ক্যাফে ধারাবাহিকে সুকুমার রুজ (পর্ব – ৭)

ম্যারিটাল প্লাস্টার

হ্যাঁ বাবা যাও। তোমাদের আর আটকাবো না। তাহলে ওই কথাই রইল। আজ সন্ধেবেলায় আমি যাচ্ছি। বুবাই হঠাৎ বলে ওঠে — ও! কাকু! একটা কথা, ওই যে লক্ষীমনি, হাইপারটেনসনের পেসেন্ট৷ ও কোথায় থাকে আপনি জানেন?
সেভাবে জানি না। তবে, কেস হিস্ট্রি নেওয়ার সময় খেরো খাতায় ঠিকানা একটা লিখেছি। সেটা দেখে বলতে পারি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকানা পেলেই চলবে। আর যদি ফোন নম্বর থাকে!
আছে, ফোন নম্বরও আছে। আমি সন্ধেবেলায় যখন যাবো, ওর ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখে নিয়ে যাবো। দিয়ে দেবো।
ঠিক আছে কাকু!
ওর ফোন নম্বর তুই কী করবি রে দাদা?
দরকার আছে!
ডাক্তারের কান বাঁচিয়ে দাদার কানে কানে টুকুন বলে — দেখিস, ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়িস না যেন!
বুবাই কিছুই বলে না। শুধু মুচকি হাসে
হ্যাঁ, আর তোমাদেরকে আটকাব না, যাও।
দেখি, ওঁরা বাড়ি ফিরে কী কান্ড ঘটিয়ে বসে আছেন, তাই বা
কে জানে!
হঁ্যা, বাবা যাও। তাহলে ওই কথাই রইল। আজ সন্ধেবেলায় আমি যাচ্ছি। বুবাই হঠাৎ বলে ওঠে— ও! কাকু! একটা কথা, ওই যে লক্ষীমনি, হাইপারটেনসনের পেসেন্ট। ও কোথায় থাকে আপনি জানেন?
সেভাবে জানি না। তবে, কেস হিস্ট্রি নেওয়ার সময় খেরো খাতায় ঠিকানা একটা লিখেছি৷ সেটা দেখে বলতে পারি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকানা পেলেই চলবে। আর যদি ফোন নম্বর থাকে!
আছে, ফোন নম্বরও আছে। আমি সন্ধেবেলায় যখন যাবো, ওর ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখে নিয়ে যাবো। দিয়ে দেবো। ঠিক আছে কাকু!! ওর ফোন নম্বর তুই কী করবি রে দাদা? দরকার আছে!
ডাক্তারের কান বাচিয়ে দাদার কানে কানে টুকুন বলে — দেখিস, ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়িস না যেন! বুবাই কিছুই বলে না। শুধু মুচকি হাসে। তারপর বলে — কাকু, আমরা তাহলে এগোই!
হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমরা যাও। সন্ধেবেলায় দেখা হচ্ছে।
নয়
বুবাই ও টুকুনের পিছন পিছন ডাক্তার গোবর্ধন সরখেল যখন রায়-ভিলা-তে ঢুকলেন, তখন অনুরাধা বসার ঘরে টিভিতে বস্তাপচা বাংলা সিরিয়াল দেখছেন। আর শোওয়ার ঘরে অনিমেষ খবরের কাগজ পড়তে পড়তে, ঘাড়ের ব্যথা নিয়ে বিছানায় চিৎপাত হয়েছেন।
গোবর্ধন ঢুকতে ঢুকতেই বলেন — আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাবা-মায়ের উপর এতটা ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখা যায় না, যতটা বুবাই-টুকুনের মধ্যে রয়েছে। মা-বাবাকে একবার থরোলি চেক-আপ করানোর জন্য আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে এল। তারপর বউদি বল, তোমার হাঁটুর ব্যথা কেমন আছে?
