হৈচৈ ছোটদের গল্পে সুদীপ্ত পারিয়াল

পিকলুর রহস্য

কলকাতায় হাতে গুনে এর আগে আমি দু তিনবার গেছি। গুরুজির সাথে কলেজস্ট্রিটে বই পাড়ায়, একবার লেক কালীবাড়ি মন্দিরে, রণদার সাথে দুর্গাপুজোতে দুই একবার ঘুরতে গেছিলাম। কিন্তু আমাদের এবারের অ্যাডভেঞ্চারটা যে কলকাতার মতন এত বিরাট ও সুন্দর শহরে ঘটবে সেটা ধারণাও করিনি।
কলকাতার যে বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলো আছে, সেগুলো এখনও আমার দেখা হয়নি। রনদা ওর বন্ধুদের সাথে গিয়ে বিড়লা প্ল্যানেটরিয়াম, মিউজিয়াম, রবীন্দ্রনাথের বাড়ি, বিবেকানন্দের বাড়ি প্রমুখ দেখে এসেছে। নেহাৎ ওদের হাই স্কুলের এসকারশন টুর ছিল, নইলে নিশ্চয়ই আমাকেও নিয়ে যেত।
অবশ্য এবারের অ্যাডভেঞ্চারে কলকাতা দর্শনের শখ আমার ভালোভাবে পূরণ হয়েছে। সেই সঙ্গে আমার নতুন বন্ধু পিকলুর ব্যাপারগুলো আমাদের যথেষ্ট ভাবিয়েছে।
পিকলুর প্রসঙ্গে সময় মতন আসা যাবে। প্রথমে বলি এই অ্যাডভেঞ্চারের সূত্রপাত কিভাবে হলো। আমাদের পঞ্চায়েত প্রধান আমাদের বাড়ি এসে হাজির। রণদা বুঝতেই পেরেছিল নির্ঘাত কোন ব্যাপার ঘটেছে, নইলে নবীনবাবু চট করে ওর ধারে কাছে আসতে চায় না। কারণ আসলেই তো রণদা হাজার রকমের নালিশ করবে। অমুকের বাড়ি জলের লাইন কেন সাড়াচ্ছেন না? অমুক রাস্তায় অমুক দিনগুলোতে আলো জ্বলে নি কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা মানতেই হবে, বিগত পাঁচ বছরে রণদার চাপেই হোক কি নিজের কর্তব্যের খাতিরে ভদ্রলোক তার কাজ সঠিকভাবেই করে যাচ্ছেন।
গুরুজি ঘরেই ছিল। মা ওনাকে চা দিল। গুরুজি বলল, কিছু সমস্যায় পড়েছেন মনে হচ্ছে নবীনবাবু?
-নইলে কি আর আসি বলুন! তবে এবার কিন্তু আমি আপনার কাছেই এসেছি।
-আমার কাছে?
-হ্যাঁ, আপনি না বলতে পারবেন না কিন্তু।
-ব্যাপারটা তো শুনি।
-আপনার বড়ছেলেকে ডাকুন না, একসাথে কথাটা সেরে নিই।
রণদা স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ও এসে বলল, বেশিক্ষণ সময় নেই। একটু তাড়াতাড়ি বলবেন।
-নিশ্চয়ই রণবাবু, তুমি আমার ভাগ্নেকে বাঁচাও!
-মানে?
-একটা দশ বছরের বাচ্চা খুন করতে পারে?
রণদা বলল, একটু পরিষ্কার করে বলুন প্লিজ!
-কলকাতায় বেশ কয়েক মাস ধরে সিরিয়াল কিলিং হচ্ছে খবরে পড়েছ নিশ্চয়ই।
তোমরা যারা সিরিয়াল কিলিং ব্যাপারটা জানো না, তাদের জন্য বলে দিই, একই পদ্ধতিতে একাধিকবার বিভিন্ন মানুষকে কোন এক বা একাধিক মানুষ যদি খুন করেন সেটা সিরিয়াল কিলিং হয়।
গুরুজি যদিও আমায় বলে দিয়েছিল, তোমার পাঠকদের বলে দিও ছোটবাবা, এই শব্দটা ওরা যেন শুধু গল্প পড়ার আনন্দেই গ্রহণ করে। তাই তোমাদের অনুরোধ, গুরুজির কথাটা তোমরা প্লিজ শোনো।
রণদা গুরুজি এমনকি আমিও খবরটা পড়েছিলাম। গুরুজি বলল, তাতে কি?
