুতো পরিয়ে একা একাই হেসে ফেলি। কিন্তু তক্ষুনি মায়ের মুখটা সামনে আসে। চোখ মুছে চশমাটা খুঁজি। কিছু অনুভূতি নিজের করে রাখতে ইচ্ছে করে। সব কিছু দেখাতে বা জানাতে ইচ্ছে করে না। বাবা মা কী সারাজীবন কারোর থাকে?
কিন্তু তাই বলে এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া!!
পয়লা বৈশাখের দিন সকালে একটা,, আর বিকেলে একটা নতুন জামা পরতাম। সন্ধ্যায় হালখাতা করতে যেতাম বাবার হাত ধরে। আইনুদ্দিন কাকু বলত মামনি তোকে পরীর মতো লাগছে। আমি আনন্দে নাচতে নাচতে বাবার হাত ধরে এ দোকান সে দোকান যেতাম। আর বুকের উপর ঐ বড়ো কুঁচিটা তখন ফুরফুর করে ওঠানামা করত নয়তো আমার মুখে এসে পড়ত। বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরে নাচতে নাচতে চলতাম। জীবনে কোনদিন সহজভাবে হাঁটিনি। কিন্তু বিয়ের পরে আমার আর এক মা শিখিয়েছিলেন মেয়েছেলেকে অমন করে হাঁটতে নেই। হাঁটবে,, কিন্তু পায়ের শব্দ যেন না হয়। নয়তো সবাই বলবে অলক্ষ্মীর দশা।
এখন একটা কথার কোন তল পাই না। আমি কী বাপের বাড়িতে অলক্ষ্মী ছিলাম?
তবে যে আমি যেদিন সিংহ মশাই এর হাত ধরে শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছিলাম, ঠাকুমা কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বলেছিল, মামনি আসতে তোর উন্নতি হয়েছিল। সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছিল মেয়েটা। তোর লক্ষ্মী চলে যাচ্ছে তাতু ! তোর যে কী হবে এবার!!