হাঁটুর ব্যথা খারাপ থাকতে যাবে কোন দুঃখে! ভালোই আছে। আমি ভালো নেই। হাঁটু মুড়ে বসে পুজো করতে পারছি না, গোপালকে চান করাতে পারছি না।
হ্যাঁ, বুঝি তো হাঁটু না মুড়তে পারলে কী সমস্যা হয়। তবে সেরে যাবে। তোমাকে যা বলেছি, বেশি সময় ধরে দু’পায়ে সমান। ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ব্যায়ামটা করে যেতে হবে। আলাদা সময় বের করতে না পারো, কুটনো-কাটা, রান্না-করা এগুলো দাঁড়িয়ে কর। তুমি তো অনেকক্ষণ ধরে নানারকম রান্না করো। ওই সময়টা ইউটিলাইজ হবে।
অনুরাধা বলে ওঠেন — মরণ নাই!
ডাক্তার হকচকিয়ে যান। বউদি এভাবে তো কথা বলেন না। উনি জিজ্ঞেস করেন— কিছু বললে বউদি?
না ঠাকুরপো, তোমাকে বলিনি। ওই বাহামনির সৎমাটার কথা বলছি। খুব শয়তানি৷
ও টিভি সিরিয়ালের বাহা?
হ্যাঁ, বস ঠাকুরপো। ইস্টিকুটুম’-টা শেষ হলেই চা করে দিচ্ছি।
বসার কি সময় আছে বউদি! সাড়ে সাতটা থেকে চেম্বার। দাদাকে একটু দেখে নিই৷ তারপর তোমার বি পি-টা চেক করেই দৌড় দেবো। দাদা কোথায়?
অনুরাধা শোওয়ার ঘরের দিকে ইশারা করেন। ডাক্তারের কথাবার্তায় ওর আগমন টের পেয়েছেন অনিমেষ। ডাক্তার ঘরে ঢুকতেই উঠে বসেন— এসো ডাক্তার। তোমার পেসেন্ট দেখা হল?
কোথায় আর হল! এক পেসেন্ট বাহামনির সৎমা-র মুন্ডপাত করছে। আর এক পেসেন্ট তো তুমি! বল কেমন আছ?
ভালো নেই ডাক্তার, মোটেও ভালো নেই। একমাসে পাঁচ কিলো ওজন কমেছে।
হ্যাঁ দাদা, তোমাকে দেখেও কেমন লাগছে। চোখ-মুখ শুকনো। কোনও টেনশনে আছ মনে হচ্ছে। শুয়ে পড়, শুয়ে পড়। বি পি, পালস রেট, এসব একটু চেক করে নিই।
অনিমেষের বাঁ-হাতে ব্লাড প্রেসার মাপার বেল্ট আঁটতে আঁটতে ডাক্তার বলেন— শুয়েছিলে দেখলাম। খুব দুর্বল লাগছে? রাতে ঘুমটুম হচ্ছে না নাকি?
অনিমেষ পাশের ঘরের দিকে তেরছাভাবে দৃষ্টি ছুঁড়ে বলেন — লোকে বলছে মোষের মতো নাক ডাকছি। তাহলে ঘুম নিশ্চয় হচ্ছে।
নাক ডাকে? কেমন শব্দ হয়? ঘোত ঘোঁত না ফোঁৎ-ফোঁৎ? তা কি আর আমি জানি! যার অভিযোগ, তাকে জিজ্ঞেস কর।
মানে ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ হলে ভেতরে অক্সিজেন কম যায়। আর ফোঁত-ফোঁত হলে নিশ্চয় কোনও অবস্ট্রাকশন মানে, নাকের মধ্যে পলিপ-টলিপ…।
কে জানে ওসব! তবে দুর্বল তো লাগছেই, খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক না হলে শরীর, মন সবই দুর্বল হয়।
সে কি! খাদ্যে অরুচি তো ভালো লক্ষণ নয়। দেখি জিভটা, অ্যা— কর!
না দাদা, ব্যাপার ভালো বুঝছি না। হাতের তালুদুটো দেখি।
এ তো রীতিমতো টেনশনে ফেলে দিলে৷ বিপি, পালস রেট সবই দেখছি হাই। অন্যান্য সিম্পটমও সুবিধের নয়। বুঝলে বাবা বুবাই! কই! কোথায় গেলে? এদিকে এসো। বুবাই টুকুন দু’জনেই ঘরে ঢোকে। অনুরাধাও টিভি বন্ধ করে দিয়ে এঘরে আসেন। শোন! দাদাকে একটু ভালো করে ডায়গনসিস করা দরকার।
কেন কাকু! কী হয়েছে বাবার?