-সব অভিযোগের তীর যে আমার ১০ বছরের ভাগনা পিকলুর দিকে যাচ্ছে।
-বলেন কি? কি ভাবে?
-খবরের শুধু বেরিয়েছে, যে যে জায়গায় খুন হয়েছিল, সেসব জায়গাতে ওর জুতোর ছাপ, ওর হাতের লেখা কাগজ, এমনকি ওর আঙুলের ছাপও পাওয়া গেছে। ওকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। আর এই কেসটা যেহেতু জুভেনাইল কোর্টের আন্ডারে। তাই স্থানীয় পুলিশ বা কোন চেনাশোনা প্রভাবশালী ব্যক্তি কেউই কিছু করতে পারবে না।
বোঝা গেল নবীনবাবুর চান রণদাই কেসের ব্যাপারে কাজ করুক। কিন্তু তার জন্য গুরুজিকে কি বলতে চান ভদ্রলোক!
নবীনবাবু বললেন, রণবীর এই কাজটা করুক সেটাতে আপনার আপত্তি নেই তা জানি নিত্যবাবু, কিন্তু এই ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। আমার ভাগ্নে আবার নিজেও স্বীকার করেছে ও খুনগুলো করছে। এখন রণবাবু গিয়ে যদি ওর সাথে একটু কথা বলে, বুঝতেই তো পারছেন ছেলেমানুষ ভয় পেয়ে হয়তো সব স্বীকার করেছে।
গুরুজি বলল, কিন্তু ধরুন সত্যিই ওই ছেলে এই খুনগুলো যদি করে, অনেক ছেলেমানুষরা বিভিন্ন কারণে ছোট থেকে ক্রাইম করে।
-আগে নিত্যবাবু, সেজন্যই তো আপনার অনুমতি নেওয়া। হতেও পারে এই কেসের শেষে রণবাবু নিরাশ হবে, আমি শুধু চাই আমার ভাগ্নে পিকলু কেন এসব করছে, ওর মানসিক কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা! হলো কেন হচ্ছে? এগুলো একটু দেখতে।
রণদা কোন কথা বলেনি, এর মাঝেই ও একটা পেপার বার করে তার মধ্যে থেকে পিকলুর ঘটনার খবর খুলে সেটা খুব মন দিয়ে পড়ছে। শেষ খুনটা হয়েছে গত শুক্রবার।
উনি একজন ট্রাফিক পুলিশ। বয়স ৩০। নাইট ডিউটি চলাকালীন তাকে বুকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়েছে। ওনার গায়ে যে নখের আঁচড় পাওয়া গেছে। তা কলকাতার বালিগঞ্জ নিবাসী মনোহর সামন্তর পুত্র নীলাভ সামন্ত ওরফে পিকলুর ডি এন এর সাথে মিলে গেছে। তবে আরও কিছু ফরেন্সিক রিপোর্টের অপেক্ষা করছে জুভেনাইল কোর্ট। পিকলুকে আপাতত গৃহবন্দী রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওর সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিং চলছে। ও স্বীকারও করেছে খুনগুলো ওই করছে। কেন করছে বললে ও বলছে, নিজের কাজ যারা করে না তাদের ওর শাস্তি এভাবেই দেবে।
কয়েক বছর আগে একটা পুরনো সাউথের হিন্দি ডাব ছবি আমি দেখেছি। সিনেমাটার নাম ছিল ‘অপরিচিত’। সেখানে অম্বি নামে এক যুবকের এক বিচিত্র মানসিক রোগ ছিল। সে এভাবেই অন্যায়কারীদের শাস্তি দিত। তোমরাও ওই সিনেমাটা দেখেছ আশা করি।
আমার মনে হল ছোটমানুষের মনে হয়তো ওই সিনেমার প্রভাব একটু বেশি প্রবল ভাবে পড়েছিল। সেই কারণে এই নিয়ে প্রায় তিনটে খুন করে ফেলেছে। গুরুজি আর নবীনবাবু এখনও পিকলুর এই কেসটা নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। রণদা কোন কথা বলছে না। কি যেন ভাবছে! ওর সত্যিই কিছু করার থাকবে না। যদি অপরাধী নিজে তার অপরাধ স্বীকার করে নেয় সেখানে ও আর কি করবে?
