• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ২২)

বেনু মশলাঘর

বিপুর সাথে সেদিনের সাক্ষাৎটা সারতে পেরে ভেতরে ভেতরে দারুণ এক প্রশান্তি কাজ করে কণার। বেশ হয়েছে। এই যে বিপুকে সে বোঝাতে পেরেছে যে তাদের সম্পর্কটা আসলে মৃত, আর তার কফিন বয়ে বেড়ানোর মানে হয় না কোনো, সেটা ভেবেই ভীষণ স্বস্তি পাচ্ছে সে মনে। না বলা সহজ নয় আদতে। বিপুকে তো আরও নয়। গোঁয়ার প্রকৃতির ছেলে সে। সহজে মানতে চায়নি। কণাকে সে ভাবতে শুরু করেছিল নিজের অধীনস্থ কেউ, নিজস্ব সম্পত্তি। ইচ্ছে মতো ব‍্যবহার করা যায় যাকে। কণারও যে বলার থাকতে পারে কিছু, থাকতে পারে স্বাধীন ইচ্ছে ও মতামত, সেটা সে ভাবতেই পারেনি একদম। কণার কথায় তাই প্রথমটায় ভীষণ রেগে গেছিল বিপু। তার প্রতিক্রিয়ায় মোটেই অবাক হয়নি কণা। বিপুকে যতটা সে চেনে তাতে এমন কিছুর জন্য মনে মনে প্রস্তুত ছিল সে। তাই সে ঘাবড়ায়নি মোটেই। ঠান্ডা মাথায় বিপুকে সে বুঝিয়েছে। বলেছে, আমাদের পথটা আলাদা বিপু। বুঝতে চেষ্টা কর। বন্ধুত্বটা নষ্ট করো না। আমি চাই তোমার সাথে সহজ স্বাভাবিক সম্পর্কটুকু থাক।
কেন? তোমার পথ কেন আলাদা হয়ে গেল হঠাৎ, শুনি? কে আসছে তোমার পথে এখন যারে নিয়া নতুন পথে হাঁটা দিবা তুমি? -বিপুর কন্ঠে শ্লেষ আর ব‍্যঙ্গ ঝরে। পারলে সে কণাকে কষে এক থাপ্পর লাগায় তখনই।
বিপু, বোঝার চেষ্টা করো বিষয়টা প্লিজ। তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা কোনো চূড়ান্ত পরিণতি পায়নি। এবং তার আগেই তোমার প্রতি ভীষণরকম ভাবে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি আমি। তোমার প্রতি আমার ভেতরে অন্য রকম কোনো বোধ খুঁজে পাচ্ছি না আমি। তাহলে শুধু শুধু এই সম্পর্কটা কেন বয়ে বেড়াব আমরা, বলো? তোমার বা আমার, আমাদের কারো জন্যই তো ভালো নয় সেটা, তাই না?
কেন? আগ্রহ কেন হারায়ে ফেলছ? কী কারণে? আর পরিণতির কথা কী কও? চাও তো আজই কাজী অফিসে যাব। যাবা? এখনই যাব। যাবা?
বিপুর একগুঁয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে তার এমন ছেলেমানুষী কথায় এতক্ষণে ধরে রাখা গাম্ভীর্যের মুখোশটা সরে গেল আপনাতেই। ফিক করে হেসে ফেলল কণা। বিপু জ্বলে উঠল রাগে। তেতো কণ্ঠে বলল, হাসো ক‍্যান? হাসির কিছু বলছি?
বোকামি করো না বিপু। সহজ হও। দেখ, জীবন তো আসলে ছোট নয় খুব। অনেকটা পথ। এই পথটুকু হাঁটতে এমন একজনকে সঙ্গে নেয়া উচিত যে তোমাকে বুঝবে, তোমার ভাব ও ভাবনার সাথে যার ন‍্যূনতম মিল থাকবে। তোমার অনুভূতির সাথে যার অনুভূতি মিলবে। আমি তোমার জীবনে তেমন কেউ নই। তুমিও তেমন কেউ নও আমার জীবনে।
ওওও, তাই? তো তোমার জীবনে এই তেমন কেউটা কে এখন? রিফাত? -কণ্ঠে আগুন ঢেলে বলল বিপু। আঁচটা টের পেল কণা। তারচে চমকাল বেশি। ভীষণ চমকে অবাক কণ্ঠে সে বলল, কী বলো এসব? এখানে রিফাত কোত্থেকে আসছে!
কোত্থেকে আসছে তা তো জানি না! কিন্তু আসছে!
কেন আসছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না বিপু! সেদিনের পর রিফাতের সঙ্গে কখনও কথা পর্যন্ত হয়নি আমার আর। দেখা তো বহুদূর!
কিন্তু সেদিনের পর থেকেই মিসবিহেভ শুরু করছ তুমি আমার সঙ্গে। দূরে সরে যাচ্ছ ইচ্ছে করে। টের পাচ্ছি আমি।
বোকামি করো না বিপু। হয়তো সেদিনের কোনো ঘটনায় তোমাকে নিয়ে আমার ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সেজন্য রিফাত বা অন্য কারো ভূমিকা নেই। রিফাতকে এর মধ্যে এনো না প্লিজ।
কেন কেন? রিফাতকে আনলে কী সমস্যা? তার কথা বলতেই তোমার গায়ে অমন ফোস্কা পড়তেছে ক‍্যান? ঘটনা তাহলে অনেক দূর? কী কও?