হয়েছে তো অনেক কিছুই। শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে অক্সিজেন কম যাচ্ছে। সেটার ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া ব্লাড প্রেসার হাই। পালস রেট হাই৷ ই সি জি, লিপিড প্রোফাইল, ইকো কার্ডিয়োগ্রাফি এসব করাতে হবে। সম্ভব হলে কালই তোমার বাবাকে নার্সিংহোমে অ্যাডমিট করিয়ে দাও। বুবাই বলে— কাল কেন? আজই না হয় …।
না, এত ব্যস্ততার কিছু নেই। কাল নিয়ে গেলেই হবে। আমি ইউনিক নার্সিংহোমে বলে রাখছি। সকালেই নিয়ে যাও। শরীরে অক্সিজেন কম যাচ্ছে। ওটা নর্মাল করতে হবে। তারপর একটু ভালো খাওয়া-দাওয়া করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বুঝলে! চল বউদি, পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড় তো! তোমাকে একবার …!
আমি ভালো আছি ঠাকুরপো। ওই ওঁকে একটু ভালো করে দেখে, সারিয়ে তোলো। আমার তো একটাই বাসনা — ভালোয় ভালোয় শাখা-সিঁদুর নিয়ে যেন চিতায় উঠতে পারি।
ভালো আছি বললেই তো হল না বউদি, চল, তোমার বি পি-টা চেক করে নিই। আর বুবাই, তুমি এক কাজ কর, তুমি একবার ইউনিক নার্সিংহোমে যাও। আমি ফোনে সব বলে দিচ্ছি। দেখা করে কিছু টাকা-পয়সা অ্যাডভান্স করে এস।
হ্যাঁ যাচ্ছি — ব’লে বুবাই ডাক্তারকাকুকে ইশারায় একপাশে ডেকে নেয়— কাকু, সেই লক্ষ্মীমনির অ্যাড্রেস আর ফোন নম্বরটা?
হ্যাঁ, এনেছি। এই নাও। বুঝতে পেরেছি তোমরা পূর্বপরিচিত। কলেজের বান্ধবী নাকি?
হ্যাঁ কাকু, ঠিকই ধরেছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বুবাই বেরিয়ে পড়ে নার্সিংহোমের পথে। ডাক্তার গোবর্ধন সরখেল অনুরাধার ব্লাড প্রেসার মাপতে থাকেন। অনিমেষ চিৎপাত হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর টুকুন বাবার পায়ের কাছে বসে করুণ গলায় বলে— কিছু ভেবো না বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইউনিক নার্সিংহোমে বুবাইয়ের বেশি সময় লাগে না। টাকা অ্যাডভান্স করে একটা কেবিন বুক করে দেয়। তারপর ওখান থেকে সোজা চলে যায় ১০৫/২ তমালতলা রোড-এ কাগজে লেখা লক্ষ্মীমনির ঠিকানায়। কাছাকাছি গিয়ে ফোন করে। ফোনে পেয়েও যায়।
কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, লক্ষ্মীমনিদের ড্রয়িংরুমে সোফার উপরে বুবাই ওরফে বোধিসত্ত্ব রায় ও লক্ষ্মীমনি ব্যানার্জী পাশাপাশি বসে চা খাচ্ছে। লক্ষ্মীমনির হাতে একখানা বই। বইয়ের নাম ‘নাভির উপর দিয়ে জি টি রোড’। কবি লক্ষ্মীমনি ব্যানার্জীর সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ। সে বই থেকে একের পর এক কবিতা পড়ে যাচ্ছে লক্ষ্মীমনি, আর বুবাই দেওয়ালে একটা টিকটিকির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। টিকটিকিটা পা টিপে টিপে একটা আরশোলার দিকে এগোচ্ছে, বুবাই তা দেখতে দেখতে কবিতা শুনছে অথবা শুনছে না।