রণদা বলল, বাবা আমি বরং আজ রাতেই একবার ঘুরে আসি।
-যাবে? কিন্তু এ কেস তো,,,,
– জানি, কিন্তু তবু ছেলেটিকে দেখার ইচ্ছাটাও যে আমার হয়নি তা বললে ভুল হবে। কুনাল, সুজনদাদাকে বল, ও যেতে পারলে আজ রাতেই আমরা যাব।
নবীনবাবু বোধহয় কল্পনাও করেনি রণদা রাজি হবে। তাই খুশি হয়ে বললেন, তোমার অগ্রিম চার হাজার আমি দিয়ে যাচ্ছি। বিকেলে আমি তোমাদের নিয়ে যাব।
-আপনি এখন থাকুন। প্রয়োজনে আপনাকে আমি ডেকে নেব। আর টাকা এখন আমি নেব না। কারণ আমরা সে বন্ধুত্ব করতে যাচ্ছি। হতেও পারে পিকলু সত্যিই খুনি। তাই টাকাটা এক্ষেত্রে নেওয়া ঠিক মানুষের কাজ হবে না।
ভদ্রলোক তবু শুনলেন না। এক প্রকার জোর করেই চার হাজার টাকার রণদাকে দিয়ে গেল।
রণদা শর্ত দিল, যদি পিকলু সত্যিই দোষী হয় রণদা টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবে। আসলে অগ্রিম টাকা রণদা কেস হারলেও ফেরত দেয় না। কারণ পরাজয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় গোয়েন্দার ভূমিকা থাকে না। যদিও ওর শেষ পরাজয়ের কেসের কথা আমার খুব একটা মনে পড়ে না।
আমি স্কুলে যাবার পথে সুজনদাদার বাড়ি হয়ে গেলাম। জানি সুজনদাদা এই সময় বাড়ি থাকবে না। ওর ভাই শ্রীকান্ত আমার চেয়েও ছোট, তবুও ঘরেই একটা চায়ের দোকান দিয়েছে। সুজনদাদার বাবা পরানজেঠু এখন দোকানে বসে, উনি নাকি বলতেন ঘরে বিশ্রাম নিতে নিতে উনি হাপিয়ে ওঠেন। তাই দোকান খুলে দুটো লোকও আসবে, গল্পগাছাও করা যাবে, মনটাও ভালো থাকবে, আর তার সাথে যদি বিক্রিবাট্টা হয় সুজনদাদার চাপটা একটু কমে আর কি।
শ্রীকান্তকে বললাম সুজনদাদাকে বিকেলে আমাদের বাড়িতে যেন পাঠিয়ে দেয়।
আমাকে রণদা একটা হোমওয়ার্ক দিয়েছে। ওর স্কুল সদরে। স্কুল থেকে ও জিমে যাবে, সেখান থেকে একটা টিউশনি পড়িয়ে বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। ততক্ষণে আমি কাজটা সেরে ফেলব।
কাজ হলো এই, পিকলুর ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য, বিগত ঘটনাগুলো থেকে সংগ্রহ করে লিখে রাখা। কোন ছোটখাট তথ্যও বাদ দিতে বারণ করেছে রণদা।
স্কুল থেকে ফিরেই আমি খেয়ে দেয়ে তাই কাজগুলো আগে করতে বসে গেলাম। খবরের কাগজগুলো বেছে সেখান থেকে খবর সংগ্রহ করে সেগুলো আগে ভালো করে পড়ে নিলাম। তারপর পিকলু সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করতে শুরু করলাম। অবশ্য বিকেল বেলা সুজনদাদা এসেও আমাকে কাজটা করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। তোমাদের কাছে তুলে দিচ্ছি।
নীলাভ সামন্ত
ডাকনাম পিকলু
বয়স-ন বছর চার মাস আর আজ নিয়ে তিন দিন
উচ্চতা ৩ ফুট ৫ ইঞ্চি
ওজন কুড়ি কিলো
গায়ের রং ফর্সা (ছবি অনুযায়ী)
স্কুল-বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নাম উল্লেখ কোন কাগজ করেনি।