ছি বিপু। কী বলো এসব? সে নাকি তোমার বন্ধু! ছি।
রাখ তোমার ছি ছি। হারামজাদা বন্ধু নামের দুশমন। সেদিনের পর থেকে শুধু কণা কণা জপে হারামজাদা। আর ফোন নাম্বার চায়। শালা শুয়োরের বাচ্চা। নাম্বার দেবো আমি, আমাকে এত বোকা পাইছে, না?
বিপুর কথায় কেঁপে উঠল কণা। নিজের ভেতরে শিহরণ টের পেল। ঝড়। বিপুকে বুঝতে দিল না একদম। প্রাণপণে নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। বিপুর সঙ্গে পরের আলাপটুকু শেষ করল দ্রুত, দায়সারাভাবে। তাকে বিদায় দিয়ে হোস্টেলে ফিরল কণা। অনেকটা ঘোরের ভেতরই ফিরল সে। বাকি সময়টা ঝিম ধরে থাকল কণা। চুপচাপ। পড়ায় মন বসাতে পারল না একদম। গান শুনল। ফোনে কথা বলল মা আর মেহেরবানুর সাথে। তারপর ভাবতে বসল। বিপুর বলা কথাগুলো মনে মনে উল্টে পাল্টে দেখল কণা। না। ভুল কিছু বলেনি বিপু। রিফাতের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে বিপু তাকে টানে না আর। একদম টানে না। কিন্তু সেজন্য কে দায়ী? গালে হাত দিয়ে ভাবল কণা। সে নিজে? নাকি রিফাত? নাকি বিপু? মাথা নেড়ে ভাবনাটা নাকচ করল নিজেই। রিফাতকে নিয়ে সচেতনভাবে সে ভাবেনি কিছুই। অবচেতনভাবেই রিফাত তার ভাবনায় ঢুকে পড়েছে কখন, নিজেই টের পায়নি কণা। আর সেদিনের ঘটনায় তার নিজের, রিফাতের কিংবা বিপুর, কারোই হাত ছিল না আসলে। প্রকৃতি ঘটনাটা ঘটিয়েছে। রিফাতকে এনে ফেলেছে কণার ভাবনায়। কণাকেও রিফাতের। অথচ বেচারা বিপু সেদিনের ঘটনাটার জানে না কিছুই। সে তখন ব‍্যস্ত ছিল এন্ড্রয়েড ফোনে। কিন্তু বিপুর কথাটা কণার মনে কেমন রিমঝিম বৃষ্টি এনে দিল। অবশ লাগল শরীর। কথাটা মনে পড়তেই বারবার শিহরণ জাগল মনে। কণা কণা জপ করছে রিফাত! নাম্বার চাইছে কণার! কথাটা ভাবতে কেন যে এত ভালো লাগল কণার। মনে হলো ঝর্ণার শব্দ আছড়ে পড়ল কানে। তার মানে রিফাতও পুড়ছে গোপনে। ভীষণ ভালো লাগল ভাবতেই। দারুণ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল মনে। আহা। কণা একাই কেন পুড়বে হে! রিফাতও পুড়ুক ভীষণ। অঙ্গার হোক সে-ও। নইলে কী করে সে বুঝবে কণার পোড়ামাটি মন!
পরদিন দারুণ ফুরফুরে মনে ক্লাসে গেল কণা। তাসনূভা আর কেয়ার সঙ্গে হাহা হিহি করল অনেকক্ষণ। হাসপাতালে রেজার কেবিনে কেয়ার ঘন ঘন সেবা দিতে যাওয়া আর রেজার ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠা নিয়ে কেয়াকে সে আর তাসনূভা মিলে ক্ষেপানোর চেষ্টা করল অনেকক্ষণ। গা করল না কেয়া। পাত্তাই দিল না। অসুস্থ রোগীর সেবা দিতে যাওয়াই মুখ‍্য উদ্দেশ্য কেয়ার, সাফ জানিয়ে দিল সে। শুনে আরেকপ্রস্থ হাহা হিহি করল তারা। কেয়া খানিকবাদেই চলে গেল ওটিতে। আজ ওটি ডিউটি আছে তার। ফাঁকিবাজির সময় নেই একদম। তাসনূভারও ডিউটি পড়েছে ফিমেল ওয়ার্ডে। চলে গেল সে-ও। কণার ডিউটি নেই আজ। হঠাৎই চারদিকটা ভীষণ ফাঁকা লাগল তার। ফাঁকা আর শূন্য। কী করবে ভাবল কণা। হলে ফিরবে, ভাবল একবার। পরক্ষণেই নাকচ করল ভাবনাটা। হল ফাঁকা এখন। রুমও। এত তাড়াতাড়ি সেখানে ফেরার মানে হয় না কোনো। তারচে সামনের খোলা জায়গাটাতে বসে হাওয়া খাবে খানিক, সাথে বাদাম। ভেবে সেদিকে পা বাড়াল কণা। খোলা প‍্যাসেজ পেরিয়ে মেডিকেলের গেটের সামনে আসতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠল কণা। রিফাত! ম্লান, শুকনো মুখ। এলোমেলো চুল। কণাকে দেখে থমকাল একটু। আধফোঁটা হেসে এগিয়ে এল সহজ, স্বাভাবিক পায়ে। কণার চোখে চোখ রেখে মৃদুকণ্ঠে বলল, কেমন আছো?
ভালো। তুমি? -শরীরের ভেতর ঝিনঝিনে, অবশ করা এক অনুভূতি নিয়ে ছোট্ট করে বলল কণা। পায়ের নিচে মাটিটা তখন দুলছে ভীষণ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।