বেশির ভাগই ব্যর্থ প্রেমের কবিতা। কয়েকটা কবিতাতে তো আত্মহত্যা-প্রবণতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তা শুনে বুবাই আড়চোখে লক্ষ্মীকে দেখতে থাকে। ও শুনেছে, কবিরা অল্পবিস্তর পাগল হয়। লক্ষ্মী আবার..। ওবেলায় ডাক্তারের চেম্বারেও কেমন পাগলের মতো ভাব করে বলছিল, ‘আমার আবার খুব গরম লাগছে, শরীর আনচান করছে। আর একবার চান করব।’
বুবাই ভাবতে থাকে, লক্ষ্মীমনির কাছে আসাটা বোধহয় ঠিক হল না। আসলে, আজ কোর্ট-চত্বরে ঘুরে বেরানোর সময় কেমন নস্টালজিক হয়ে পড়েছিল। তার পর পরেই আচমকা লক্ষীর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। ভেবেছিল, ওর সঙ্গে দেখা হলে গল্পগুজব হবে। কিছুক্ষণের জন্য সেই কলেজ জীবনের দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারবে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে দু’জনে বসে সময় কাটানোর স্মৃতিচারণ করতে পারবে। কিন্তু কোথায়! ওকে তো কবিতায় পেয়েছে। একবার ও কলেজ-জীবনের কথায় ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লক্ষ্মী তার ধারকাছ দিয়ে গেল না। শুধু বলল, ওসব পূর্বাশ্রমের কথা আমি মনে করতে চাই না। ওই জীবন পেরিয়ে এসে আমি কবি-জন্ম পেয়েছি। এখন কবিতাই আমার ধ্যানজ্ঞান। কবিতা শোনো।
তার পর থেকে তো ননস্টপ চলছে। ও যে এবার উঠবে সে কথা বলারও সুযোগ পাচ্ছে না। তবুও সবকিছুরই শেষ আছে, লক্ষ্মীর কবিতাপাঠও একসময় শেষ হল। বুবাই উঠবে উঠবে ভাবছে, এমন সময় লক্ষ্মী বলে — বোধি, তোমার বউয়ের নাম বল। হঠাৎ বউয়ের নাম!
বল না, দরকার আছে। ওকেই আমার কবিতার বই দেব। তুমি তো কবিতা পড় না। হয় তো কবিতা বোঝও না। বুবাই বিড়ম্বনায় পড়ে। ওর বউ বাংলা পড়া তো দূরের কথা, বাংলা বলতেও পারে না। তার নাম ক্রিশ্চিয়ানা রিয়া। ওটা বললে আবার কী কথা শুনতে হবে কে জানে। তাই ও নিমেষের মধ্যে বউয়ের একটা নতুন নাম বানিয়ে নেয়। বলে, বউয়ের নাম কৃষ্ণা, কৃষ্ণা রায়।
লক্ষ্মীমনি বইয়ের উৎসর্গ-পাতায় লেখে — প্রিয় কৃষ্ণা, আমার পূর্বজন্মের প্রেমিককে তোমায় দিয়েছি। এ-জন্মের সন্তানকেও তোমায় দিলাম। প্রেমিককে ভোগ করছ, সন্তানকে উপভোগ করো। ভালো থেকো। — ইতি লক্ষ্মীমনি।
বুবাই বইটা নেয়। বলে — আসি, আবার দেখা হবে।
লক্ষ্মী বলে, না, আর দেখা হবে না। আর একটা অনুরোধ, আমি জানি, বইটা তুমি তোমার বউকে দেবে না। কিন্তু বইটা যেন ফেলে দিও না। এক অর্থে ওটা তোমারও সন্তান। তুমিই এর বীজ দিয়েছ। যদি তুমি আমার হতে, তাহলে আমি কবি হতাম না।
কথাটা শেষ করেই লক্ষ্মীমনি বলে — তুমি এবার এস। আমার খুব গরম লাগছে। এবার আমি চান করতে ঢুকব।
দশ
ভোরবেলা। কাকেদের ডাকাডাকি শুরু হয়েছে। তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি৷

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।