ক্লাস-ফোর
মেধাবী ছেলে
ওর এক দাদা আছে তার ব্যাপারেও কোন উল্লেখ কোন তথ্য কোন কাগজে নেই।
অভিযোগ সিরিয়াল কিলিং
মোটিভ নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে না পালন করার শাস্তি দেওয়া।
প্রথম ঘটনা
২২ জুলাই ২০২৩, এক সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারকে খুন, বুকে ছুরি মেরে।
(নিহত ব্যক্তির ব্যাপারে লিখতে রণদা বারণ করেছে)
দ্বিতীয় ঘটনা
১২ অক্টোবর ২০২৩, এক শিক্ষককে খুন একই ভাবে।
তৃতীয় ঘটনা
গত শুক্রবার ১ মার্চ ২০২৪, ট্রাফিক পুলিশ খুন পদ্ধতি এক।
নিহত তিন ব্যক্তির পরিচয় না লিখতে বললেও দুটো বিষয় মিলে যেতে সেটা তোমাদের না বলে থাকতে পারছি না। তিনজনের সরকারি কর্মচারী। তিন জনের বয়সই ৩০।
রণদা এসে আমার কাজ দেখে খুব খুশি হল।
ও ভালো কথা, আজ আমাদের যাওয়া হচ্ছে না। সকালবেলা আমাদের এখান থেকেই নবীনবাবু তাঁর বোনকে ফোন করেছিলেন। ওনারা আর থাকছেন না। তাই সকালেই আমাদের যাওয়া হবে বলে মনস্থির করা হয়েছে। সুজনদাদাও এদিকটায় গুছিয়ে নিয়েছে। আর আমি আর রণদা নিজেদের অল্প কিছু একটা জামা কাপড় প্যাক করে নিয়েছি।
রণদা আমার হাতে লেখা কাগজটা নিয়ে দেখছিল, হঠাৎ ওর ফোনে নবীনবাবুর ফোন।
-বলুন নবীনবাবু।
-একটা সমস্যা মানে-
-কি হয়েছে?
-পিকলুকে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছিল। এই খানিকক্ষণ আগে আমার বোন বিনোদের ফোন এসেছে।
-সে কি!
-হ্যাঁ, একটু আগে ওকে বাড়িতে ছেড়েও দিয়ে গেছে।
-আচ্ছা, কি বলছে ও?
-সে ছেলে তো গুম মেরে বসে আছে।
-কিন্তু এত কড়া পাহারা থাকতে এটা কি করে হল?
-সেসব তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বলি কি আজই তোমরা রওনা হয়ে যেতে পারো না?
-বেশ দেখছি—
-রণবীর, আমিও চাই একবার ছেলেটাকে দেখে আসি। আমার গাড়ি করেই তোমরা চলো। রাতে আমি ফিরে আসব।
সুজনদাদা বলল ওর একটু অসুবিধা থাকলেও ও ম্যানেজ করে নেবে। আসলে রাতে এক যাত্রীকে বসন্তপুরে পৌঁছতে হবে। সুজনদাদা তরুণ মাঝিকে সে দায়িত্ব দিয়ে আমাদের সাথে রওনা দিল।
হাইওয়ে দিয়ে আজকে খুব বেশি দেরি হল না। সাড়ে আটটার মধ্যে বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে হেস্টিংস-এর কাছে এসে প্রথম জ্যামে পড়তে হলো আমাদের। আধাঘন্টা সময় নষ্ট হল সেখানে। পি.জি হাসপাতাল পেরিয়ে ব্রীজে উঠতেই ঝড়ের গতিতে আমরা পৌঁছে গেলাম নবীন সোমের বোনের বাড়ি। বালিগঞ্জের এই জায়গাটার নাম লোয়ার সার্কুলার রোড।
রাস্তার ধারেই দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনের দুজন পুলিশ। নবীনবাবুকে বয়োজ্যেষ্ঠ দেখে তাকেই জেরা করা হল। রণদার আসল পরিচয় পেতেই আমরা রেহাই পেলাম।
ভদ্রলোকের বোন বিনোদ সামন্ত দাদাকে দেখে কেঁদে উঠলেন।
-ছেলেটার আমার কি হল রে দাদা! কি হবে এখন?
নবীনবাবুকে যত চতুর মনে করতাম ততটা উনি নন। বোনকে সান্ত্বনা না দিয়েই তিনি নিজেই ভেঙে পড়লেন। মহিলার স্বামী শক্ত আছেন। মনোহর সামন্ত। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। রণদাকে দেখে যেন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি। বোধহয় তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি রণদা বয়সে এতটা ছোট!
রনদা নিজেই তার পরিচয় দিল। আমি আর সুজনদাদা কেমন যেন চুপ করে গেছি। ঘরে এমন নাটকীয় পরিস্থিতির মাঝে কথা বলতে বড্ড বেমানান লাগে। আমরা বসার পর আমার বয়সী একটা ছেলে আমাদের জন্য শরবত নিয়ে এল। নবীনবাবুকে প্রণাম করে সে বলল, ভালো আছো মামা?
বুঝলাম এই হল সেই পিকলুর দাদা। নবীনবাবু বললেন, আর ভালো! আর সে কোথায় রে টিকু?
-ঘরে।
-একবার আসতে বল তো। এরা ওর সাথে একটু কথা বলবে।
-এরা কারা?
এইবার নবীনবাবুই টিকুকে আমাদের পরিচয় দিলেন।
টিকু কিন্তু বেশ মিশুখে। সে হেসে বলল, রণবীর আমি কিন্তু তোমার বিশাল বড় ফ্যান। কুনাল তোমার সাথে দেখা করার কত চেষ্টা করেছি জানো? কত চিঠি লিখেছি তোমাকে! আর সুজনদাদা গল্পে তোমায় কুনাল যেভাবে লেখে তার থেকেও তুমি অনেক বেশি সুন্দর ও হ্যান্ডসাম। রণদা ছাড়া আমরা দুজনেই চুপ রইলাম । রণদা হেসে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলল।
আমি একটা বিষয়ে আশ্চর্য হলাম। বাড়ির এতসব ঘটনায় টিকু বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। অবশ্য কলকাতার ছেলেরা অনেক বেশি স্মার্ট হয়। দত্ত বনিক ভিলা রহস্য সমাধানের সময় আমাদের মাস্টারমশাইয়ের সুদর্শনবাবুর ভাইপো ঋষির কথা তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। সেও আমারই বয়সী। কিন্তু আমার থেকে অনেক বেশি স্মার্ট। আর টিকুকেও সেরকমই দেখলাম। পিকু এতসব ঘটনা মধ্যেও কি করে এত সহজ আছে সেটাই আমার কাছে বিস্ময়। সেই জন্যই বোধহয় ও আমার কাছে রহস্যময় হয়ে উঠল। ও আমাদের সাথে হ্যান্ডশেক করে ওর নাম বলেছিল। সৌরভ।
পিকলুর ছবি যেটা কাগজে ছেপেছিল তার চেয়ে আরও সুন্দর দেখতে ওকে। স্বাস্থ্য বেশ ভালো। তবে মোটা নয়, বরং টিকুর গড়ন একটু মোটার দিকে। দুই ভাইয়ের একবিন্দুও মিল নেই চেহারার।
পিকলুর সাথে রণদা একটু আলাদা কথা বলবে বলল। অবশ্য আমি,সুজনদাদা এমনকি টিকুও ওদের অন্য একটা ঘরে গেলাম। টিকু একটা টেবিলের সামনে তিনটে চেয়ার পেতে অন্যদিকে একটা চেয়ার পেতে জেরার বন্দোবস্ত করছে দেখে রণদা বলল, আচ্ছা তোমায় বুঝি এভাবে জেরা করা হয়?
পিকলু কোন কথা বলল না। চুপচাপ ওই একলা চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে।
টিকু বলল, আমি বাইরে আছি।
রণদা বলল, কেন তুমিও থাকতে পারো। আর এসব চেয়ার লাগবে না। সরিয়ে দাও। আমি শুধু ওর সাথে একটু গল্প করব। আমরা সোফায় গিয়ে বসলাম। রণদা কিন্তু বসল না। ও পিকলুর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
-পিকলু আমার চোখের দিকে তাকাও তো।
মুখ না তুলেই পিকলু বলল, কেন?
-যারা ব্রেভ বয় তারা কখনও মাথা নিচু করে না।
টিকু আমার পাশে এসে বসেছে। করে একবার আমার কানে কানে বলল, তোমার সাথে একটা সেলফি নেব কেমন?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। আমি ভুল হতে পারি, তবে টিকুর আচরণ ক্রমশই আমার অস্বাভাবিক লাগছে। ছোট ভাইয়ের এমন অবস্থায় ওর কি একটু দুঃখ হচ্ছে না!
পিকলু বলল, আই অ্যাম নট আ ব্রেভ বয়!
বলে রাখি টিকু আর পিকলু দুজনই বেশিরভাগ কথাবার্তা ইংরেজিতে বলেছিল। রণদাও তার উত্তর ইংরেজিতে বললেও আমাকে ও নির্দেশ দিয়েছিল। আমি যেন এই অংশটা বাংলায় অনুবাদ করে লিখি। আসলে বাংলা গল্পে  অপ্রাসঙ্গিকভাবে ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ করার যে হুজুগ উঠেছে সেটা ও একদম পছন্দ করে না।
-তার মানে তুমি স্বীকার করছ না তুমি খুন করেছ?
-আমি খুন করেছি।
-তারপর স্বীকারও তো করেছ। এটা ব্রেভ বয়-এর লক্ষণ নয়?
পিকলু খুব ধীরে ধীরে রণদার দিকে তাকাল। এত উজ্জ্বল চোখ মিথ্যে কথা বলতে পারে না। কিন্তু একজন ৩ ফুট উচ্চতার বাচ্চা কি করে এসব কাজ করতে পারল?
-তোমার হাতের তালু টা দেখি।
রণদা ওর হাতের তালুটা নিয়ে খুব মন দিয়ে কি যেন দেখছে। তারপর বলল, চলো আমরা একটু পাঞ্জা লড়া খেলি।
আমার হাসি পেল। রণদার অমন বাইসেপ ওয়ালা সুঠাম চেহারার সাথে একটা বাচ্চা ছেলে পাঞ্জা লড়তে পারবে কি করে?
পিকলু বলল, আমি পারব না তোমার সাথে।
-সে কি! তাহলে ছুরি চালাও কি করে?
-যেমন করে চালায়।
-ডেমো দেখাও।
-মানে?
-ধরো তুমি আমাকে মারতে চাও। আমি হেঁটে এখানে এলাম। তুমি মারো দেখি।
কথা বলার সাথে সাথে রণদা অভিনয়ের ভঙ্গিতে ঘরে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত হেঁটে এল।
পিকলু ডেমো দেখাবার সময় যখন মারল তখন রণদার ছাতিতে ওর নরম ঘুসি মারার জন্য একটু লাফাতে হল।
কিন্তু অব্যর্থ লক্ষ্যে একদম হৃদপিণ্ড বরাবর ওর ছোট্ট হাতের কিল পড়ল।
রণদা কি যেন বুঝে বলল, ভেরি গুড! আচ্ছা পিকলু তুমি ওদের মেরেছ ওরা অন্যায় করেছিল বলে, কিন্তু তুমি কি করে জানলে ওরা অন্যায় করেছে?
পিকলু কোন কথা বলতে পারছে না দেখে টিকু বলল, ওর খুব বই পড়ার নেশা গো রণবীর! গোয়েন্দা গল্প পড়ে কাগজের ক্রাইম খবরগুলো পড়ে এসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা মাথায় এসেছে।
-কিন্তু একটা ব্যাপার ও গেল কি করে? তোমরা দুই ভাই নিশ্চয়ই একটা ঘরে শোও।
-হ্যাঁ ।
-ও যে কখন গেছে জানি না। সকালে এসে বলে দাদা আজ প্রবীর গুহকে মেরে এলাম।
-তোমায় সব বলে?
-হ্যাঁ।
-তাহলে তো ওর হয়ে তুমি সব বলতে পারবে। কাউকে তো একটা বলতে হবে।
-আমি কি করে বলব? আমাকে কি ও সব বলে?
-বেশ তো যা বলে তাই বল।
-শুধু অমুক দিন তমুক জন কে খুন করে এল। এইসব বলে আর কি!
-তুমি শিওর  খুনগুলো তোমার ভাই করছে?
-ও তো নিজেই স্বীকার করছে।
-তা করুক। ও তো তোমার ভাই। ভাইয়ের প্রতি একটু বিশ্বাস থাকবে তো।
– তা তো আছে। এখন তদন্ত সেভাবে চলবে সেভাবেই—
রণদা এমন একটা কাণ্ড করবে আমি ভাবতেও পারিনি। এক ঝটকায় টিকুর কাছে এসে ওর গালে সজোরে একটা থাপ্পর মারল। বাচ্চাদের গায়ে ও হাত দেয় না। তাও অচেনা। কিন্তু টিকু কে মারল কেন?
রণদা বলল, তোমার খেলা শেষ সৌরভ। লজ্জা করে না তোমার!
পিকলু চেঁচিয়ে উঠল, দাদা ভাইয়ের কোন দোষ নেই রণদা, সব দোষ আমার।
-পিকলু তোমার দাদার বয়স কত?
পিকলু চুপ।
এতক্ষণে চিৎকার চেঁচামেচি তে পাশের ঘর থেকে নবীনবাবু তার বোন ভগ্নিপতি সেইসঙ্গে আমার আরও এক পূর্ব পরিচিত রণদার বন্ধু প্রিয়মদা। সেই সঙ্গে এক পুলিশ অফিসার।
প্রিয়মদা এখানে কেন বুঝতে পারলাম না।
রণদা বলতে শুরু করল, মনোহরবাবু আপনার দাদার ছেলে যাকে আপনি নিজের বড় ছেলে ভাবেন সেই সৌরভ যার আসল বয়স ৩০ বছর। ওর দেহের হরমোনাল গ্রোথ বন্ধ হয়ে গেছে ১৪ বছর বয়স থেকেই। বিষয়টা আমি আজ সকালে জানতে পারি। নবীনবাবু বলেননি। কিন্তু এই সিরিয়াল কিলিং চেষ্টা যে জুভেনাইল এক্সপার্ট সামলাচ্ছেন তার কাছ থেকে আমি এই সমস্ত ডিটেলস পাই। তখনই সৌরভবাবুর এই বিরল রোগের কথা জানতে পারি।
সৌরভবাবুর মা বাবা মারা যাবার পর উনি আপনাদের কাছেই থাকতেন মনোহরবাবু। তারপর ওর শারীরিক অক্ষমতার কারণে তাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতারিত হতে হয়। সেটা অবশ্যই অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। কিন্তু তার জন্য এত প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠেন উনি সেটা কল্পনার বাইরে। উনি ঠান্ডা মাথায় করাপটেড সোসাইটির লোকজনদের হত্যা করার সিরিয়াল প্ল্যানিং করতে থাকেন। আজ হ্যান্ডশেক করার সময় ওনার কব্জির জোর দেখে আন্দাজ করা যায় যেকোন জোয়ান লোকের বুকে ছুরি বসাতে উনি সমর্থ্য।
আরও তথ্য আছে। উনি যাদের হত্যা করেছেন তারা আদৌ করেপটেড নন। কারণ তাদের সদ্য নিয়োগ করা হয়েছে। আজ স্কুলে না গিয়ে সারাদিনে এই কেসটা নিয়েই আমি স্টাডি করেছি বালিগঞ্জ থানার এস আই সুমন দীর্ঘাঙ্গীর সাথে। আমার বন্ধু প্রিয়ম ভিডিও কলিং-এ আমাদের সংযোগ করিয়ে দেয়। সুমনবাবু এলেন বলে।
যাইহোক, মৃত তিনজন প্রবীর গুহ, স্বপন সেন ও সুমিত চট্টরাজ ছিলেন সৌরভবাবুর প্রতিদ্বন্দ্বী। ওনারা আঁচও করতে পারেননি তাদের চাকরি জীবনের শুরুতেই তাদের এভাবে প্রাণ হারাতে হবে।
আরও মারাত্মক অপরাধ যেটা হলো সেটা নিজের সমস্ত দোষ উনি পরিকল্পিতভাবে ওনার সন্তান-সম ভাই পিকলুর ওপর চাপিয়ে দেন। খুনের জায়গায় ভাইকে নিয়ে গিয়ে তিনি প্রথমে হত্যা করেন, তারপর ভিকটিমের পাশে ভাইয়ের জুতোর ছাপ এবং ভিকটিমের বডির ওপর ভাই-এর আঙুলের ছাপ এঁকে রাখেন। এমনকি ওর হাতে লেখা কাগজ ওখানে ছেড়ে আসেন প্রমাণ হিসেবে। আর আমার বিশ্বাস পিকলুর ওপর উনি মানসিক অত্যাচারও করতেন। কারণ পিকলু হাতের কব্জিতে একটা নখের টাটকা আঁচড় দেখা যাচ্ছে। ওটা আমরা আসার মুহূর্তে সম্ভবত ওকে করা হয়েছে। এমনকি ওর মা-বাবাকেও মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হত। আশা করি জেরার চাপে সেই সত্যটা বেরিয়ে যাবে।
টিকু আমার পাশেই বসেছিল। এখন ওর চোখে মুখে অপার্থিব হিংস্রতা। পিকলু আমার হাত ধরে আছে।
সুমন দীর্ঘাঙ্গি ঘরে ঢুকলেন।
-কি রণবীর সব ঠিকঠাক তো?
-সব ঠিকঠাক।
মনোহর বাবু বড্ড ভেঙে পড়েছেন বলে মনে হল। ওনার স্ত্রী বিনোদ দেবীও চুপচাপ।
নবীনবাবু বললেন, কিন্তু আজ বিকেলে পিকলুকে কারা নিয়ে গেছিল?
-সেটা একটা চাল। যার ফলেই আমরা শিওর হতে পেরেছি আসল দোষী কে? আমি জানতাম যদি মূল টোপ গায়েব হয়ে যায়। তাহলে সেই টোপ খুঁজতে শিকারি আসবেই। তাই প্রিয়ম আজ বিকেলে আমার আর সুমনবাবুর কথা মতন পিকলুকে নিয়ে গোলপার্কে যায়। সেখানে ওকে খুঁজতে খুঁজতে সৌরভবাবু হাজির হন । আমরা বুঝতে পারি এ অন্বেষণ স্নেহের অন্বেষণ নয়, ক্রোধের অন্বেষণ। পিকলুকে খুঁজে পাওয়ার পর তার ওপর অত্যাচারের ভিডিও প্রিয়ম অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ওর মোবাইলে বন্দি করে নিয়েছে।
কিন্তু পিকলুর মনের ওপর যা চাপ তার কথা ভেবেই আমার খুব কষ্ট হল। পিকলু তার দাদাকে সত্যিই ভালোবাসে। সুমনবাবু যখন টিকু ওরফে সৌরভবাবুর হাতে হ্যান্ডক্রাফ পড়াচ্ছেন, পিকলু বলল, দাঁড়া ভাই তোমায় আমি ছাড়িয়ে আনব। চিন্তা করো না।
আইন এখন পিকলুর কথা শোনে কি না সেটাই দেখার।
নবীনবাবুর বোন ও ভগ্নিপতির অনুরোধে আমরা তিনজন আরও তিনদিন কলকাতায় রইলাম। জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়ি, শিমুলিয়া বিবেকানন্দের বাড়ি, মিউজিয়াম, হাওড়ার দেউলটিতে শরৎচন্দ্রের বাড়ি, বিড়লা প্ল্যানেটরিয়াম সহ কলকাতার অজস্র স্নিগ্ধ স্মৃতি নিয়ে যখন ফিরে এলাম তখন পিকলুর জন্য বড্ড মন কেমন করছিল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *